ইউক্রেনের সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে রাশিয়া নজিরবিহীনভাবে লক্ষাধিক সেনা, হাজার হাজার ট্যাংক, এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, আর্টিলারি ইউনিট এবং ভারী সামরিক যান মোতায়েন সম্পন্ন করেছে। পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়ায় আশাঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, রাশিয়া যে কোন মুহুর্তে ইউক্রেনে ভয়াবহ সামরিক আগ্রাসন বা হামলা শুরু করতে পারে। তবে যে কোন মূল্যে রাশিয়ার এই সামরিক আগ্রাসন রুখে দিতে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, তুরস্ক এবং কানাডার মতো দেশগুলো রাশিয়ার প্রবল আপত্তি ও প্রতিবাদ উপেক্ষা করে এখন এক রকম প্রকাশ্যেই ইউক্রেনে ব্যাপকভাবে অস্ত্র ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম পাঠাতে শুরু করে দিয়েছে।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার দোসর পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো অনেক আগে থেকেই রাশিয়াকে হুমকি দিয়ে আসছে যে, ইউক্রেনে যে কোন অজুহাতে সামরিক আগ্রাসন চালালে রাশিয়াকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি করুন পরিণতি ভোগ করতে হবে। যদিও এহেন জটিল আকারের যুদ্ধ পরিস্থিতির মুখে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা ছাড়া আর কতোটা সহায়তা করতে পারবে ইউক্রেনকে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থেকেই যাচ্ছে। মুলত পশ্চিমা বিশ্বের সামরিক ন্যাটো জোটের ইউক্রেনে ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তারকে রাশিয়া তার অস্তিত্বের জন্য চরম হুমকী হিসেবে মনে করে। এ নিয়ে মিডিয়ায় রাশিয়ার পুতিন প্রশাসন বার বার চরম অসন্তোষ প্রকাশ করার পাশাপাশি রাশিয়া সাফ জানিয়ে দিয়েছে পূর্ব ইউরোপে রাশিয়া সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে ন্যাটো জোটের প্রভাব বিস্তার এবং সম্প্রসারণকে কোন ভাবেই মেনে নেবে না তারা।
আপাতত দৃষ্টিতে ইউক্রেন সীমান্ত অঞ্চলে চরম সংকটময় যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করলেও বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে রাশিয়া কিন্তু ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালাতে মোটেও প্রস্তুত নয়। বরং কৌশলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বা প্রবল চাপ সৃষ্টি করে ইউক্রেনকে পশ্চিম বিশ্বের প্রভাব বলয় থেকে বের করে আনতে চায় রাশিয়া। তাছাড়া রাশিয়া চায় ইউক্রেন যেন কোন অবস্থাতেই ন্যাটোজোটে যোগদান না করুক। এদিকে সুকৌশলী পুতিন প্রয়োজনে সামরিক অভিযান চালিয়ে হলেও ইউক্রেনে তার অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
আমেরিকার গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে যুক্তরাজ্য কিন্তু আকাশ পথে জার্মানির সীমা এড়িয়ে প্রায় ২০ হাজার স্বল্প পাল্লার অত্যাধুনিক জ্যাভলিন এন্টি- ট্যাংক মিসাইল এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সিক্রেট ডিফেন্স ডিভাইস ইউক্রেনে পাঠিয়েছে। এদিকে তুরস্ক থেকে ইতোমধ্যেই শতাধিক কমব্যাট, রিকর্নিসেন্স এন্ড স্পাই ড্রোন সংগ্রহ করেছে ইউক্রেন। তাছাড়া বর্তমানে শতাধিক আমেরিকান, তুর্কী এবং যুক্তরাজ্যের সামরিক উপদেষ্টা ও বিশেষজ্ঞ গোপনে ইউক্রেন সামরিক বাহিনীকে পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করার জন্য অবস্থান করছে দেশটিতে। যা কিনা অদূর ভবিষ্যতে ইউক্রেনকে যুদ্ধের ময়দানে আকাশ ও স্থল পথে নিশ্চিতভাবেই কৌশলগত সুবিধা দিবে এবং রাশিয়ার সামরিক বহরের জন্য একটি বড় ধরনের বিপর্যয় বা ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে।
তবে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো জোটের অন্যতম সদস্য দেশ জার্মানি কিন্তু রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে সরাসরি অবস্থান নিতে এবং ইউক্রেনে সামরিক সহায়তায় অংশ নিতে অস্বীকার করে আসছে। তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে, জার্মান কোন অবস্থাতেই ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ করবে না। যদিও জার্মান প্রশাসনের এই অস্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য এখন তার ইউরোপীয় মিত্র ও তার ন্যাটো জোটের কাছ থেকে প্রবল চাপের মুখে রয়েছে।
ইউক্রেনে যে কোন অজুহাতে সামরিক আগ্রাসন শুরু করলে রাশিয়ার ওপর এ যাবতকালের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ২০২১ সালের শুরুতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার এক বছর পূর্তিতে এক ভাষণে রাশিয়াকে সরাসরি হুঁশিয়ারি দেন মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট। ইউক্রেনের দিকে আর এক পাও না বাড়াতে সতর্ক করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও। এদিকে মার্কিন বাইডেন প্রশাসন ২০২২ সালের নতুন সামরিক বাজেটে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তার জন্য ২০০ মিলিয়ন ডলারের এক বিশেষ প্রতিরক্ষা সহায়তা ফান্ড অনুমোদন দিয়েছে এবং রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালালে প্রয়োজনে যে কোন আপদকালীন মুহুর্তে ইউক্রেনকে বড় ধরনের সামরিক সহায়তার পাশাপাশি ট্যাংক ও ভারী অস্ত্র সরবরাহের স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে আমেরিকা।
