--- বিজ্ঞাপন ---

লতামঙ্গেশকরঃ বিদায় কিংবদন্তি।।

0

কাজী ফেরদৌস, অতিথি লেখক #

অবশেষে বার্ধক্য জনিত অসুস্হতা আর সাথে করোনার কাছে হার মেনে চলে গেলেন উপমহাদেশের মেলোডি কুইন খ্যাত কিংবদন্তীর কণ্ঠ শিল্পী লতামঙ্গেশকর স্বয়ং পণ্ডিত নেহেরু যাকে ভারতের নাইটিংগেল বলে নাম দিয়ে ছিলেন।আসলেই ভারতের চলচিত্র জগতে দিলীপ কুমার যদি কিং অব ট্রাজেডি হয়ে থাকে তবে লতাকে বলাযায় কুইন অব মেলোডি।লতা কে দিলীপ মেরে ছোটাসে এক বহেন বা ছোট বোন বলেই সম্বোধন করতেন।এবং দেখা হলেই দিলীপ কুমার এর পদ ধুলি নিতেন লতাজী।

১৯৭৪ সালে আলবার্ট হলে লতামাঙ্গেশকর এর লাইভ কন্সার্টে লতা কে দিলীপ কুমার উপস্থাপন করে বলেছিলেন, ফুলের খুশবুর যেমন কোন রং থাকে না বা তাকে দেখা যায় না শুধু অনুভব করা যায়, পাহাড় থেকে নেমে আসা উচ্ছল ঝর্ণার বা ভোরের ঠান্ডা হাওয়ার যেমন কোন স্থান কাল দেশ বা ভৌগোলিক সীমারেখা থাকে না, শিশুর মুখের মিষ্টি হাসির বা সকালের সূর্য কিরণের যেমন কোন মাজহাবী সীমাবদ্ধতা থাকে না লতামঙ্গেস করের কণ্ঠ তেমনি বিধাতার এক অনন্য সৃষ্টি যার কোন ভৌগোলিক সীমা রেখা নেই , এক বেমেছাল কুদরতি ক্যারিসমা যার কোন তুলনা হয়না। দিলীপ কুমার এর কথামালা গুলো ছিল অসাধারণ কাব্যিক উর্দুতে। অন্য কোন ভাষায় তার সৌন্দর্য্য প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব। তেমনি লতার কণ্ঠ মাধুর্যের তুলনা করা বা বর্ননা করাও এক অসম্ভব কাজ।একমাত্র কোন প্রতিভাবান কবির কবিতায় হয়তো তা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। আমার মতো অর্বাচীনের পক্ষে সেটা এক অসাধ্য সাধন। কবি ও সুরকার জাভেদ আখতার বলেছিলেন যদি বিশ্বের সব সুগন্ধি, সব চাঁদের আলো আর সমস্ত মধু এক করা হয় তারপর ও লতামঙ্গেশ করের কণ্ঠের মতো কিছু তৈরি হবে না। মান্না দের কথা লতার কণ্ঠে নাকি ইশ্বর বাস করেন।কথাটা আমার মনে ধরেছে। অন্তত সত্যম শিবম সুন্দরম গানটিতে যে ঐশ্বরিক আবেশ তিনি সৃষ্টি করে ছিলেন যা একধরনের নিবিষ্টতা ও মগ্নতা সৃষ্টি করে শ্রোতার হৃদয়ের গহীন কোনে।
লতার গানের সাথে আমার পরিচয় খুব ছোট বেলা থেকে। সেই কবে নাগিন ছবির গান শুনেছিলাম ছোট বেলায় – তন ডোলে মেরা মন ডোলে….ঠিক মনে নেই। পরে জেনেছিলাম গানটির সংগীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত কুমার।লোকমুখে গল্প প্রচলিত হয়েছিল যে গানটি শুরু হলে নাকি অনেক সময় সিনেমা হলে সাপ ঢুকে যেতো। তাই ওসময় দর্শকরা পা সিটের উপর উঠিয়ে রাখতেন। আসলে সবই গালগল্প। লতার গানের সাথ ভালো করে পরিচয় হয়েছিল ১৯৬০ সালে আমার এক ভাবি মিসেস কামাল এর গ্রামোফোন রেকর্ডের মাধ্যমে। সেই প্রথম তাঁর বাংলা গান শুনলাম – প্রেম একবার এসেছিল নীরবে,এবং ও পলাশ ও শিমুল কেন এমোর মন রাঙালে…এর পর মুগলে আজম ছবির কালজয়ী গান — পেয়ার কিয়াতো ডর না ক্যায়া।চট্টগ্রাম শহরের অলিগলি চায়ের দোকানে, মাইকের দোকানে বিয়ের অনুষ্ঠানে সারাক্ষণ শুনা যেত সেই যাদুকরী কণ্ঠ। