বিশেষ প্রতিনিধি #
চট্টগ্রামের জঙ্গল সলিমপুর। বছরের পর বছর ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে প্রায় ৪’শ একর পাহাড় ন্যাড়া করে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল এক সা¤্রাজ্য। সরকারী পাহাড় কেটে প্লট বিক্রি থেকে শুরু মাদক, খুনসহ এমন কোন অপরাধ নেই এখানে হচ্ছে না। শহর থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্গম। ভেতরে না গেলে কেউ বিশ্বাস করবে না এখানে আসলে কি হচ্ছে। চর্তুদিকে কড়া পাহারা। ভেতরে কেউ গেলে তাকে পড়তে হয় জবাবদিহিতায়। হুমকি-ধমকীও চলে। প্রায় ১০ কিলোমিটারের অধিক এলাকা জুড়ে এ অপরাধ জগতের বিস্তার।
পুলিশ জানায়, অনেক বছর ধরে এ সাম্রাজ্যের নায়ক আক্কাস, ইয়াসিন ও মশিউর। গত ৯০’র দশক থেকে চট্টগ্রামের বিশাল এ পাহাড়ী এলাকা ঘিরে অপরাধের বিস্তার ঘটতে থাকে। সরকারী জমি দখল করে প্লট বাণিজ্য থেকে শুরু করে এমন কোন অপরাধ নেই যা এখানে সংঘটিত হচ্ছে না। দূর্গম এলাকা বলে অনেকবার সরকারী উদ্যোগে দখলদার উচ্ছেদের চেষ্টা চলেছে। কিন্ত কাজের কাজ কিছুই হয় নি। পাহাড়ের ভেতরে থাকা সন্ত্রাসীরা বরাবরই থেকে গেছে ধরাছোয়ার বাইরে। ২০১০ সালে র্যাবের সাথে বন্দুক যুদ্ধে আক্কাস নিহত হলে মশিউর ও ইয়াসিনের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়। সবকিছুই যখন প্রশাসনের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে তখন টনক নড়ে সবার। শেষ পর্যন্ত হাতছাড়া হতে থাকা বিশাল এলাকা নিয়ন্ত্রনে আনতে সরকার কঠোরভাবে মাঠে নামে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মশিউর ও ২০২২ সালের জুলাই এ ইয়াসিন গ্রেফতার হলে প্রশাসন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহম্মদ নাজমুল আহসান বলেন, বিশাল এ এলাকায় সবুজায়ন পাহাড় ছিল। কোন মানুষের বসতি ছিল না। গত ২০০০ সালের পর থেকে বিভিন্ন স্থান থেকে অপরাধীরা এখানে আশ্রয় নিতে শুরু করে। প্রশাসনের অগোচরে মুষ্টিমেয় লোক পাহাড় কেটে বসতি গড়ে তোলে। ভেতরে ভেতরে প্রায় ৪শ একর পাহাড় কেটে ন্যাড়া করে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে ২৪ হাজার পরিবারের লক্ষাধিক লোকের বসবাস রয়েছে। তিনি বলেন, জঙ্গল সলিমপুর দেশের অভ্যন্তরে আরেক সাম্রাজ্য। আলীনগরে প্রবেশ করতে পরিচয়পত্র দেখাতে হয়। কোন এন্ড্রয়েট মোবাইল নেওয়া যায় না। প্রবেশমুখে সোর্স থাকে। অপরিচিত লোক ঢুকলে ভেতরের লোকজনদের জানিয়ে দেওয়া হয়। পরে ভেতরে থাকা লোকজন মহিলাদের অগ্রভাগে দিয়ে ভেতরে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। ২০১৭ সালে এবং ২০১৯ সালে উচ্ছেদে গেলে বাধার মুখে পড়ে প্রশাসন। এমনকি গত ১৪ মে প্রধানমন্ত্রী মুখ্যসচিবের সলিমপুর পরিদর্শনের সময় একইভাবে মহিলাদের দিয়ে মানববন্ধন সৃষ্টি করা হয়। এখানে ২০০৭ সালের পর থেকে বেশি দখল হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা চিহ্নিত আসামিদের অবস্থান রয়েছে। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে ৪-৫টি করে খুনের মামলাও রয়েছে।
সীতাকুন্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুমন বণিক বলেন, গত ১৮ জুলাই দুপুর ১ টার দিকে কোতোয়ালি থানাধীন আদালত চত্বর থেকে ইয়াসিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মো. ইয়াছিন সীতাকুন্ডের সলিমপুর ইউনিয়নের জঙ্গল সলিমপুর আলীনগর এলাকার শামসুল হকের ছেলে। ইয়াছিনের নামে হত্যা, গুম, সরকারি জায়গা দখলসহ নানা অভিযোগে অসংখ্য মামলা রয়েছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, আক্কাসের মৃত্যুর পর সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়ে উঠে মশিউর। তাকে প্রথম ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্ত আইনের ফাঁক ফোকরে সে বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে আবারও শুরু করে তার সাম্রাজ্য পরিচালনা। শেষ পর্যন্ত ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর আবারও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। বর্তমানে সে কারাগারে রয়েছে। পুলিশ জানায়, পাহাড় বিক্রির টাকা দিয়ে গত কয়েক বছরে সন্ত্রাসীদের অভয়াশ্রম হিসেবে জঙ্গল সলিমপুরে বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলে মশিউর। সে খুলনার ফুলতলার পাইগ্রামের কাজী হাসান আলীর ছেলে। তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, জবরদখলসহ বিভিন্ন অপরাধের ৩০টির বেশি মামলা রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদে’র নেতৃত্বে সরকারি খাস জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে অপরাধের এই সাম্রাজ্য। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালালেও এটি নিয়ন্ত্রনে আনতে পারছে না। একে তো পাহাড়ী এলাকা, তার উপর চলাচলের রাস্তা নেই। প্রশাসনিক কাঠামোতে জঙ্গল সলিমপুরের অবস্থান সীতাকুন্ড উপজেলার আওতায় হলেও ওই এলাকায় প্রবেশ করতে হয় চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ থানার বাংলাবাজার এলাকা দিয়ে। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাবাজার এলাকাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। বিশেষ করে বায়েজিদ- সীতাকুন্ডের রাস্তা খোলার পর থেকে এলাকাটির উপর নজর পড়ে প্রশাসনের। উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ ধরে এক কিলোমিটারের মত এগোলে দেখা যায় ছিন্নমূলের বসতির। মাইলের পর মাইল খন্ড খন্ড ভাবে বসতি ঘর। রাস্তার দু’পাশে গড়ে উঠেছে আধাপাকা মাদ্রাসা ও টিনের ঘর। খালি প্লটে জমির ‘মালিকের’ নাম লেখা ছোট ছোট বহু সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। ছিন্নমূল সংগ্রাম পরিষদের বিস্তৃতি ব্যাপক এলাকা জুড়ে। আক্কাসের আমলে করা এ সমিতির সদস্য সংখ্যা এখন ২০ হাজারের উপরে। এ সমিতির মধ্যে কথিত সাংবাদিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেনীর লোকজন সদস্য হিসেবে রয়েছে। তবে বেশিরভাগই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নি¤œশ্রেনির লোক। বাড়ী-ঘর বিক্রি করে অনেকে ছিন্নমূলকে সর্বনি¤œ ২০ হাজার এবং সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা দিয়ে প্লটের মালিক বনেছেন। সরকারী এসব খাস জায়গা দখল করে চলে বিক্রি। কথিত ছিন্নমূল সমিতি পুরো এলাকাকে ১১টি সমাজে ভাগ করে দেয়। ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে ছিন্নমূলের নেতারা। ওই এলাকার ভেতরে রয়েছে ডজন খানেক মসজিদ, চারটি মাদ্রাসা, তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ বিদ্যালয়, তিনটি কেজি স্কুল, তিনটি এতিমখানা, ছয়টি কবরস্থান, পাঁচটি মন্দির, দুটি কেয়াং, একটি গির্জা, একটি শ্মশান এবং কয়েকটি কাঁচা বাজার। সমিতির সদস্যপদ নিতে হয় ৫০০ টাকা দিয়ে। পরে সমিতিকে টাকা দিয়ে পাহাড়ের ভেতরে একেক খন্ড জমির দখল নিয়ে ঘর তুলেছেন তারা।