--- বিজ্ঞাপন ---

বিজ্ঞানীদের নজর এখন মঙ্গল গ্রহের দিকে

0

সৌর জগতে থাকা আমাদের পাশ্ববর্তী মঙ্গল গ্রহে ভবিষ্যতে মানব বসতি এবং কলনি স্থাপনের স্বপ্ন বুকে লালন করে শত বছর থেকে নিবীড় গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। আর মঙ্গল গ্রহকে নিয়ে ব্যাপক গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে ১০ই অক্টোবর ১৯৬০ সাল থেকে ৩০শে জুলাই ২০২০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ এই ষাট বছরে বিশ্বের আটটি দেশ এবং তাদের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা মিলে মোট ৪৯টি মঙ্গল (মার্স) স্যাটালাইট মিশন পরিচালনা করেছে।

গত ২০২১ সালে এসে নতুন করে মঙ্গল গ্রহের বুকে ভিন্ন মাত্রার আরো চারটি মিশন পরিচালনা সম্পন্ন করে বিশ্বের বেশ কিছু মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ও দেশ। আর মঙ্গল গ্রহ বিজয়ের এই রথযাত্রায় এবারই প্রথম কোন মুসলিম বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) মঙ্গলের অরবিটারে স্যাটালাইট পাঠিয়ে নিজেদের নাম লেখায়।

২০২১ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার প্রেরিত মহাকাশ যান পার্সিভেন্স রোভার নিয়ে মঙ্গলগ্রহের বুকে ল্যাণ্ড করে এবং পরিকল্পনা মাফিক ১৯শে এপ্রিল ২০২১ সাল থেকে পার্সিভেন্স রোভার মঙ্গলের বুকে তার গবেষণামুলক কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করে দেয়। আবার ১৯শে এপ্রিল ২০২১ সালে মঙ্গলগ্রহে ১.৮০ কেজি ওজনের ইনজুনিউটি হেলিকপ্টার উড়িয়ে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে নাসা। ১৫ই ডিসেম্বর ২০২১ সাল পর্যন্ত ইউজুনিউটি হেলিকপ্টার মঙ্গলের বুকে মোট ১৯ বার সফল ফ্লাইট মিশন পরিচালনা করেছে।

বিশ্বের আরেক উদীয়মান পরাশক্তি চীন কিন্তু আমেরিকার সাথে পাল্লা দিয়ে মঙ্গল গ্রহ জয়ের মিশন পরিচালনা করে যাচ্ছে। গত ২০২০ সালের ২৩শে জুলাই চীন মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশ্যে তিয়ানওয়েন-১ (Tianwen-1) মহাকাশ যান প্রেরণ করে। এটি ১০ই ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে মঙ্গল গ্রহের অরবিটে প্রবেশ করে এবং ১৪ই মে ২০২১ সালে মঙ্গলের বুকে ল্যান্ডার নামায় এবং ২২শে মে ২০২১ সালে ঝুরং (Zhurong) রোভার সফল ভাবে মোতায়েন সম্পন্ন করে চীন এবং পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক তার প্রাথমিক মিশন শেষ করেছে।

মঙ্গল গ্রহকে নিয়ে ব্যাপক গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত ৪৯টি স্যাটালাইট মিশনের মধ্যে তৎকালীন সভিয়েত ইউনিয়ন কিন্তু একাই ১৭টি মিশন পরিচালনা করেছিল। আর এই মিশনের সবগুলোই করা হয়েছিল ১৯৯১ সালের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্টার হিসেবে কোল্ড ওয়ার চলাকালীন সময়ে। তৎকালীন সময়ে সভিয়েত ইউনিয়ন ২০২০ সালের মধ্যে মঙ্গল গ্রহে মানব মিশন পাঠানোর উদ্দ্যেশকে সামনে রেখে অত্যন্ত গোপনে মহাকাশ প্রযুক্তিগত উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছিল।

১৯৯১ সালে সভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হলে চরম আর্থিক সংকটের মুখে তাদের মঙ্গল জয়ের এই বিশাল প্রজেক্ট একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। আজ যদি সভিয়েত ইউনিয়ন টিকে থাকত, হয়তবা মঙ্গল গ্রহে মানব মিশন পাঠানোসহ মহাকাশ বিজয়ের আরো নতুন নতুন তথ্য উপাত্ত মানব জাতির সামনে প্রকাশ হয়ে যেত।