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই গান।১৯৬৩ কি ১৯৬৪ সালে আশোক কুমার – মধুবালা অভিনিত পরিচালক কামাল আমরোহীর প্রথম ছবি মহল দেখে ছিলাম উজালা সিনেমা হলে।অতিপ্রাকৃত গল্প নিয়ে বম্বের চিত্র জগতে সেটাই নাকি প্রথম ছবি।সেই ছবির জন্য ১৯৪৯ সালে রেকর্ড করা তাঁর গাওয়া সেই গান আয়েগা আয়েগা আয়েগা! আয়েগা আনে ওয়ালা… আমার হৃদয় ছুৃঁয়ে গিয়েছিল। শুধু গানঠি এবং সিনেমার দৃশ্য টি এবং মধু বালার রূপের ঝলক দেখার জন্য ছবিটি দুবার দেখেছিলাম। এবং সেই গানটিই তাঁকে হিন্দি ছবির জগতে প্রথম খ্যাতি এবং প্রতিষ্ঠাদুটোই এনে দিয়েছিল বলে সবাই স্বীকার করে থাকেন ।
১৯২৯ সালে জন্ম নেয়া লতার জীবন ছিল প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য সংগ্রামের।মারঠায় জন্ম নেওয়া অভিনয় শিল্পী দীন নাথ মঙ্গেশকর এর এর প্রথম সন্তান লতা অল্প বয়সে রোজী রোজগারের ধান্দায় নামতে হয়েছিল পিতার সাথে।প্রথমে মারাঠি ছবিতে ছোট খাটো অভিনয়ের মাধ্যমে।তবে অভিনয় তাঁর ভালো লাগেনি তেমন। তাই সংগীতেই থিতু হয়ে ছিলেন অবশেষে। তাঁর মাত্র তের বছর বয়সে ১৯৪২ সালে পিতার মৃত্যু হলে পিতৃবন্ধু বিনায়ক দামোদর তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪৫ সালে বিনায়ক দামোদর এবং লতাজী বম্বে চলে আসেন। বম্বেতে এসে ওস্তাদ আমীর আলীর কাছে সঙ্গীতে তালিম নেওয়া শুরু করেন। প্রথমে ভজন টুমরি ধরনের গান করতেন।তবে ১৯৪৮ সালে বিনায়ক দামোদর এর মৃত্যু হলে সংগীত পরিচালক গোলাম হায়দার তাঁর মেন্টর হিসেবে দায়িত্ব নেন।গোলাম হায়দার লতার প্রতিভা বিকাশের ব্যাপারে বেশ আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন। তবে হিন্দি গানের জগতে তখন প্রতিষ্ঠা পাওয়া বা জায়গা করে নেওয়া ছিল কঠিন ব্যাপার। কারণ তখন নুর জাহান সুরাইয়া বিশেষ করে সামসাদ বেগমের মতো দাপুটে শিল্পীরা বম্বের সঙ্গীত জগতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন। তদুপরি প্রথম দিকে তাঁর কণ্ঠ ছিল একবারে হালকা ধরনের । তাই বম্বের নামকরা প্রযোজক শশধর মুখার্জি তাঁকে দিয়ে গান রেকর্ড করার ঝুঁকি নিতে রাজি হচ্ছিলেন না।ক্ষুব্ধ গোলাম হায়দার তখন বলেছিলেন এমন একদিন আসবে যখন সংগীত পরিচালকরা লতার পায়ের কাছে হুমড়ি দিয়ে পড়ে থাকতে হবে। ঠিক হয়েছিল ও তাই। প্রথম দিকে তাঁকে প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে নিতে শশধর মুখার্জির মতো অনেক সংগীত পরিচালক এর অনীহা ছিল তাঁর হালকা কণ্ঠস্বরের কারণে।তাঁকে সবাই সামসাদ বেগমের মতো করে গাইতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে প্রথম জীবনে তিনি নুর জাহান কে অনুকরণ করতেন বলে নিজেই স্বীকার করে ছিলেন। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের কারণে নুরজাহান পাকিস্তান চলে গেলে একটা শুন্যস্হান তাঁর জন্য সৃষ্টি হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালে মজবুর ছবিতে প্লেব্যাক করে তিনি প্রথম লাইম লাইটে আসতে সক্ষম হন।