--- বিজ্ঞাপন ---

জার্মানের ভি-২ মিসাইলের ব্লু প্রিন্ট থেকে বানানো হয় ইন্টার কন্টিন্যাটাল ব্যালেস্টিক মিসাইল

রাশিয়ার বিমান বাহিনীতে সভিয়েত আমলের মাত্র ১১টি পুরোনো টিইউ-১৬০

0

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মার্কিন এবং সভিয়েত শিবিরের মধ্যে কোল্ড ওয়ার চলাকালীন অবস্থায় বিশ্বের প্রথম কোন ইন্টারকন্টিন্যাটাল ব্যালেস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম) সফল পরীক্ষামুলক উৎক্ষেপণ করে তৎকালীন সভিয়েত ইউনিয়ন (ইউএসএসআর)। মুলত পঞ্চাশের দশকে সভিয়েত ইউনিয়ন তার প্রধান প্রতিদ্বন্দী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো জোটকে কৌশলগতভাবে প্রতিহত করার জন্য এবং সরাসরি ইউরোপের দেশগুলোতে পারমাণবিক অস্ত্র হামলার কৌশলকে সামনে রেখে অত্যন্ত গোপনে নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ক্যাপবল ইন্টার কন্টিন্যাটাল ব্যালেস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম) নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করে দেয়।

অবশ্য সভিয়েত ইউনিয়ন এর ইন্টারকন্টিন্যাটাল ব্যালেস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম) প্রথম সফল উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম হলেও এই গবেষণার মূল ভিত্তি ছিল কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপক ব্যবহৃত জার্মানের ভি-২ মিসাইল। অর্থ্যাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের জার্মান চুড়ান্তভাবে পরাজিত হলে মার্কিন এবং সভিয়েত বাহিনী জার্মানের গোপন ভি-২ মিসাইল ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টে অভিযান চালিয়ে যতটা সম্ভব ভি-২ মিসাইলের ডুকমেন্ট এবং ব্লু প্রীন্ট সংগ্রহ করে নিজ দেশে নিয়ে যায়। আর এই ভি-২ মিসাইলের উপর ভিত্তি করে প্রায় এক দশক ব্যাপী গবেষণা চালিয়ে সভিয়েত ইউনিয়ন সর্ব প্রথম নিজস্ব প্রযুক্তির মাল্টি স্টেজ আর-৭ ইন্টারকন্টিন্যাটাল ব্যালেস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম) তৈরি করতে সক্ষম হয়।

১৯৫৩ সালে সভিয়েত ইউনিয়নের মিসাইল ডেভলপমেন্টের মুখ্য বিজ্ঞানী সের্গেই কোরোলিওভকে সরকাররের পক্ষ থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং উন্নত হাইড্রোজেন ওয়ারহেড পরিবহণে সক্ষম একটি সত্যিকারের ইন্টার কন্টিন্যাটাল ব্যালেস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম) নির্মান শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় সভিয়েত ইউনিয়ন আর-৭ ব্যালেস্টিক মিসাইলের প্রথম লঞ্চটি করে ১৫ মে ১৯৫৭ সালে। কিন্তু আর-৭ মিসাইল লাউঞ্চের সাইট থেকে ৪০০ কিলোমিটার (২৫০ মাইল) পর্যন্ত গিয়ে মিসাইল্টি অপ্রত্যাশিত ভাবে আকাশেই ধ্বংস হয়ে যায়। তবে আর-৭ মিসাইলের প্রথম সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয় ১৯৫৭ সালের ২১ শে আগস্ট এবং এই পরীক্ষায় আর-৭ আইসিবিএম মিসাইল প্রায় ৬০০০ কিলোমিটার (৩৭০০ মাইল) অতিক্রম করে এবং বিশ্বের প্রথম ইন্টার কন্টিন্যাটাল ব্যালেস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম) হিসেবে নিজের যোগ্য স্থান করে নেয়।

সভিয়েত ইউনিয়নের এই সাফল্যটি ছিল মার্কিন জোটের জন্য চরম বিপদজনক এবং হতাশাজনক একটি বিষয়। যদিও এর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইন্টারকন্টিন্যাটাল ব্যালেস্টিক মিসাইল ডিজাইন ও তৈরিতে ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করে দেয়। আর এই ইন্টারকন্টিন্যানটাল ব্যালেস্টিক মিসাইলের উপর ভিত্তি করে ১৯৫৭ সালের ৪ই অক্টোবর মানব জাতির ইতিহাসে প্রথম স্যাটালাইট স্পুটনিক-১ মহাকাশে প্রেরণ করে মহাকাশ জয়ের এক নতুন যুগের সূচনা করে তৎকালীন সামরিক সুপার পাওয়ার সভিয়েত ইউনিয়ন।

সভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পরবর্তী সময়ে নতুন স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হওয়ার পেক্ষাপটে রাশিয়ার বর্তমান পুতিন সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট ও তার ন্যাটো জোটকে আকাশ পথে কার্যকরভাবে প্রতিহত করার জন্য তাদের বিমান বাহিনীকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে যাচ্ছে। আর তারই ধারাবাহিকতায় সভিয়েত আমলের পুরনো ১১টি টিইউ-১৬০ হেভী সুপার বোম্বার যুদ্ধবিমান সার্ভিসে এনেছে। তার পাশাপাশি আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে নতুন প্রজন্মের টিইউ-১৬০এম২ সিরিজের অত্যাধুনিক ৫০টি ম্যাক ২.৫ গতির হেভী সুপার বোম্বার সার্ভিসে আনার মহা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমানে রাশিয়ার বিমান বাহিনীতে সভিয়েত আমলের মাত্র ১১টি পুরোনো টিইউ-১৬০ 

বর্তমানে রাশিয়ার বিমান বাহিনীতে সভিয়েত আমলের মাত্র ১১টি পুরোনো টিইউ-১৬০ হেভী সুপারসনিক বোম্বার সার্ভিসে থাকলেও তা পর্যায়ক্রমে নতুন প্রজন্মের টিইউ-১৬০এম২ সিরিজের হেভী বোম্বার জেট দিয়ে রিপ্লেস করতে বদ্ধপরিকর রাশিয়ার পুতিন সরকার। রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে কাজান এভিয়েশন ফ্যাসালিটি প্লান্টে এক সভায় বলেছিলেন যে, আগামী ২০২১-২২ সালে নতুন প্রজন্মের হাইলী আপগ্রেডেড টিইউ-১৬০এম২ সিরিজের সুপার বোম্বার বিমান বাহনীর কাছে হস্তান্তর করা হবে।

রাশিয়া তাদের দীর্ঘ পাল্লার টিইউ-১৬০এম২ সিরিজের হেভী বোম্বারকে স্বয়ংক্রিয় চালিত অত্যাধুনিকত প্রতিরক্ষামূলক এইড স্যুট, আপগ্রডেড জ্যামিং প্রতিরোধ সিস্টেমসহ এবং অনন্য অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইন্সটল করে নতুন করে আধুনিকায়ন সম্পন্ন করেছে। পাশাপাশি একটি উন্নত এবং নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকবে। যা স্ট্র্যাটিজিক বোম্বারটিকে যে কোন ধরণের প্রচলিত এবং থার্মো নিউক্লিয়ার যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ১২,৩০০ কিলোমিটার রেঞ্জে সুপারসনিক ২.৫ ম্যাক গতিতে কমব্যাট অপারেশন পরিচালনা করতে সক্ষম হবে।

রাশিয়া বর্তমানে তাদের উচ্চ প্রযুক্তির টিইউ-১৬০এম২ সিরিজের যে হেভী বোম্বারটির ম্যাসিভ প্রডাকশন লাইন চালু করেছে। যা আসলে সভিয়েত আমলের কৌশলগত তুপলেভ টিইউ-১৬০ (ব্লাকজ্যাক) লং রেঞ্জ বোম্বারের উন্নত এবং আধুনিক ভার্সন হতে যাচ্ছে। মুলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত বি-৫২ এবং নেক্সড জেনারেশন বি-২১ রেইডার স্টিলথ বোম্বারের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর এবং স্ট্র্যাটিজিক নিউক্লিয়ার মিসাইল সমৃদ্ধ ৫০টি নতুন প্রজন্মের ও অত্যাধুনিক টিইউ-১৬০এম২ সুপারসনিক পারমাণবিক বোম্বার পর্যায়ক্রমে সার্ভিসে আনার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। যাতে রাশিয়ার সর্বাধুনিক এভিয়েশন, রেডার, কমিউনিকেশন এন্ড নেভিগিয়েশন প্রযুক্তি সংযুক্ত করা হবে।

টিইউ-১৬০ এম রাশিয়ান বোম্বারে পূর্বের চারটি পুরোনো ইঞ্জিনের পরিবর্তে নতুন প্রজন্মের অত্যন্ত শক্তিশালি এনকে-৩২ (Kuznetsov NK-৩২ afterburning turbofan) সিরিজ-২ আফটার বার্নিং টার্বোফ্যান জেট ইঞ্জিন ব্যবহার করা হচ্ছে। আর টিইউ-১৬০ বোম্বারের ইন্জিন হচ্ছে বর্তমান বিশ্বে সার্ভিসে থাকা এয়ারক্রাফট গুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ইন্জিন। এনকে-৩২ এর প্রতিটি জেট ইঞ্জিন ৩ হাজার ৪শত কেজি ওজনে ৩০০ কেএন পর্যন্ত থ্রাষ্ট উৎপন্ন করতে সক্ষম। যা এফ-২২ র‍্যাপটারের এর দুই ইন্জিনের মিলিত থ্রাষ্টের চেয়েও প্রায় দ্বিগুণ। আবার এ রকম ৪টি ইন্জিন টিইউ-১৬০ এম এ ইন্সটল করা হয়েছে। চারটি এনকে-৩২ সুপার থ্রাস্ট ইঞ্জিনের বদৌলতে এটিই হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী বোম্বার জেট লাইটার। টিইউ-১৬০ এম সিরিজের সুপার বোম্বার ম্যাক ২.০২ গাতিতে ৪০ টন ওজনের নিউক্লিয়ার এণ্ড নকভেনশোনাল মিসাইল ও অস্ত্র নিয়ে কোন রকম বিরতী না দিয়েই একটানা ১২,৩০০ কিলোমিটারের দীর্ঘ আকাশ পথ পাড়ি দিতে সক্ষম।

