--- বিজ্ঞাপন ---

দেরি কে লিয়ে আপকো যো কষ্ট হুয়া ইসিলিয়ে হামে বহুত খেদ হ্যায়…

আমরি বাংলা ভাষা - পর্ব ২

0

কাজী ফেরদৌস, অতিথি লেখক #

” দেরি কে লিয়ে আপকো যো কষ্ট হুয়া ইসিলিয়ে হামে বহুত খেদ হ্যায়।” বাংলা করলে দাঁড়ায় বিলম্বের কারণে আপনাদের কষ্টের জন্য আমরা দুঃখিত। এটা নাকি এয়ার ইন্ডিয়ার দিল্লি কোলকাতা গামী একটি ফ্লাইটএর বিলম্ব হওয়ার কারণে যাত্রী সাধারণের কাছে দুঃখ প্রকাশের নমুনা। সম্ভবত ১৯৯৭ সালে অপর্ণা সেনের সানন্দা পত্রিকায় পড়েছিলাম পশ্চিম বঙ্গের কোন এক সাংবাদিকের লেখায়। তখন আমি নিয়মিত সানন্দা আর দেশ পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ছিলাম। সেই সাংবাদিকের অভিমত ভারতে উর্দুর মতো একটা ও সুললিত ও সমৃদ্ধ ভাষা থাকতে কেন যে উত্তর ভারতের একটা গেঁয়ো ভাষা কে ভারতের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে বেঁচে নেওয়া হলো তা বোধগম্য নয়। সাতচল্লিশে দেশ ভাগের প্রাক্কালে ভারতের সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন শতাংশ মানুষ হিন্দিতে কথা বলতেন। অথচ তখন ভারতের জনসংখ্যার চৌত্রিশ শতাংশ মানুষের Linguafranka বা সাধারণ ভাষা ছিল উর্দু। শুধু মাত্র সাম্প্রদায়িক কারণে উর্দুর মতো একটা সমৃদ্ধ ভাষা কে পাশ কাটিয়ে হিন্দির মতো একটা গেঁয়ো ভাষা কে রাষ্ট্র ভাষা করা হলো যেটা ছিল ভারতের একেবারে নগন্য সংখ্যক মানুষের ভাষা ছিল । তারপর শুরু হলো হিন্দি কে শুদ্ধি করণ অভিযান । এতোদিন হিন্দিতে যত আরবি ফার্সি উর্দু শব্দাবলীর প্রবেশ করে ওটাকে অনেকটা সমৃদ্ধ করে ছিল ওসব শব্দ ঝেঁটিয়ে বিদায় করে ব্যাপক হারে সংস্কৃত শব্দ ঢুকিয়ে সেটা কে একেবারে খটমটে করে খাঁটি হিন্দুস্থানী রূপ দেওয়া হলো। যার নমুনা হলো এয়ার ইন্ডিয়ার বিদঘুটে ঐ ঘোষণা।
ভারতের দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের এখনো প্রবল বিরূপ মনোভাব আছে হিন্দির প্রতি। কিন্তু ছত্রিশ জাতির ছত্রিশ ভাষার দেশে উর্দু বাদ দিলে হিন্দি ছাড়া কোন বিকল্প লিংগুয়াফ্রাঙ্কা বা সাধারণ ভাষা নেই যেটা ভারতের রাষ্ট্র ভাষা হতে পারে। এটাই হলো বাস্তবতা। তাই ভারতীয়দের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না। নাহয় স্বাধীন ভারতে ইংরেজিকেই লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে মেনে নিতে হতো নাকি?সমস্যা টা নুতন দেশ পাকিস্তান কে ও মোকাবিলা করতে হয়েছিল।
পাকিস্তান পাঁচটি জাতি গোষ্ঠীর একটি জগাখিচুড়ি দেশ ছিল। একমাত্র ধর্ম ছাড়া আর কোন বিষয়ে এদের মিল ছিল না। তদুপরি পূর্ব আর পশ্চিম অংশ ছিল একবারে বিচ্ছিন্ন। মাঝখানে ছিল বিশাল ভারত। দুরত্ব ছিল প্রায় হাজার মাইলের বেশি । রাষ্ট্রের জন্য geographical contiguity থাকার যে শর্ত এক্ষেত্রে তাও ছিল না। তবুও কি করে হাজার মাইল দুরত্বে অবস্হিত দুটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল কে জুড়ে দেওয়া হলো একক রাষ্ট্র হিসেবে?অথচ লাহোর প্রস্তাবে সে রকম কথা ছিল না। বরং মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে একাধিক রাষ্ট্রের প্রস্তাব ছিল । কিন্তু সোহরাওয়ার্দী শেরে বাংলা ভাসানী সহ বাংলা অঞ্চলের নেতারা কেন এটা মেনে নিয়েছিলেন সেটা এখনো একটা বড় প্রশ্ন। পূর্ব বাংলার মানুষ সেটা না চাইলে কখনো এটা বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না।জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগ চেয়েছিল বাংলা এবং পাঞ্জাব কে ভাগ না করতে। কিন্তু কংগ্রেসের বাধার মুখে সেটা সম্ভব হয়নি। সোহরাওয়ার্দী আবুল হাসিম শরত বসু চেষ্টা করে ছিলেন যুক্ত বাংলা নিয়ে পাকিস্তান ভারতের বাইরে একটি আলাদা রাষ্ট্র করতে। জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দী কে গ্রীন সিগনাল ও দিয়ে ছিলেন।কিন্তু ততোদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। ইতিমধ্যে সংঘটিত হয়েছিল কোলকাতার ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। একদিকে উত্তপ্ত সামপ্রদায়িক উত্তেজনা অপর পক্ষে কংগ্রেস তথা পশ্চিম বঙ্গের হিন্দুদের চরম অনীহা সোহরাওয়ার্দী শরত বসুর প্রচেষ্টা আর হালে পানি পায়নি । ১৯০৫ সালে যারা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে নেমে ছিলেন তারাই আবার ইইউ টার্ন নিয়ে বঙ্গভঙ্গের জন্য আদাজল খেয়ে নেমে পড়লেন। এটা ছিল পশ্চিম বঙ্গের হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক মনোভাব এর বহিঃপ্রকাশ। মুসলিম মেজরিটি বাংলায় তাঁরা একসাথে থেকে কি করে থাকবে? ফলে পূর্ব বঙ্গ হয়ে গেল পাকিস্তানের একটি প্রদেশ। অথচ হওয়ার কথা ছিল একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ।

অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন পশ্চিম বঙ্গ তথা কোলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একেবারে কৃষি নির্ভর পূর্ব বঙ্গের পক্ষে একটা নড়বড়ে অর্থনৈতিক কাঠামো নিয়ে টিকে থাকা কিছুতেই সম্ভব হবে না। তাই একক পাকিস্তানের সাথে গাঁটছাড়া বাঁধা ছাড়া বিকল্প ছিল না। এরপর ও পূর্ব বাংলার ভবিষ্যত নিয়ে পশ্চিমের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের সংশয় ছিল। ফরাসী সাংবাদিক ও লেখক ডমিনিক লেপিয়ের তাঁর ভারতের স্বাধীনতা বিশেষ করে গান্ধীকে নিয়ে লেখা তাঁর Freedom at Midnight বইতে সেটা উল্লেখ করে বলেছেন পশ্চিমাদের আশংকা ছিল কোলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন পূর্ব বাংলা হবে One of the greatest human slum in the history of mankind. কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছেন সেটাতো হয়ইনি বরং পাকিস্তানের চব্বিশ বছরে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান ধীরে ধীরে কৃষি ও শিল্পে মোটামুটি ভালো অগ্রগতি সাধন করেতে পেড়েছল। বরং পশ্চিম বঙ্গ পূর্ব বঙ্গ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেক টা পিছিয়ে গিয়েছিল সর্ব ক্ষেত্রে ।এতে বুঝা যায় পশ্চিম বঙ্গের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ভিত্তি ছিল পূর্ব বঙ্গকে শোষণ যেটা করা হয়েছিল ইংরেজ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভিত্তিক জমিদারি শোষনের মাধ্যমে।
ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতিে দেশ ভগ হয়ে পূর্ব বঙ্গ পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হলেও ভাষা ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য ও ভৌগোলিক দুরত্ব দুই অংশের জনগণের মধ্যে সৌহার্দ্য গড়ে উঠার ক্ষেত্রে ছিল বড় প্রতিবন্ধক।এর মাঝে উঠে আসলো ভাষা সমস্যা।
পাকিস্তানের পাঁচটি জনগোষ্ঠীর ভাষা ছিল একেবারে ভিন্ন। বাংলা, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বালুচী ও পসতু।এই পাঁচটি জনগোষ্ঠীর কারও মাতৃভাষা উর্দু ছিল না। উর্দু ছিল একমাত্র ভারত থেকে আগত বিশেষ করে উত্তর ভারত হায়দ্রাবাদ বিহার সহ কিছু অঞ্চল থেকে আসা মোহাজির জনগণের ভাষা। তবে এটা ঠিক যে বাংলা অঞ্চলের আশরাফ বা উচ্চ বর্ণের মুসলিম শ্রেণির কিছু মানুষের ও মাতৃভাষা হিসেবে উর্দু প্রচলিত ছিল । কোলকাতার বহু মুসলমান এমনকি ঢাকার মানুষ ও উর্দুতে কথা বলতেন। এখনো কোলকাতার পার্ক সার্কাস অঞ্চলের মানুষ উর্দুতে কথা বলে। তদুপরি ভারতের মতো পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর মধ্যেও কমন ভাষা হিসেবে উর্দু মোটামুটি প্রচলিত ছিল। আমাদের চট্টগ্রাম শহরের পুরনো বাসিন্দাদের মধ্যে ও মোটামুটি উর্দু জানা লোকজন ছিল।তারা পারত পক্ষে বাংলা সিনেমা ও দেখাতো না।তারা হিন্দি উর্দু ছবির জন্য ছিল পাগল। পঞ্চাশ ষাটের দশকে বাংলা ছবির বেশির ভাগ দর্শক ছিল হিন্দু এবং আমি ও ছিলাম কোলকাতার বাংলা ছবি বলতে একেবারে অজ্ঞান।