এরপর আসে ১৯৪৯ সালের মহল ছবির সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কামাল আরোহী পরিচালিত আশোক কুমার মধু বালা অভিনীত এই ছবিতে মধুবালার লিপ্স দেওয়া তাঁর গান আয়েগা… আয়েগা .. আয়েগা আনে ওয়ালা! তাঁকে একেবারে রাতারাতি তারকা খ্যাতিনএনে দেয়। এরপর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তদুপরি তখনকার খ্যাতিমান সংগীত তারকা সামসাদ বেগম প্রতিটি গানের জন্য সর্বোচ্চ পঞ্চাশ হাজার টাকা পারিশ্রমিক নেওয়া শুরু করলে প্রযোজক পরিচালকরা বিকল্প খুঁজতে শুরু করে এবং হাতের কাছে পেয়ে যায় লতামঙ্গেশকরকে।তাঁকে পাঁচ হাজার টাকা গান প্রতি পারিশ্রমিক দিয়ে কাজ করাতে শুরু করেন।ধীরে ধীরে সামশাদ বেগম এবং সমসাময়ীক সবাই কে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে থাকেন লতামঙ্গেসকর।তবে ১৯৬০ সালে মুক্তি প্রাপ্ত সর্বকালের সেরা ব্লকবাস্টার ছবি মোগলে আজম মুক্তি পেলে লতার কণ্ঠে গাওয়া মধু বালার লিপ্স দেওয়া গান পেয়ার কিয়াতো ডরনা ক্যায়া.. জনপ্রিয়তার সকল রেকর্ড একেবারে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।ততদিনে লতামঙ্গেসকার হয়ে যায় একবারে যাকে বলে হাউসহোল্ড নেম। তবে অনেক সংগীত পরিচালক লতার উর্দু হিন্দি উচ্চারণ নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি তখন তাঁর মারাঠি একসেন্ট এর কারণে। অভিযোগকারীদের অন্যতম তখনকার জনপ্রিয় অভিনেতা দিলীপ কুমার ও ছিলেন। অবশ্য ভারতের চিত্র জগতের প্রথম দুই তিন দশক ছিল উর্দু কবি লেখকদের আধিপত্য। বেশির গানের কথায় তখন উর্দু শব্দের আধিক্য ছিল লক্ষনীয়।ফলে লতাকে বেশ কিছু দিন উর্দু ভাষার তালিম ও নিতে হয়েছিল।
পঞ্চাশের দশক থেকে ষাটের দশক এমনকি সত্তর আশির দশক পর্যন্ত তিনি দোর্দন্ডপ্রতাপে শাসন করেছেন একচ্ছত্র ভাবে ভারতের সংগীত জগৎ। পরবর্তী সময়ে তাঁর বোনআশাভোঁসলে,গীতাদত্ত সহ অনেক নুতন শিল্পী এগিয়ে আসলে তিনি আস্তে আস্তে লাইম লাইট থেকে সরে আসতে থাকেন।তিনি নিজেও পাশ্চাত্য রীতির গান ক্যাভারে ডান্সের গান বা কোন অশ্লীল ভাব ধারার গান গাইতে রাজি ছিলেন না।এব্যাপারে তিনি ছিলেন একেবারে আপোষহীন।তাই আস্তে আস্তে তাঁর জায়গা বেদখল হতে শুরু করে। তবে তাঁর মতো একাধারে সাত দশকের বেশি সময় ভারতের সংগীত জগতে আর কেউ আলো ছড়াতে পেরে ছিল কি?অনেকে মনে করেন লতার চেয়েও ভারসেটাইল গীতা দত্ত অকালে ঝরে না পরলে তিনি বিনা চ্যালেঞ্জে এতটা এগিয়ে যেতে সক্ষম হতেন কিনা সন্দেহ আছে।