রাশিয়ার কাজান এভিয়েশন এন্টারপ্রাইজ এর প্রডাকশন প্লান্টে টিইউ-১৬০এম২ সিরিজের বোম্বার উৎপাদন করা হবে এবং প্রতিটি সুপার বোম্বারের ইউনিট কস্ট ধরা হয়ছে ১৭ বিলিয়ন রুবল বা প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার। তাছাড়া এর প্রজেক্ট কস্ট নির্ধারণ করা হয়েছে ২০০ বিলিয়ন রুবল বা তিন বিলিয়ন ডলার প্রায়। প্রাথমিকভাবে সংক্ষিপ্ত সময়ে রাশিয়ার স্টাটিজিক নিউক বিমান বাহিনীর জন্য আগামী ২০২৭ সালের মধ্যেই নুন্যতম ১০টি টিইউ-১৬০এম২ সিরিজের সুপার বোম্বার সরবরাহ করা হবে বলে জানিয়েছে কাজান এভিয়েশন এন্টারপ্রাইজ। এখানে আসলে টিইউ-১৬০এম২ সুপার বোম্বার উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিমানের স্টিলথ টেকনোলজির মতো বিষয়কে গুরুত্ব না দিয়ে এর সর্বোচ্চ গতি, ম্যাসিভ ওয়েপন্সস ক্যাপাবিলিটি এবং লং রেঞ্জের মতো প্রযুক্তিগত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব প্রদান করে বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে।

প্রায় ১৩ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ পাল্লার টিইউ-১৬০ এম২ এর পে লোড ম্যাক্সিমাম ক্যাপাসিটি ৪০ হাজার কেজি বা ৪০ টন ধরা হয়েছে। এর কম্ব্যাট রেডিয়াস ৭৩০০ কিলোমিটার এবং সার্ভিস সিলিং ১৬ হাজার মিটার। এটি একই সাথে ২০০ কিলোটন ক্ষমতা সম্পন্ন ১২টি ৩০০ কিলোমিটার পাল্লার কেএইচ-৫৫ (প্রচলিত ও পারমাণবিক ওভারহেড) অথবা ১২টি পারমাণবিক ওভারহেড সমৃদ্ধ ৩০০ কিলোমিটার পাল্লার কেএইচ-১৫ ক্রুজ মিসাইল বহন করতে পারবে। টিইউ-১৬০ এম কমপক্ষে ১২টি ক্ষেপনাস্ত্রসহ প্রচলিত গাইডেড এন্ড আইগাইডেড হেভী বোম্বস এন্ড ওয়েপন্সস সিস্টেম বহন করবে এবং পাশাপাশি থাকছে নিজস্ব স্বয়ংক্রিয় চালিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও জ্যামিং প্রটেকশন সিস্টেম। সভিয়েত আমলের তোপলেভ টিইউ-১৬০ এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ২.০০ ম্যাক হলেও নতুন প্রজন্মের টিইউ-১৬০এম সুপার বোম্বারের সর্বোচ্চ গতিবেগ ২.৫ ম্যাক পর্যন্ত বা এর এর কাছাকাছি হতে পারে।

আসলে তৎকালীন সোভিয়েত আমলে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মোট ১৬টি টিইউ-১৬০ উৎপাদন করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে চরম আর্থিক সংকটের মুখে এই স্টাটিজিক সুপার বোম্বারের উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বর্তমানে রাশিয়ার বিমান বাহিনীতে পুরনো আমলের ১১টি কৌশলগত টিইউ-১৬০ (ব্লাকজ্যাক) বোম্বার স্বল্প পরিসরে সক্রিয় থাকলেও তা পর্যায়ক্রমে নতুন প্রজন্মের টিইউ-১৬০এম২ দ্বারা রিপ্লেস করার মহা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে রাশিয়ার পুতিন প্রশাসন ও তার জায়ান্ট এভিয়েশন কর্পোরেশনগুলো। তাছাড়া রাশিয়ার কিন্তু ১৯৫৪ সাল থেকে অতি পুরনো ৩২টি টার্বোপ্রোপ টিইউ-৯৫ বিয়ার এবং ৬৯টি টিইউ-২২এম বোম্বার এখনো পর্যন্ত বিমান বাহিনীতে সক্রিয় রেখেছে এবং বিশেষ করে ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত সিরিয়ার আসাদ সরকারকে সামরিক সহায়তার অংশ হিসেবে নজিরবিহীনভাবে একাধিক যুদ্ধক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ব্যবহার করে যাচ্ছে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না।#

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.