২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ পেন্টাগন সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল এফ-৩৫ জয়েন্ট স্টাইক ফাইটার প্রোগ্রাম থেকে তুরস্ককে চূড়ান্তভাবে বাদ দিয়ে দেয়। মুলত ১.১১৮ ট্রিলিয়ন ডলারের এফ-৩৫ স্টিলথ জেট ফাইটারের মাল্টিনেশন জয়েন প্রজেক্টে আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, নেদারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, কানাডা এবং নরওয়ের অংশিদ্বারিত্বের ভিত্তিতে ২০০৬ সালে চুক্তিবদ্ধ হয়। আর তুরস্ক এই প্রজেক্টে অংশগ্রহণ করে ২০০৭ সালের ২৬শে জানুয়ারি এবং শুরু থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আনুমানিক ২.০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে এবং চুক্তি মোতাবেক এই প্রজেক্ট থেকে ভবিষ্যতে পর্যায়ক্রমে ১০০টি এফ-৩৫এ সিরিজের স্টিলথ জেট ফাইটার পাওয়ার কথা ছিল তুরস্কের বিমান বাহিনীর। এজন্য তুরস্ক নিজস্ব প্রযুক্তির মিনি এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ার পর্যন্ত তৈরি করে ফেলেছে।
এফ-৩৫ স্টিলথ জেট ফাইটার প্রজেক্টে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য অন্যতম অংশীদার হলেও প্রযুক্তি এবং গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী হিসেবে নজিরবিহীনভাবে আলোচনায় উঠে আসে তুরস্কের নাম। চুক্তির ভিত্তিতে এফ-৩৫ জেট ফাইটারের গুরুত্বপূর্ণ ফিউসলেস, ল্যাণ্ডিং গিয়ার, ককপিট ডিসপ্লের বেশ কিছু উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্রাংশসহ প্রায় নয় শাতধিকের কাছাকাছি প্রযুক্তি, যন্ত্রাংশ এবং ডিভাইস তৈরি করত তুর্কী এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাবগুলো। তাছাড়া এখনো পর্যন্ত এফ-৩৫ এর গুরুত্বপূর্ণ এসওএম-জে স্ট্যাণ্ড অফ ক্রুজ মিসাইল এখনো পর্যন্ত তৈরি করছে যৌথভাবে তুরস্কের রকেটসান এবং মার্কিন লকহীড মার্টিন কর্পোরেশন।
তাছাড়া লকহীড মার্টিন কর্পোরেশন মার্কিন প্রশাসনের চাপে ও নির্দেশনায় তুরস্কের বিমান বাহিনির জন্য তৈরিকৃত ৮টি এফ-৩৫এ সিরিজের স্টিলথ জেট ফাইটার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে দিয়েছে। যার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৬২ মিলিয়ন ডলার এবং যা কিনা প্রাথমিকভাবে তুরস্কের নিজস্ব চাহিদা মাফিক কাস্টমাইজড করে তৈরি করা হয়েছিল। আর মার্কিন লকহীড মার্টিন কর্পোরেশন বছর খানেক আগেই তুরস্কের বেশ কিছু পাইলটের প্রশিক্ষণ শুরু করলেও রাশিয়া থেকে এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ের শাস্তি স্বরুপ মার্কিন প্রশাসনের নির্দেশে পরবর্তীতে তাদের তুরস্কে ফেরত পাঠিয়ে দেয় লকহীড মার্টিন কর্পোরেশন। অথচ ২০১৯-২০ সালের দিকে প্রথম ব্যাচে ৬-৮টি এফ-৩৫এ স্টিলথ জেট ফাইটার তার্কিস বিমান বাহিনীর হাতে হস্তান্তর করার কথা ছিল।
তবে এটা পরিস্কার যে, মার্কিন প্রশাসনের প্রবল বাধার মুখে রাশিয়ার এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ের বিরোধে জড়িয়ে তুরস্ক একেবারেই চূড়ান্তভাবে এফ-৩৫ প্রজেক্ট থেকে ছিটকে পড়ল। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাবি যে, তুরস্কের হাতে এফ-৩৫ তুলে দিলে তা শত্রুভাবাপন্ন দেশ রাশিয়ার তৈরি এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের মাধ্যমে এর গোপন প্রযুক্তি এবং তথ্য উপাত্ত সরাসরি রাশিয়ার হাতে চলে যেতে পারে।