তবে তাঁর বিরুদ্ধে নবাগত সংগীতশিল্পীদের বিরুদ্ধে অসহনশীল আচরণের অভিযোগ ও আছে এমনকি আপন ছোট বোন আশা ভোঁসলেকেও নাকি তিনি সহ্য করতে পারতেন না।এবং তাঁর বিকাশের পথে অনেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ছিলেন বলে অভিযোগ আছে। তবে আশার ভারসেটাইল প্রতিভা এবং তাঁর রকএন্ড রোল কণ্ঠ একসময় লতাকে ও ছাড়িয়ে যায়। তবে এধরনের অসহিষ্ণুতার অভিযোগ উপমহাদেশের আরো অনেক বড় শিল্পীর বিরুদ্ধে ও আছে। যেমন পাকিস্তানের নুর জাহান ও উঠতি গায়িকা রুনা লায়লাকে ও বয়কট করতে চিত্র প্রযোজক ও সংগীত পরিচালকদের বাধ্য করে ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রুনা কে আটকাতে পারেন নি।যেমন লতাও পারেন নি তাঁর বোন আশা বা ঊষা কে আটকাতে। তবে আশার পরিবারের প্রতি দায়িত্বহীন আচরণে লতাজী ক্ষুব্ধ ছিলেন।লতা যখন একা পরিবারের সব দায়িত্ব পালন করছিলেন আশা অনেকটা অবিবেচক এর মতো সংগীত পরিচালক ভোঁসলের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিলেন। যেই কারণে আশা কে তিনি কখনো ক্ষমা করতে পারেন নি। তবে সিনেমা বলুন সংগীত বলুন সবখানে একধরনের কার্টেল প্রথা বা রাজনীতি থাকে। এটা সর্বকালের বৈশিষ্ট্য। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন শামশাদ বেগম।তিনি একসময় নিজেই নুতনদের জন্য পথ ছেড়ে সরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শামশাদ এবং লতা একসঙ্গে মোগলে আজম ছবিতে গান করে ছিলেন। তবে সেখানে ও লতার আধিপত্যের বিষয় টি ছিল স্পষ্ট। তিনিই ছিলেন এই ছবির লিড গায়িকা।
এর পর এমন কোন হিন্দি ছবি ছিল না যেখানে লতার কণ্ঠ ছিল না।পঞ্চাশ দশক থেকে শুরু করে হাল আমলের মাধুরি দীক্ষিত ঐশ্বরিয়া কে বাদ গেছে তাঁর গাওয়া গানে লিপ্স দেওয়া থেকে? বম্বে ছবির অনেক নায়িকা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন তাঁর গানের কারণে। লতার গানের সাথে লিপ্স দিতে পারা ছিল সর্বসময়ে সব শিল্পীর জন্য আত্মশ্লাঘার বিষয়। পুরনো দিনের সেসব নায়িকা নার্গিস মধুবালা,বৈজয়ন্তী মালা, মালা সিনহা, আশা পারেখ হেমা মালিনী কার কথা ভোলা যায় যারা লতার গানের কারণে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন? এমন কোন সুরকার গীতিকার কি ছিল তাঁর জন্য গান লিখেন নি বা সুর করেন নি? সেই নওশাদ আলী সাকিল বদায়ুনী লক্সমীকান্ত পেয়ারে লাল সাহির লুধিয়ানভী,হসরত জয়পুরী, সংকর জয়কিসান কে বাদ ছিল? তাঁর সাথে ডুয়েট কণ্ঠ দেয়নি এমন কেউ ছিল কি? সেই মোহাম্মদ রফি মুখেশ হেমন্ত তালাত মাহমুদ থেকে শুরু করে পরবর্তী জেনারেশন এর প্রায় গায়ক গায়িকা কেউ কি বাদ ছিল?
তাঁর গানের তাঁর কণ্ঠের ভক্ত উপমহাদেশের বাইরে ও লক্ষ কোটি সংগীত পিপাসু মানুষ আছে। তেমনি একজন ভক্ত ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু।১৯৬২ সালের চীন ভারত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গাওয়া তাঁর দেশাত্মবোধক গান আয় মেরে ওয়াতন কে লো গোঁ যখন স্টেজ শো তে তিনি গেয়েছিলেন নেহেরু চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন নি তাঁর কণ্ঠের আবেগের কারণে। তাঁর গানের অনুপ্রেরণা থেকে পঁয়ষট্টি সালের পাক ভারত যুদ্ধের পরে পাকিস্তানের নুর জাহান ও এক কালজয়ী অমর গান করে ছিলেন – হ্যায় ওয়াতান ক সজীলে জওয়ানো
মেরে নাগমে তোমহারে লিয়ে “!
