--- বিজ্ঞাপন ---

আফগানিস্তানঃ একটি দেশকে যেভাবে ধ্বংস করা হলো

0

কাজী আবুল মনসুর / সিরাজুর রহমান

আফগানিস্তানের ৬০’র দশক। প্রাণবন্ত ছিল আফগান পরিবেশ। স্বাধীন পশ্চিমাধারায় জীবনযাপন ছিল আফগান নরনারীর। ছিল চলাফেরার স্বাধীনতা। একটি উন্নত দেশের সব কিছুই ছিল আফগানিস্তানে। ত্রিশ দশকে আফগানিস্তানের বাদশাহ আমানুল্লাহর সময় থেকে আফগানরা বিশ্বে মাথা তুলে দাড়াতে শুরু করে। তার স্ত্রী সুরাইয়া আধুনিক ভাবধারার নারি ছিলেন। আমাদের বেগম রোকেয়ার মতোন সুরাইয়া ছিলেন আফগানিস্তানে নারী শিক্ষার অগ্রদুত। সুরাইয়া আফগান নারীদের একটি দলকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিক্ষা লাভের জন্য পাঠান তুরস্কে। নারী শিক্ষায় আফগান অন্যান্য দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। এমনকি পাশের বৃটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশের চেয়েও এগিয়ে যেতে থাকে আফগানিস্তান। কাবুলে প্রতিষ্ঠিত অনেক স্কুলের প্রধান হন বিদেশীরা। পশ্চিমা ধারায় আফগান গড়ে উঠতে থাকে। এ অগ্রগতি অনেক উন্নত দেশ মেনে নিতে পারে নি। এমনকি পাশের দেশ বৃটিশ শাসিত পাকিস্তান ও ইরান হতে মোল্লারা ফতোয়া দেয়া শুরু করে নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে। ঐক্যবদ্ধ মোল্লারা আন্দোলন শুরু করে আফগান শাসক আমানুল্লাহ’র বিরুদ্ধে। তারা দাবি জানায়, আমানুল্লাহকে অবশ্যই স্ত্রী সুরাইয়াকে তালাক দিতে হবে। নাহলে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। বাদশাহ আমানুল্লাহ স্ত্রীকে তালাক না দিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দেন ভাই এনায়েত উল্লাহর হাতে। এনায়েত উল্লাহ’র ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। এই ফাঁকে মোল্লারা শক্তিশালী হয়ে উঠে। আফগানিস্তানের সমাজে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। একের পর এক গোষ্ঠিগত দ্বন্দ্ব, গৃহযুদ্ধ, সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন, মার্কিনীদের হামলা -সব মিলে সম্ভাবনাময় একটি রাষ্ট্র ধংসের দিকে চলে যায়।
১৯৭০ ও ১৯৮০’র দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিচালিত জরিপে দেশটিতে তামা (ইউরেশিয়া অঞ্চলের মধ্য সবচেয়ে বড়), লোহা, উচ্চমানের ক্রোম, জিঙ্ক, ইউরেনিয়াম, বেরিল, বেরিট, সীসা, ফ্লোরোসপার, বক্সাইট, লিথিয়াম, টাইটালাম, এমারন্ড, সোনা ও রূপার সন্ধান পাওয়া যায়। ১৯৬৭ সালে এখানে প্রাকৃতিক গ্যাসের উত্তোলন শুরু হয়। ১৯৮০ সালে আফগানিস্তান প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রি