এদিকে, মার্কিন এফ-৩৫ স্টিলথ জেট ফাইটার অপারেট করার জন্য তুরস্ক ২টি লাইট এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরি শুরু করে এবং একটি সম্পূর্ণভাবে তৈরি হয়ে এখন কমিশনিং এর অপেক্ষায় রয়েছে। যা হোক তুরস্ক রাশিয়ার এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় করে কতটা লাভবান হলো তা কিন্তু বেশ প্রশ্ন সাপেক্ষ। বর্তমানে তুরস্কের হাতে থাকা এস- ৪০০ কোন এখনো পর্যন্ত কোন কাজে ব্যাবহার করা হয়নি কিংবা নিরবিচ্ছিন্নভাবে এক্টিভ সম্পন্ন করেছে কিনা সন্দেহ।
ন্যাটো জোটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অংশীদার এবং জোটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সক্ষমতা সম্পন্ন দেশ হওয়ার সুবাদে তুরস্কের সামরিক বাহিনী প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অনেক আগে থেকেই যথেষ্ঠ শক্তিশালী এবং বিশ্ব মানের আধুনিক অবস্থায় রয়েছে বলা চলে। আবার তাদের নিজস্ব প্রযুক্তির এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং কমব্যাট এণ্ড নন-কমব্যাট ড্রোন (ইউএভি) ব্যাপকভাবে সিরিয়া ও লিবিয়ায় ব্যাবহার হওয়ায় তা কিন্তু বিশ্বের নজরে এসেছে। তাই হঠাৎ করেই রাশিয়ার এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ে তুরস্কের সিদ্ধান্তটি কতটা যৌক্তিক ছিল তা কিন্তু বেশ প্রশ্নবিদ্ধ একটি বিষয়।
এক্ষেত্রে তুরস্ক আগে তার বিমান বহরে সুনিদিষ্ট্য সংখ্যক মার্কিন এফ-৩৫এ/বি সিরিজের স্টিলথ জেট ফাইটার আগে ক্রয় করে পরবর্তীতে সুযোগ মতো রাশিয়ার এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় কিংবা সংগ্রহ করলে সেক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছুই করার থাকত না। আর এখন কিনা রাশিয়ার এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ের বিরোধে জড়িয়ে মার্কিন প্রশাসন তুরস্কের নিজস্বভাবে তৈরি এফ-১৬ জেট ফাইটার এবং টি-১২৯ এ্যাটাক হেলিকপ্টারের ইঞ্জিনসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি এবং যন্ত্রাংশ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপে কানাডা, জার্মানসহ পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশই তুরস্কের কাছে উচ্চ প্রযুক্তির সেন্সর, ইমেজিং সিস্টেম ইত্যাদি যন্ত্রাংশ সরবরাহ আপাতত স্থগিত করে দিয়েছে।
তবে খেয়াল করার মতো একটি বিষয় হলো যে, তুরস্কের বিমান বাহিনীতে ২৪৫টি এফ-১৬ জেট ফাইটার এবং ষাট ও সত্তরের দশকের ৪৮টি এফ-৪ (নতুন করে আপগ্রডেডকৃত) যুদ্ধবিমান ব্যাতিত আর কোন কমব্যাট এয়ার ক্রাফট নেই। তবে তুরস্কের কাছে বায়কার মাকিনার তৈরি ১২০টি বায়রাক্তার টিবি-২ কমব্যাট ড্রোন এবং তুর্কী এ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজের তৈরি ৩০টি আনকা-এস কমব্যাট ড্রোনসহ ৫০০টি এর কাছাকাছি ছোট বড় মিলিয়ে রিকর্নিয়েন্স এণ্ড স্পাই ড্রোন (ইউএভি) রয়েছে। আবার নিজস্ব প্রযুক্তির নতুন প্রজন্মের জেট ফাইটার সার্ভিসে আসতে ২০২৮-৩০ সাল পর্যন্ত তুরস্ককে অপেক্ষা করতে হতে পারে।
তুরস্ক তার নিজস্ব বিমান বাহিনীকে আগে যথেষ্ট আকারে আধুনিক এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক উন্নত মানের যুদ্ধবিমান সংগ্রহ না করেই রাশিয়ার এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ের ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিরোধে জড়িয়ে দেশটি কার্যত নিজেকেই নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে সিরিয়া, লিবিয়া এবং আজারবাইজান-আর্মেনীয় যুদ্ধের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তুরস্কের মূল প্রতিপক্ষ কিন্তু রাশিয়া এবং এক্ষেত্রে যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়াকে পরোক্ষভাবে হলেও প্রতিহত করে যেতে হচ্ছে তুর্কী এরদোয়ান সরকার আর তার সামরিক বাহিনীকে। যা ভবিষ্যতে যে কোন মুহুর্তে রাশিয়ার সাথে তুরস্কের বড় ধরণের যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত বহন করে।#