আশির দশকে একজন পাকিস্তানী জাহাজের ক্যাপটেনের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। তিনি আমাকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন ভাই তোমাদের চট্টগ্রামের রিকশা ওয়ালার সাথে ও মোটামুটি উর্দুতে কথা বলে ভাব বিনিময় করা যায়। এটা কি করে সম্ভব হলো? আমাকে তখন একটা লম্বা লেকচার দিয়ে তাকে বুঝাতে হয়েছিল ঐতিহাসিক ভাবে এদেশের মানুষের সাথে উর্দু-ফার্সীর একটা যোগসূত্র ছিল। তাকে আরো জানালাম আমাদের পরিবারে মানুষ ও একসময় লেখা পড়া আরম্ভ করতো মক্তবে উর্দু কি পহেলা কিতাব, দোসরা ও কিতাব পড়ে। এবং আমার বাপ চাচারা সবাই উর্দু ফার্সি লিখতে পড়তে বলতে পারতেন। এবং আমার বড় দুই বোন ও ভালো উর্দু বলতে পারতেন। সে-তো রীতিমতো অবাক! তাকে আরো জানালাম যে বিংশ শতাব্দীর শুরুর আগে আমাদের পূর্ব পুরুষ বাংলা জানতেন না তেমন একটা।তাদের বেশির ভাগ মানুষ বাংলা ইংরেজি পড়াতো না। তারা মাদ্রাসায় আরবি ফার্সি উর্দু পড়তো। এদেশে তখন শিক্ষিত মুসলমান মানেই আরবি ফার্সি উর্দু জানা লোকজন। আমাদের বাপ চাচাদের জেনারেশন থেকে পুরোপুরি বাংগালী হতে শুরু করে ছিলাম আমরা আধুনিক শিক্ষার সংস্পর্শে এসে ।
কথা গুলো বলছি আমি আমাদের রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহ সহ ফাউন্ডিং ফাদারদের সামনে উর্দু ছাড়া কি তখন পাকিস্তানের দুই অংশের মানুষের জন্য অন্য কোন সাধারণ ভাষা বা Linguafranka ছিল কি ? উর্দু বাদ দিলে ভারতের মতো পাকিস্তান কে ও ইংরেজিকেই রাষ্ট্র ভাষা করার কথা বিবেচনা করতে হতো কি? তাহলে ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতো মানুষ কেন বাংলা কে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি করেছিলেন?কংগ্রেসের ধীরেনদত্ত ১৯৪৮ সালের ২৩ শে মার্চ পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে কেন প্রথম বাংলা কে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি করে ছিলেন? ঐ দাবি কি যৌক্তিক ছিল? হয়তোবা বাঙালিরা পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী ছিল এইটা একটা কারণ হতে পারে।কিন্তু বাদবাকি চারটি জাতি গোষ্ঠীর পক্ষে কি এটা মেনে নেওয়া সম্ভব হতো?
হয়তো এরকম ভাবনা থেকেই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার কার্জনহলের ছাত্র সমাবেশে ঘোষণা করে ছিলেন একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। এর বিরুদ্ধে কয়েকজন ছাত্র নো নো ধ্বনি দিয়েছিলেন জিন্নাহর সামনেই। জিন্নাহ বিস্মিত হয়ে ছিলেন। এবং আর কখনো এটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন নি।
অনেকের ভুল ধারণা জিন্নাহর মাতৃভাষা বা পাকিস্তানীদের মাতৃভাষা ছিল উর্দু। এটা ছিল একটা ডাহা মিথ্যা। পাকিস্তানের বাঙালি সহ পাঁচটি জাতি গোষ্ঠীর কারো মাতৃভাষা উর্দু ছিল না। জিন্নার মাতৃভাষা ছিল সিন্ধি।কিন্তু তিনি ইংরেজি ছাড়া আর কোন ভারতীয় ভাষা আদৌ জানতেন কিনা সন্দেহ আছে। তবুও একটি মহল অত্যন্ত সচেতন ভাবে অপপ্রচার চালিয়েছিল তখন পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা বাঙালির উপর চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের কথা বলে! যদি ও পশ্চিম পাকিস্তানের কারোর মাতৃভাষা উর্দু ছিল না। আমার এক কলিগের সাথে দুহাজার আট সালে এনিয়ে যখন আলাপ করছিলাম তিনি তো বিস্ময়ে হতবাক! তিনি তখনও জানতেন না পশ্চিম পাকিস্তানের মোহাজির জনগোষ্ঠী ছাড়া কারো মাতৃভাষা উর্দু ছিল না। আসলে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য গুজব আর বিভ্রান্তি ছড়ানো কাজে লাগে বেশি। (চলবে)

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.