লতা মঙ্গেশকার কত গান করে ছিলেন তার সঠিক হিসাব নেই । হিন্দি বাংলা মিলিয়ে ভারতের ছত্রিশ ভাষায় তাঁর গাওয়া গান একসময় দশ হাজার বলে দাবী করে। সর্বাধিক গানের একক রেকর্ড হিসেবে গীনেজ বুকে তাঁর নাম রেকর্ড করলে ভারতের আরেক সংগীত কিংবদন্তী মোহাম্মদ রফি চ্যালেঞ্জ করে বলেন, তিনি লতার ছেয়ে অনেক বেশি গান রেকর্ড করেছেন। শেষ পর্যন্ত গিনেস কর্তৃপক্ষ লতার নাম সরিয়ে ফেলেন। তবে তাঁর ছোট বোন আশা ভোঁসলে বার হাজার গান গেয়ে গিনেস রেকর্ডে নাম লেখাতে পেরেছেন বলে জানা যায়।
তবে সর্বশেষ তথ্য মতে লতা প্রায় সাড়ে সাত হাজার গান রেকর্ড করেছেন বলে ধারনাকরা হয়।
লতার বাংলা গানে অভিষেক হয় ১৯৫৬ সালে সতীনাথের সংগীত পরিচালনায় আকাশ প্রদীপ জ্বেলে দুরের তারার পানে চেয়ে গানটির মাধ্যমে। তবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সলিল চৌধুরীর হাত ধরে তিনি এগিয়ে যান বাংলা গানে। প্রখ্যাত গীতিকার ও সুরকার সলিল চৌধুরী তাঁকে বাংলা ভাষায় গানের তালিম দিয়ে এমন পরিশুদ্ধ করে নিয়ে ছিলেন যে যাকে বলাযায় একেবারে নিখুঁত। তাঁর বাংলা গান প্রায় একশত সত্তর বা কমবেশি। আমাদের জেনারেশন বা পরবর্তী জেনারেশন কি কখনো ভুলতে পারবে সেই কালজয়ী গান আষাঢ় শ্রাবণ মানে নাকো মন অথবা না যেওনা রজনী এখনো বাকি, নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখিরা বুঝিবা পথ ভুলে যায় অথবা সাত ভাই চম্পা জাগরে জাগ সহ অসংখ্য মন মাতানো স্মৃতি জাগানিয়া গান?
লতা মাঙ্গেসকর চির কুমারী ছিলেন! কেন ছিলেন সেটা ছিল রহস্য ঘেরা মিলিয়ন ডলার একটা প্রশ্ন। প্রথম দিকে বলা হতো অল্প বয়সে সংসার এর হাল ধরে তরি বাইতে বাইতে কখন বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে তিনি বুঝতেই পারেন নি। প্রচলিত ধারণায় খুব সুন্দরী নাহলেও তিনি মিষ্টি সুশ্রী সুন্দর চেহারার এক তরুণী ছিলেন। ছিলেন এক কিংবদন্তী গায়িকা। তাঁকে কি একেবারে অগ্রাহ্য করা কারে পক্ষে সম্ভব ছিল? তাঁর গাওয়া বাংলা গান —
প্রেম একবার এসেছিল নীরবে
আমারই দুয়ার ও প্রান্তে
সেত হায় মৃদু পায় এসেছিল
পারিনি তো জানতে …..