কওে আয় করে ৩০ হাজার কোটি ডলার। যা ছিল আফগানিস্তানের মোট রফতানি আয়ের ৬০ শতাংশ। আফগানিস্তান এমন একটি দেশ যা প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ। এ দেশের সম্পদের পরিমান এত বেশি ছিল যা অন্য অনেক রাষ্ট্রের জন্য ছিল মাথাব্যথার কারন। আফগানিস্তান সরকার এসব সম্পদেও ব্যাপাওে জানলেও পাশে শক্রু ছাড়া কোন বন্ধু রাষ্ট্রকে পায়নি। বেশিরভাগ পরাশক্তির নজর ছিল আফগানিস্তানকে ধংস করে দেয়ার। এ সময়কার পরাশক্তিগুলোর চরিত্র দেখে এমনটাই ধারনা ছিল সবার মনে। আফগানিস্তানের মাটির নিচে কি পরিমান সম্পদ আছে তা বের করার সুযোগ আর হয়ে উঠেনি। যখন প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস উত্তোলন কওে আফগানিস্তানের সমাজ বিশ্বে মাথা উচু করে দাড়াতে শুরু করছিল তখন চারিদিকে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। আফগান বিদ্বেষী রাষ্ট্রগুলোর সবার নজর চলে যায় আফগানিস্তানের বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা হিন্দুকুশ পর্বতশ্রেনীর সম্পদ ভান্ডারের উপর। পরাশক্তিগুলো নিজস্ব কায়দায় জানতে পারেন, এখানে থাকা মূল্যবান পাথরের খনির কথা। কাবুলের হেলমন্দ প্রদেশে প্রাপ্ত তামার খনির বিষয়টি উঠে আসে আলোচনায়। বলা হয়ে থাকে এটি এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় তামার খনি। আলোচনায় আছে, আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশে উচ্চমান সম্পন্ন লোহার আকরিকের, যার মজুদ ৫০ কোটি টন বলে জানা গেছে। এ লাইনে রয়েছে বিশালাকৃতির কয়লা খনি। কাবুলে আবিস্কার হয় বিস্ময়কর প্যাগমেটাইটের খনি। প্রাকৃতিক মূল্যবান পদার্থ রুবি, কুনজাইট, হিডলাইট, এমারল্ড ও বেরোলিয়ামে পূর্ণ এসব খনি। রয়েছে বিরল মার্বেল খনি। যেখানে সোনা, বেরিটসহ নানা রকমের মূল্যবান পদার্থ রয়েছে। ভৌগোলিক কারণে আফগানিস্তান ছিল তেল-গ্যাসের ট্রানজিট রাষ্ট্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্বপ্রথম ১৯৬০ সালে এখানে বিপুল গ্যাসের সন্ধান পায়। তারা বিষয়টি দীর্ঘদিন গোপন রাখে। এমনকি এ গ্যাসের কথা জানতো না আফগানিস্তানের মানুষেরাও। সোভিয়েত ইউনিয়ন আরও আবিস্কার করে, এখানে শত শত মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে মূল্যবান পাথর। যেসব পাথর বিমান আর মহাকাশযান নির্মানে ব্যবহার করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন এসব খবর অগেভাগে জানার পর দেশটির দিকে তাদের নজর পড়ে। কিভাবে এসব মূল্যবান সম্পদে ভাগ বসানো যায় এ নিয়ে সোভিয়েত কুটনৈতিক মহল সরব ছিল।