তাই পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর সামরিক সহায়তার আশ্বাসে রাশিয়ার সাথে সম্ভাব্য ভয়াবহ যুদ্ধ কিংবা সামরিক আগ্রাসনের কথা মাথায় রেখে ইউক্রেনের পশ্চিমা পন্থী সরকার সাম্প্রতিক সময়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম ক্রয় বা সংগ্রহ করে যাচ্ছে। আর এই সামরিক কেনাকাটার তালিকায় রয়েছে কমব্যাট, রিকর্নিসেন্স এণ্ড স্পাই ড্রোন, সারফেস টু এয়ার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম, এন্টি-ট্যাংক মিসাইল, যুদ্ধের ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, জ্যামার, রাডার এবং সাইবার প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রয়েছে। এছাড়া ইউক্রেন ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ব্যালেস্টিক এবং ক্রুজ মিসাইল ক্রয়ের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করছে। যেগুলো একই সাথে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। তাছাড়া রাশিয়ার সাথে চলমান সামরিক উত্তেজনার মুখে ইউক্রেন সাম্প্রতিক সময়ে কয়েক দশক আগে অবসরে পাঠিয়ে দেয়া সভিয়েত আমলের এস-১২৫ মিডিয়াম রেঞ্জের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম আবারো নতুন করে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিতে মোতায়েন সম্পন্ন করেছে। তাই ২০১৩/১৪ সালের মতো কৌশলে ক্রিমিয়া দখলের মতো বর্তমানে ইউক্রেনে সামরিক হামলা করাটা রাশিয়ার জন্য মোটেও সহজ কিছু যে হবে না তা কিন্তু এক রকম নিশ্চিত বলা চলে।
পূর্বের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ১৯৯১ সালে তৎকালীন পরাক্রমশালী সভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে তাদের অস্ত্র ভাণ্ডারে থাকা ১০ হাজারের কাছাকাছি নিউক্লিয়ার এণ্ড থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ারহেড বা অস্ত্রের একটি অংশ ইউক্রেন এবং কাজাখাস্থানের হাতে থেকে যায়। তবে সভিয়েত ইউনিয়নের এই পারমাণবিক অস্ত্রের ৮০% পর্যন্ত রাশিয়ার নিজ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তখন ইউক্রেনের অধিকারে মোট ১,৯০০টি নিউক্লিয়ার অস্ত্র ও ওয়ারহেড, ১৭৬টি ইন্টারকন্টিন্যান্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল এবং ৪৪টি স্ট্যাটিজিক বোম্বার বিমান ছিল। যা কিনা দেশটিকে সেই সময়ে বিশ্বের বুকে তৃতীয় সর্বোচ্চ কৌশলগত নিউক্লিয়ার অস্ত্রের অধিকারী দেশে পরিণত করেছিল। অবশ্য কাজাখাস্তানের কাছে খুব সম্ভবত ২৩০টি নিউক্লিয়ার অস্ত্র থেকে গেলেও তারা পরবর্তীতে স্বেচ্ছায় দেশগুলো সকল অস্ত্র ধ্বংস করে কিংবা রাশিয়ার হাতে তুলে দেয়।
তাই ইউক্রেনের বর্তমান এই ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য ইউক্রেন নিজেই কিন্তু কিছুটা দায়ী হয়ে যায়। আর ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলারের অর্থিক সহায়তা পাওয়ার আশায় ১৯৯১ সালে সভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করার পর পরই ইউক্রেন তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সকল নিউক্লিয়ার অস্ত্র জাতিসংঘের সহায়তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে ধ্বংস কিংবা অন্য কারো কাছে হস্তান্তর করে দেয়। তাদের হাতে থাকা সকল ধরণের ইন্টারকন্টিন্যান্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা হয়। আর তাদের বহরে থাকা ৪৪টি বোম্বার অযত্ন এবং নিয়মিত রিপিয়ার মেইন্টেনেন্সের অভাবে চীর দিনের মতো গ্রাউন্ডেড বা অকেজো হয়ে খোলা আকাশের নিচে পরে থাকে এবং ভাগে পাওয়া হাজার হাজার মেইন ব্যাটল ট্যাংক এখনো পর্যন্ত খোলা মাঠে অকেজো হয়ে জং ধরে এখনো পর্যন্ত অবহেলায় পড়ে রয়েছে।
আর আজ যদি ভবিষ্যতের রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের কথা চিন্তা করে ইউক্রেন তার হাতে থাকা নিউক্লিয়ার অস্ত্রের মাত্র ১০-২০% গোপনে হলেও সংরক্ষণ করত, তাহলে রাশিয়া তো দূরের কথা বিশ্বের কোন দেশই ইউক্রেনের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পেত কিনা সন্দেহ এবং রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন ও শোচনীয় অবস্থা তাদের দেখতে হতো না। সেই সময়ে মাত্র ২ কিংবা ৩ বিলিয়ন ডলারের অর্থিক সহায়তা বা ঋণ প্রাপ্তির আশায় এবং নিজেকে শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে প্রমাণ করতে গিয়ে ইউক্রেন আসলে অতীতে যা করেছে তার জন্য কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিণতি বরণ যে করতে হবে না তা কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়।#