--- বিজ্ঞাপন ---

দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে অশনি সংকেত

সিঙ্গাপুর, কলম্বো, পোর্ট কেলাং এ জাহাজ ও কন্টেনার জট

0

বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের নতুন করে ধাক্কার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরেও। ফলে পণ্য আমদানি রফতানি বাণিজ্যে দেখা দিয়েছে নানা অশ্চিয়তা। বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরে বিপুল অর্ডার আসলেও সঠিক সময়ে পণ্য রফতানি করা নিয়ে চিন্তিত অনেক গার্মেন্টস মালিক। কারন সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও পোর্ট কেলাং বন্দরে চলছে জাহাজ জট। দেশের ভেতরে ও বাইরে পণ্য ভর্তি অনেক কন্টেনার আটকা পড়েছে। অনেক জাহাজে পণ্য উঠানোর জন্য লেগে যাচ্ছে ১ মাসেরও বেশি সময়। অথচ স্বাভাবিক সময়ে লাগে ৫ থেকে ৮ দিন। এ অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান বিভিন্ন শিপিং লাইনের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেছেন। তিনি বৈঠকে কলম্বো বন্দরের উপর জোর দিয়েছেন। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং এর চেয়ে কলম্বো বন্দরের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো। কলম্বো বন্দরের চেয়ারম্যানের সাথে এরই মেেধ্য সাক্ষাত করেছেন শ্রীলংকায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমশিনারও।

এদিকে বিদেশী জাহাজ লাইনের মালিক হ্যাপাগ লয়েড সিঙ্গাপুর বন্দরে বাংলাদেশের আমদানি যোগ্য কোন কন্টেনার লোড না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কলম্বোর ক্ষেত্রেও এ নিয়ম পালন করতে যাচ্ছে বলে সূত্র জানায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এ জাহাজ লাইন কোন ঝুকিঁ নিতে চাইছে না। ফলে এসব বন্দরে বাংলাদেশের পণ্য ভর্তি কন্টেনারের স্তুপ জমছে। আবার কোন কোন জাহাজ লাইনের মালিক বিলম্বের জন্য চার্জ আরোপ করার চিন্তা করছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা এ চার্জ বসিয়েছে বলেও জানা গেছে। জাহাজ বেশি দিন বন্দরে বসে থাকলে তার জন্য অতিরিক্ত চার্জ দিতে হয় ব্যবসায়ীদের। বর্তমানে অবস্থা যে পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তাতে জাহাজ মালিকদের চার্জ দিতে গিয়ে অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতির মূখে পড়বে।

সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান বিদেশী জাহাজ মালিক প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠকে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। গত সোমবার বন্দরের কনফারেন্স কক্ষে প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠকে জাহাজ মালিকদের এজেন্টরা কলম্বো বন্দরে জাহাজ বাড়ানোর জন্য ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। এ সময় বন্দর চেয়ারম্যান বলেছেন, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জাহাজ জট চলছে। বিশেষ করে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলো এ সমস্যা মোকাবেলা করে চলেছে। চেয়ারম্যান জাহাজ প্রতিনিধিদের কলম্বো বন্দরে জাহাজ বাড়ানোর প্রস্তাবগুলো প্রতি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন বলে জানান।

এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘সম্প্রতি কোভিড মহামারীর কারণে বিভিন্ন দেশে লকডাউনের জন্য সিঙ্গাপুর, কলম্বোসহ বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে জাহাজ এবং পণ্যের জট সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা যায়। বিশ্বব্যাপী গত এক বছরে বিভিন্ন দেশে লকডাউনের ফলে শ্রমিক সঙ্কট, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা, বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে জটজনিত কারণে সকল প্রান্তেই পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বৃহৎ বন্দরসমূহ যেমন- সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও চীনের বিভিন্ন বন্দরে জটের কারণে ওই সকল বন্দর জেটিতে জাহাজ ভিড়তে ৮ থেকে ১০ দিন সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ, ভারত, কম্বোডিয়ার মতো ছোট বন্দর হতে রফতানিযোগ্য কন্টেনারের সংযুক্তি পেতে বিলম্ব হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর হতে কন্টেনার সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দরে পৌঁছানোর পর মাদার ভেসেল পেতে প্রায় ২ সপ্তাহ সময় লাগছে। কিন্তু চটগ্রাম বন্দরে কোভিড মহামারীকালেও কার্যক্রম নির্বিঘেœ পরিচালিত হয়েছে এবং চটগ্রাম বন্দর প্রতিদিন চব্বিশ ঘণ্টা চালু রয়েছে। ফলে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে ১১ দশমিক ৯৮, কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ে ৩ দশমিক ০৯ এবং জাহাজ আগমনে ৭ দশমিক ৯২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর এবং অফ-ডকসমূহে প্রায় ৪০ হাজার টিইইউএসের বেশি খালি কন্টেনার সংরক্ষিত আছে। তন্মধ্যে অফ-ডকসমূহে ১৩ হাজার ৬৪৭ টি ২০ ফুট সাইজের এবং ১২ হাজার ৬৮৯টি ৪০ ফুট সাইজের কন্টেনার এবং চট্টগ্রাম বন্দরে ২ হাজার ৪৩১টি ২০ ফুট এবং ১ হাজার ৪৭৭টি ৪০ ফুট সাইজের কন্টেনার রয়েছে। তাই বন্দরে খালি কন্টেনারের কোন সঙ্কট পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বাংলাদেশে বিভিন্ন এমএলওগণের যে খালি কন্টেনার রয়েছে, তা পরস্পরের মধ্যে সরাসরি বিনিময়ের মাধ্যমে সমন্বয় করে ব্যবহার করলে ক্রমবর্ধিষ্ণু রফতানি চাহিদা খুব সহজেই পূরণ করা সম্ভব।’