অনেক টা তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনের ট্রাজেডির প্রতিধ্বনির মতো শুনতে মনে হয়েছিল কি?প্রথম জীবনে সুদর্শন রোমান্টিক উর্দু কবি ও গীতিকার সাহির লুধিয়ানভীর সাথে গভীর প্রেমে মজে ছিলেন বলে শুনা যায়। সাহির লুধিয়ানভীর জন্ম পাঞ্জাবের লুধিয়ানায়। তিনি কিছু দিন পাকিস্তানের লাহোরে বসবাস করেন । তবে বাম ধারার রাজনীতি করায় এবং প্রকাশ্যে কমুনিজম সমর্থন করার কারনে ১৯৫৯ সালে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হন এবং বম্বে শহরে থিতু হন।তিনি একজন রোমান্টিক কবি ও গীতিকার হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি ও লতাজী দুজনেই নাকি প্রেমে মজে ছিলেন। সাহির লুধিয়ানভীর লেখা বহু গানের কণ্ঠ শিল্পী ছিলেন লতা। পরে একসময় ভুল বুঝাবুঝি থেকে পরস্পর বয়কট এবং বিচ্ছেদ।কারণ ছিল দুজনের ব্যক্তিত্বের সংঘাত এবং উন্নাসিকতা ।লতার প্রমিকার তালিকায় আরো আছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং অহমীয়া গায়ক ভূপেন হাজারিকাও। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রয়াত সভাপতি একসময়ের ক্রিকেট খেলোয়াড় রাজ সিং দুঙ্গারপুরের নাম ও শুনা যায় সব চেয়ে বেশি। রাজসিং ছিলেন লতার ছোট ভাই হৃদয় নাথের ঘনিষ্ট বন্ধু। হৃদয় নাথ ও ক্রিকেট খেলতেন।দুজনের সাক্ষাত হতো হৃদয় নাথের বাসায়। এক সময় রাজসিং আর লতার মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয় যা পরে গভীর প্রেমে রূপ নেয়। তবে রাজ সিং ছিলেন রাজস্হানের দুঙ্গারপুর রাজপরিবারের সন্তান। তাঁর পিতা রাজ পরিবারের বাইরে সাধারণ পরিবারের কাউকে পুত্র বধু হিসেবে মেনে নিতে অনীহা প্রকাশ করায় সম্পর্ক আর বেশী দুর এগুতে পারে নি।তবে রাজসিং চিরকুমার থাকার সিদ্ধান্ত তার পরিবার কে জানিয়ে দেন। লতা মঙ্গেশকর ও কুমারী থাকার সিদ্ধান্ত নেন।তাঁরা আজীবন বন্ধু ছিলেন। যে কারণে লতা আর বিয়ে কিম্বা সংসার ধর্ম পালনের কথা ভাবেন নি।রাজসিং দুহাজার দশ সালে মৃত্যু বরন করেন। তবে ভূপেনের সাথে মাখামাখি ছিল নাকি সবচেয়ে বেশি। তবুও কেন জানি মিডিয়ায় তাঁর নামে তেমন কোন স্ক্যান্ডাল ছড়ায় নি।হয়তোবা কোথাও তাঁর জন্য মিডিয়ার একটা শ্রদ্ধাবোধ বা সহমর্মিতা বা সহনশীলতার একটা জায়গা ছিল। নাহয় তাঁর প্রেম কাহিনি তো একেবারে গোপনীয় কিছু ছিল না।
প্রেম ভালো বাসা সংসার ধর্ম এসব প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে যেতেন সচরাচর। বলতেন সংগীতই আমার প্রেম ভালোবাসা।
তাঁর জীবন যাপন ছিল একেবারে সাদাসিধে।লাল পাড়ের সাদা শাড়ির সিগনেচার স্টাইল ছিল তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট্য। জীবনে তিনি বহু পুরস্কার অর্জন করেছেন।ভারতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ভারত রত্ন ও তিনি পেয়েছেন। রাজ্য সভার সদস্য ও হয়েছিলেন।তবে অনিয়মিত ছিল তাঁর হাজিরা।অধিবেশনে যোগ দিলেও কখনো কথা বলেননি। এজন্য আর এক সদস্য শাবানা আজমী তাঁর কড়া সমালোচনা করেছেন। তবে তিনি ছিলেন নির্বিকার। তিনি বলতেন রাজনীতি তাঁর জন্য নয় এবং তিনি রাজনীতির কিছুই বুঝেন না।
প্রায় সাত দশকের বেশি সময়ের আলোকিত এক সংগীত জগৎ ছেড়ে বিরানব্বই বছর বয়সে অবশেষে চলে গেলেন তিনি পরপারে । তবে পেছনে রেখে গেছেন এক বিশাল গানের ভাণ্ডার যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আলো ছড়াবে। তাঁকে ভুলে যাওয়া বা তাঁর শূন্যস্হান পুরন হাজার বছরে ও সম্ভব হবে কি? মিঞা তানসেনের মতো তিনি ও এক কিংবদন্তী হয়ে বেঁচে থাকবেন হয়তোবা হাজার বছর।
আবিষ্কার ছবিতে তাঁর গাওয়া গানটি এখন খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে হয়তো —
“চিতার আগুনে আমাকে পোড়াতে পারবে/ছাই গুলো বাতাসে ওড়াতে পারবে/আমাকে পোড়াতে পারবে না।”
আসলেই লতার গানকে মুছে ফেলা কখনো সম্ভব হবে কি?
বিদায় কিংবদন্তী! বিদায় ভারতের নাইটিংগেল ! #

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.