১৯৭৯ সালের শেষের দিকে বিশ্বের অন্যতম সামরিক সুপার পাওয়ার সভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্থানে তাদের মদদপুষ্ট নাজিবুল্লাহ সরকারকে সামরিক সহায়তার নামে এক দীর্ঘ মেয়াদী সামরিক আগ্রাসন শুরু করে। সভিয়েত বাহিনী মুলত আফগানিস্তানের নাজিবুল্লাহ সরকারকে দেশব্যাপী চলমান গৃহযুদ্ধে মুজাহিদীন গেরিলা সঽগঠনের আক্রমন থেকে রক্ষা করার নামে কোন রকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৯ সালে হঠাৎ করেই কাবুলে প্রবেশ করে। তার সাথে হাজার হাজার সেনা, বিপুল সংখ্যক ট্যাংক, আর্টিলারী, রসদসহ শতাধিক যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টার নিয়ে আফগান গেরিলা মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ আক্রমন শুরু করে। আর নয় বছর এক মাস ব্যাপী এক দীর্ঘ মেয়াদী, ব্যয়বহুল ও অত্যন্ত প্রাণঘাতি যুদ্ধে জরিয়ে আসলে নিজের ধ্বংস নিজেই রচনা করে।

প্রথম দিকে আফগানিস্থানে এই অসম যুদ্ধে সভিয়েত বাহিনী ব্যাপক সফলতা লাভ করলেও পরবর্তীতে মার্কিন হস্তক্ষেপ, আফগান মুজাহেদীন গেরিলাদের প্রশিক্ষণ এবং ব্যাপক আকারে অত্যাধুনিক ক্ষুদ্র অস্ত্র ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম সরবরাহে আফগান যুদ্ধক্ষেত্র সভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট লাল ফৌজের জন্য এক রকম গলার কাটা হয়ে দেখা দেয়। তাছাড়া মাঝ পথে রণে ভঙ্গ দিয়ে আফগানিস্থান থেকে সরে আসাটা তৎকালীন বিশ্বের প্রথম স্থানীয় সামরিক পরাশক্তি সভিয়েত কমিউনিস্ট সরকারের পক্ষে একটি বড় ধরণের পেস্টিজ ইস্যু হয়ে দেখা দেয়। তাছাড়া দীর্ঘ নয় বছর ব্যাপী প্রাণঘাতী এ যুদ্ধ পরিচালনায় প্রায় ৫০.০০ বিলিয়ন ডলারের অধিক বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে সভিয়েত সরকার অর্থনৈতিকভাবে এক রকম দেউলিয়া হয়ে যেতে থাকে।

এখানে প্রকাশ যোগ্য যে, সাধারণ দৃষ্টিতে আফগান যুদ্ধে রাশিয়া বা তৎকালীন কমিউনিস্ট সভিয়েত ইউনিয়ন তাদের সমর্থিত আফগান নাজিবুল্লাহ সরকারকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দশ্যে সামরিক বহর প্রেরণ করলেও এক্ষেত্রে কিন্তু সভিয়েত ইউনিয়ন বা বর্তমানে রাশিয়ার মূল উদ্দেশ্য বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছিলো অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। সভিয়েত ইউনিয়ন কার্যত আফগানিস্তান দখলের মাধ্যমে পরবর্তীতে সুযোগ মতো প্রভাব বিস্তার করে কিংবা সামরিক উপায়ে পাকিস্তানে বা ইরানের সুবিশাল সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল হস্তগত করার মাধম্যে সরাসরি আরব সাগর এবং ভারত মহাসাগরের লাল বাহিনীর প্রবেশের পথ উম্মুক্ত করার ছক অনেক আগেই তৈরি করে রেখেছিল। তাছাড়া এই মহা পরিকল্পনায় আওতায় সভিয়েত বাহিনী ভবিষ্যতে সুযোগ মতো আরব সাগরে মধ্যপ্রাচ্যের বৈশ্বিক বাজারে তেল সরবরাহের পথ নিয়ন্ত্রণ বা নিজ দখলে আনার মাধ্যমে কৌশলগতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার জোটকে চাপে রাখা বা প্রতিহত করাই ছিল এর মুখ্য উদ্দেশ্য।