বিদেশী জাহাজ মালিক হ্যাপাগ লয়েড বাংলাদেশের আমদানিযোগ্য কন্টেনার বহন বন্ধ রাখার বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, হ্যাপাগ লয়েড নামের একটি শিপিং কোম্পানি সিঙ্গাপুর বন্দর থেকে বাংলাদেশমুখী কন্টেনার বুকিং চার সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেছে। এ শিপিং প্রতিষ্ঠানের নিজেদের জাহাজ নেই। অন্যের জাহাজে কন্টেনার পরিবহন করে থাকে, যা তারা কলম্বো বন্দরের মাধ্যমেও অপারেট করবে। ফলে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানিতে সমস্যা হবে না।

অনুসন্ধানে জান গেছে, বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের সিংহভাগই কন্টেনারের সাহায্যে হয়ে থাকে। গভীরতা জনিত কারনে চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ ঢুকতে পারে না। বন্দরটি কন্টেনার জাহাজ নির্ভর। প্রতি বছর বিভিন্ন শিপিং লাইনের ৪০ থেকে ৫০টি কন্টেনার জাহাজের মাধ্যমে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য হয়ে থাকে।  বিশ্বে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন সমুদ্র বন্দরে। বিশেষ করে যেসব দেশে গভীর সমুদ্র বন্দর রয়েছে সেসব দেশে দেখা দিয়েছে জাহাজ ও কন্টেনার জট। একইভাবে লকডাউন ও করোনা ভাইরাসের কারণে সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও মালয়েশিয়ার পোট কেলাং বন্দর এ চলছে জাহাজ ও কনটেইনার জট। বাংলাদেশ থেকে কন্টেনার বাণিজ্য তিনটি গভীর সমুদ্র বন্দর দিয়ে হয়ে থাকে। সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং। এখান থেকে কন্টেনার পণ্য ফিডার বা কন্টেনার জাহাজে করে ঐ সব দেশে যায়। সেখান থেকে মাদার ভেসেল বা বৃহদাকার কন্টেনার জাহাজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পণ্য পৌছানো হয়। করোনার সময়ে গত প্রায় দেড় বছর ধরে বিভিন্ন দেশে লকডাউন চলছে। পরিস্থিতি কোনভাবে স্বাভাবিক না হওয়ার কারণে  শ্রমিক সংকট, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব বন্দরেই পণ্য পরিবহনে সংকট তৈরি হয়েছে। বন্দরগুলোর জেটিতে জাহাজ ভিড়তে ৮ থেকে ১০ দিন লেগে যাচ্ছে। এজন্য বাংলাদেশ, ভারত, কম্বোডিয়ার মতো ছোট বন্দর থেকেও ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের মাধ্যমে বড় জাহাজে রপ্তানি পণ্য তুলতে বিলম্ব হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দরে পৌঁছার পর বৃহদাকার জাহাজ বা মাদার ভেসেলে কানেকশন পেতে প্রায় দুই সপ্তাহ লাগছে।

চলমান পরিস্থিতিতে দেশের ১৯টি বেসরকারি ডিপোতে প্রায় ১৪ হাজার রপ্তানি পণ্যের কনটেইনার জমে গেছে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীরা চিন্তিত। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন আমদানি কারকের পণ্যসহ প্রায় ৩০ হাজার কনটেইনার জমে যায় সিঙ্গাপুর-কলম্বোতে।  তবে চট্টগ্রাম বন্দর বলছে, এখানে যে কনটেইনার ও জাহাজ জট হচ্ছে তার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কোনোভাবে দায়ী নয়। এটি ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টগুলোর সংকট। মেইন লাইন অপারেটর বা এমএলও যারা আছেন তাদের কনটেইনার পরিবহনের সংকট। তবে এ সংকটের সহজ সমাধানও আছে। এমএলওদের মধ্যে ডাইরেক্ট ইন্টারচেঞ্জ চুক্তি থাকলে অর্থাৎ একজনের কনটেইনার আরেকজন পরিবহনের সুযোগ থাকলে সংকটের সুরাহা হয়। কমন ক্যারিয়ার অ্যাগ্রিমেন্টও যদি তাদের মধ্যে থাকত, তাহলে এ সংকট হতো না। এ সংকটের সমাধান চট্টগ্রাম বন্দর কিংবা মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই।

সার্বিক পরিস্থিতিতে দেশের আমদানি রফতানি বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দেশগুলোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনারদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। এরই মধ্যে দেশগুলোর হাইকশিনাররা পরিস্থিতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট বন্দরগুলোর উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করছেন বলে জানা গেছে।#

 

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.