তবে একক কোন দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু তার মহাকাশ গবেষণা এবং উন্নয়নে এখনো পর্যন্ত বাতিঘর হিসেবে বিশ্বের বুকে তার নিজস্ব প্রযুক্তিগত সক্ষমতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’-কে এ মুহুর্তে বিশ্বের বুকে মহাকাশ গবেষণা, গ্রহ ও উপগ্রহে অভিযান কিংবা স্যাটালাইট প্রেরণের প্রথম স্থানীয় কোন গবেষনামুকলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাছাড়া ১৯৬০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু একাই প্রায় ২২টি স্যাটালাইট মিশন পাঠিয়েছে মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশ্যে। যেখানে কিনা বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো একত্রে মিলে তার ২০% পাঠাতে পেরেছে বলে মনে হয় না। আর যার চূড়ান্ত সুফল কিন্তু ভোগ করে যাচ্ছে সারা বিশ্বের মানব জাতি।

১৯৯৭ সালের নাসার সোজোরনার রোভারের সাফল্যের পরে মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে আরো নতুন করে জানতে ২০০৩ সালে মার্কিন জায়ান্ট নাসা এই রক্তিম গ্রহে ‘স্পিরিট’ ও ‘অপারচুনিটি’ নামক দুটি রোভার যান পাঠিয়েছিল নাসা। আর নাসার এই ‘স্পিরিট’ ও ‘অপারচুনিটি’ রোভার যান দুটি কিন্তু মঙ্গল গ্রহকে এক্সপ্লোর করে এর ভুত্বকের গঠন, আবহাওয়া সম্পর্কে দীর্ঘ সময় ধরে গুরুত্বপুর্ণ তথ্য পাঠাতে থাকে পৃথিবীতে থাকা নাসার ল্যাণ্ড স্পেস সেন্টারে।

মঙ্গল গ্রহকে নিয়ে ব্যাপক গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সী এ পর্যন্ত মোট ৪টি মিশন পরিচালনা করেছে। তবে ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সী এখন পর্যন্ত মাত্র চারটি মঙ্গল মিশন পরিচালনা করতে সক্ষম হলেও তাদের মিশনগুলো ছিল কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকর। বিশেষ করে মঙ্গলের বুকে ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সির পাঠানো মারস এক্সপ্রেস স্যাটালাইট মিশন এই রক্তিম গ্রহ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে গেছে।

তবে মঙ্গল গ্রহে স্যাটালাইট মিশনের অংশ হিসেবে বর্তমান হালে রাশিয়া ২টি, জাপান ১টি, সংযুক্ত আরব আমিরাত ১টি, চীন ১টি এবং আমাদের পার্শ্ববর্তী বন্ধুদেশ ভারতও কিন্তু ১টি করে দূর যাত্রার মঙ্গল মিশন পরিচালনা করে তাদের নিজস্ব প্রযুক্তিগত উন্নয়নের নজির বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে। তাছাড়া মুসলিম বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাত তার হোপ স্পেসক্রাফট মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করে ২০২০ সালের ১৯শে জুলাই এবং এটি ৯ই ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে মঙ্গলের অবিটারে প্রবেশ করে এখনো পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

যদিও অর্ধ শতাব্দি ব্যাপী মানব জাতি ৪৯টি মঙ্গল জয়ের স্যাটালাইট মিশন পরিচালনা করলেও এখনো পর্যন্ত মাত্র ২১টি স্যাটালাইট মিশন সফল হয়েছে। আর মঙ্গল গ্রহ জয়ের স্বপ্ন পূরণে এই সফলতার হার মাত্র ৪২% হলেও আদূর ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে নভোচারীসহ মহাকাশ যান এবং পর্যবেক্ষণ স্যাটালাইট প্রেরণে বর্তমানে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলো নিজেদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে।

এখানে আশার কথা হলো যে, আগামী ২০৩৫ সাল থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে মঙ্গলের মাটিতে সরাসরি নভোচারীসহ বেশ কিছু মহাকাশ যান পাঠানোর মহা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা, স্পেস এক্স, ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সি, চীন এবং রাশিয়াসহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশ এবং মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।

তবে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলো যতই প্রতিযোগিতা করুক না কেন, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা হেতু আগামী ২০৬০-৭০ সালের আগে মঙ্গল গ্রহে সরাসরি নভোচারীসহ মহাকাশ যান প্রেরণ হয়তোবা সম্ভব হবে না। বিশেষ করে চার জন বা তার বেশি সংখ্যক নভোচারী নিয়ে সাবলীলভাবে অসীম মহাকাশে ছুটে চলার মতো প্রযুক্তিগত সক্ষমতা সম্পন্ন ইউনিক স্পেসসীপ এবং হাইব্রীড স্পেসক্রাফট সিস্টেম এখনো পর্যন্ত ডিজাইন বা তৈরি করা সম্ভব হয় নি। যদিও ইউনিক স্পেস মাদার সীপ এণ্ড নিউ জেনারেশন রকেট ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলো এবং এক্ষেত্রে দেশগুলো কিন্তু বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে কোন রকম ত্রুটি রাখছে বলে মনে হয় না।#

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.