আবার ভারত মহাসাগরে সরাসরি প্রবেশ এবং এতদ অঞ্চলে সামরিক প্রভাব বিস্তার ও নিজস্ব সামরিক আবস্থান সুদৃঢ় করতে চেয়েছিলো তৎকালীন সভিয়েত রেড আর্মী। যদিও আমার এহেন যুক্তিটি বাস্তব সম্মত নাও হতে পারে। তবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও প্রাণঘাতী এই আফগান যুদ্ধে তৎকালীন কমিউনিস্ট সভিয়েত ইউনিয়ন সরকারের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন দীর্ঘ ৯ বছর এক মাসব্যাপী ভয়াবহ এই আফগান যুদ্ধে সভিয়েত ইউনিয়ন মারাত্মকভাবে অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং যুদ্ধে সভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো এবং সক্ষমতা এক রকম ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌছে যায়। তবে যে যাই বলুক না কেন, প্রায় চার দশক ব্যাপী সভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের বুকে নিজেকে প্রথম স্থানীয় সামরিক পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেও কিন্তু কোন দিনই নিজেকে উচ্চ মাত্রায় অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। তাছাড়া সভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বমঞ্চে যে সমস্ত দেশের সাথে কৌশলগত এবং সামরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল সেখানে চীন ব্যাতিত অধিকাংশ দেশই ছিল অর্থনৈতিকভাবে শক্তিহীন এবং কম গুরুত্বপূর্ণ দেশ। যেখানে অত্যন্ত কৌশলী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু সব সময়ই অধিকতর ধনী এবং সম্পদে পরিপূর্ণ দেশগুলো এবং তাঁদের সরকারকে নিজ নিয়ন্ত্রণে রেখে কৌশলগতভাবে সুবিধা আদায় করে নিতে ব্যস্ত থাকে।
আসলে আফগান যুদ্ধে সভিয়েত বাহিনীর সামরিক ক্ষতি এবং ধ্বংসযজ্ঞের প্রকৃত কোন তথ্য উপাত্ত পাওয়া সম্ভব না হলেও মনে করা হয় এ যুদ্ধে সোভিয়েত বাহিনীর প্রায় তিন শতাধিক জেট ফাইটার বা বোম্বার এবং পাশাপাশি চার শতাধিক কমব্যাট ও সামরিক পরিবহণ হেলিকপ্টার সরাসরি ধ্বংস কিম্বা মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদিও তৎকালীন সময়ে সভিয়েত সরকার আফগান যুদ্ধে তাঁদের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি বিপর্যয় বিশ্ববাসীর চোখে আড়াল করতে থাকে এবং বর্তমানে ইউকী পিডিয়া বা অন্যান্য সামরিক ওয়েবসাইটে যে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে তা কিন্তু যথেষ্ঠ প্রশ্নবিদ্ধ বা অনেকটা অনুমান নির্ভর হয়ে থাকে। বিষয়টি আনুমানিক হলেও মনে করা হয় দীর্ঘ মেয়াদী এ যুদ্ধে সভিয়েত সামরিক বাহিনীর পক্ষে ১২ শতাধিক ট্যাংক, ২ হাজার আর্টিলারী সিস্টেম পাশাপাশি ৫ হাজারের উপর সামরিক যান ও সাজ সরঞ্জাম একেবারে ধ্বংস অথবা মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এখানে প্রকাশ যোগ্য যে, আশির দশকে সভিয়েত বিমান বাহিনীতে তৎকালীন সময়ের স্টেট আর্ট খ্যাত অত্যাধুনিক মিগ-২৯ ও এসইউ-২৭ এর মতো সুপার ম্যানুভার ফাইটার জেট থাকলেও, এগুলো যে কোন কারণেই হোক যুদ্ধে গেম চেঞ্জার হিসেবে একেবারেই কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে বা তার কথিত উচ্চ মাত্রায় প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রদর্শনে শোচনীয়ভাবে ব্যার্থ হয়েছিল।

যদিও যুদ্ধের একেবারে শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সহায়তায় আফগান মুজাহিদীন গেরিলাদের সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বিলিয়ন ডলারের বিপুল পরিমান হালকা যুদ্ধাস্ত্র ও সাজ সরঞ্জাম ধারাবাহিকভাবে সরবরাহ করতে থাকে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজ ইচ্ছামতো অস্ত্র ও সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখলেও মনে করা হয় আফগান যুদ্ধের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যয়ভার কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রবাশালী দেশ সৌদি আরব এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা বহন করতে থাকে। যার ফলে আফগান যুদ্ধে মার্কিন প্রশাসন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়। এদিকে আফগান যুদ্ধে মার্কিন প্রশাসন অস্ত্র সরবরাহের পাশাপাশি তাঁদের উচ্চ মাত্রার অত্যাধুনিক শতাধিক যুদ্ধাস্ত্র এবং সামরিক সাজ সরঞ্জাম প্রতি নিয়ত পরীক্ষা এবং গবেষণা করতে কোন রকম ত্রুটি রাখেনি। আবার মার্কিন সামরিক বাহিনীর সরবরাহকৃত হালকা বহনযোগ্য হিউম্যান প্রট্রেবল স্ট্রিংগার ক্ষেপনাস্ত্রের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও ব্যাপক ব্যবহার সভিয়েত বিমান বাহিনীতে এক ভীতিজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে এবং স্ট্রিংগার মিসাইল দ্বারা আফগান মুজাহিদীন গেরিলারা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অসংখ্য সভিয়েত বিমান এবং হেলিকপ্টার সফলতার সাথে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়।

অন্যদিকে যুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে আফগানিস্থানের যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা সভিয়েত সামরিক বাহিনীর হাজার হাজার সেনা এবং পাইলটের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন সভিয়েত কোয়ালিশন বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় এক রকম সুনিশ্চিত করে ফেলে। এক্ষেত্রে সভিয়েত সরকার শত চেষ্টা করেও তার পরাজয় এড়াতে পারেনি। যদিও এক সময় গোপনে আফগানিস্তানে পারমাণবিক অস্ত্র হামলার মাধ্যমে দেশটির একটি বড় অংশ ধ্বংস করে হলেও যুদ্ধে নিয়ন্ত্রণ নিজ পক্ষে নেওয়ার পরিকল্পনা করলেও মার্কিন শিবিরের শক্ত অবস্থান এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রবল আশাঙ্খায় সেই পথ থেকে সরে আসে সভিয়েত প্রশাসন।

তবে নয় বছরব্যাপী চলা আফগান যুদ্ধে সভিয়েত সামরিক বাহিনীর প্রায় বিশ হাজার সেনা ও বৈমানিক নিহত হয় এবং পাশাপাশি প্রায় ত্রিশ হাজারের অধিক সেনা সদস্য মারাত্মকভাবে আহত বা চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে আফগান পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি ছিল অত্যন্ত ভয়ানক পর্যায়ের। এ যুদ্ধে সরাসরি ২ লক্ষের অধিক আফগান মুজাহেদীন বা গেরিলা সদস্য মৃত্যুবরণ করে। আবার দেশটির আনুমানিক ১৩ লক্ষ সাধারণ ও নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। অথচ এই প্রাণহানির একটি বড় অংশ ছিল নারী, বৃদ্ধ ও শিশু। যাদের সাথে এই যুদ্ধের আদৌ কোন সম্পর্ক ছিল কিনা সন্দেহ।

দীর্ঘমেয়াদী এবং অত্যন্ত ভয়াবহ মাত্রায় প্রাণঘাতী এই যুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে ১৫ই ফেব্রুয়ারী ১৯৮৯ সালে তৎকালীন কমিউনিস্ট সভিয়েত ইউনিয়ন সরকার আফগান যুদ্ধের চুড়ান্ত সমাপ্তি ঘোষণা করে আফগানিস্তান থেকে তাঁদের সকল সৈন্য ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম সম্পূর্ণ ভাবে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। আর এর মাধ্যমে পতন হয় তৎকালীন সভিয়েত সমর্থীত আফগান নাজিবুল্লাহ সরকারের। এ যুদ্ধে জড়িয়ে সারা সভিয়েত ইউনিয়ন ব্যাপী এক মহা অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পতিত হওয়ার পাশাপাশি সারা দেশব্যাপী প্রশাসনিক পরিকাঠামো ও জাতীয় ঐক্য একেবারে ভেঙ্গে পড়তে থাকে। যার চূড়ান্ত ফলশ্রুতিতে ২৬শে ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে গোটা সভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে সম্পূর্ণ নতুন ১৫টি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের বুকে। এর সাথে চীর অবসান হয় এক ভীতিজনক ও দীর্ঘ মেয়াদী স্নায়ু যুদ্ধ (Cold war) যুগের।

দুই দশক ব্যাপী চলা ভয়াবহ যুদ্ধের ইতি টেনে অবশেষে ২০২১ সালে এসে আফগানিস্থান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো জোটের পলায়ন বিশ্বকে সেই বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে আফগানিস্থানে সভিয়েত ইউনিয়নের শোচনীয় পরাজয়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। আসলে আশির দশকে সংঘটিত অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী ও ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী একটি দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধ ছিল আফগান সোভিয়েত অসম যুদ্ধ। যুদ্ধটি সরাসরি কোন সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘটিত না হলেও বাস্তবিক অর্থেই এটি ছিল অত্যন্ত প্রাণঘাতী এবং মানবিক বিপর্যয়কর একটি যুদ্ধ। আর আফগানিস্থানে সভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক আগ্রাসনকে এ জন্য অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী যুদ্ধ বলা হয়, কারণ এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তির মাধ্যমে সারা বিশ্বে চলমান চার দশক ব্যাপী অত্যন্ত ভীতিজনক কোল্ড ওয়ার বা স্নায়ু যুদ্ধের চীর অবসান ঘটে। তাছাড়া এই যুদ্ধে তৎকালীন সভিয়েত কমিউনিস্ট সরকার ও তার লাল ফৌজ কিন্তু মার্কিন মদদে গঠিত একটি স্বল্প প্রশিক্ষিত আফগান গেরিলা বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে নেয়।#

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.