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের ভেতরে এ ধরনের বিশাল এক সা¤্রাজ্য ভেতরে ভেতরে গড়ে উঠলেও প্রশাসন ছিল নির্বিকার। বরং অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনের ভেতরে থাকা অনেকে টাকার বিনিময়ে এদের সহায়তা করে আসছিল। অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাবার পর থেকে সরকারের উচ্চমহলে এ এলাকা নিয়ে আলোচনা শুরু হতে থাকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ২০০৬ সালে সরকারি এই জমির বন্দোবস্তি চেয়ে আবেদন করে ছিন্নমূল। কিন্ত কোন সাড়া না মেলায় থমকে যায় সব। পরে ২০১৬ সালে ছয়শ একর জমির বন্দোবস্ত চেয়ে আবার আবেদন করলে সীতাকুন্ড উপজেলা প্রশাসন বন্দোবস্তের পক্ষে মত দিয়ে একটি প্রতিবেদনও নাকি জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠিয়েছিল। পরে অবশ্য ছিন্নমূল খুব একটা সুবিধা করতে পারে নি। কাগজে কলমে সরকারের কাছে আবেদনের নথি দেখিয়ে নাকি সাধারন মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়া হতো। তাদের ফাদেঁ পা দিয়ে অনেকে নিজের সহায় সম্বল বিক্রি করে সরকারী জমি নেয়। পুরো পাহাড়ী এলাকা জুড়ে এখন প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষের বাস।
জানা গেছে, পাহাড়ে এই অবৈধ বসতিকে কেন্দ্র করে কয়েকটি গ্রæপ গড়ে উঠে। এ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে নিজেদের মধ্যে বেশ কয়েকবার সংর্ঘষে লিপ্ত হয়। গত ২০০৪ সালে একাধিক পক্ষের মধ্যে দ্ব›দ্ব ব্যাপকভাবে দেখা দিলে তার ছোয়া থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। ২০১০ সালে স্থানীয় লাল বাদশা ও আলী আক্কাসের গ্রুপের মধ্যে সংর্ঘষের ঘটনাও ঘটে। এ ঘটনার পর র্যাব মাঠে নামে। দুর্গম পাহাড়ে র্যাব অভিযান চালাতে গেলে ক্রসফায়ারে মারা যায় ভ‚মিদস্যু আক্কাস। আক্কাস মারা যাওয়ার পর বাকিরা গা ঢাকা দেয়। আক্কাসের মৃত্যুর পর সা¤্রাজ্যে ছদ্মপতন হতে থাকে। আক্কাস মারা যাওয়ার পর দীর্ঘ বছরের পর বছর ধরে এলাকাটির দিকে আর নজর দেয়া হয় নি। এরই মাঝে শক্তিশালী হয়ে উঠে ইয়াসিন ও মশিউর।
এদিকে গত ১৫ জুলাই বিকেলে সীতাকুন্ডের সলিমপুর এলাকায় জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগর এলাকার পরিদর্শনে যান চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ওইদিন কার্যক্রম শেষে ফিরে আসার সময় আলীনগর এলাকায় পরিদর্শন টিমের বহরে থাকা স্থানীয় সলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মো. আরিফকে গাড়ি থেকে নামিয়ে মারধর করা হয়। এ হামলায় ইয়াছিনের নেতৃত্বে ২৫ জনের মতো সন্ত্রাসী অংশ নেয়। এসময় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনায় ১৬ জুলাই আহত আরিফের ভাই আবদুল আলীম বাদী হয়ে সীতাকুন্ড থানায় মামলা করেন। মামলায় ইয়াছিনসহ ১৫-১৬ জনকে অজ্ঞাতানামা আসামি করা হয়। ওই মামলায় পুলিশ ইয়াছিনকে গ্রেফতার করে।
ঘটনার পর চট্টগ্রামের জঙ্গল সলিমপুর যে কোন মূল্যে অবৈধ দখল মুক্ত করতে নির্দেশনা আসে। এরই অংশ হিসেবে গত ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের সম্মেলন কক্ষে জঙ্গল সলিমপুর নিয়ে মহাপরিকল্পনা ও সেখানে বসবাসরত ভূমিদস্যুদের হাত থেকে সরকারি জায়গা দখল মুক্ত করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তাদের অবহিত করেন। এ সময় তিনি বলেন, নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ জঙ্গল সলিমপুরকে কেন্দ্র করে একটি চিহ্নিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠি দীর্ঘদিন ধরে বনভূমি ধ্বংস করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছে সরকারি খাস জমি অর্থের বিনিময় দখল বিক্রি করে আসছে। যেখানে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে প্রতিনিয়ত পাহাড় ধ্বসের আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করে আসছে হাজারো পরিবার। এছাড়াও জঙ্গল সলিমপুর এখন সন্ত্রাসী গোষ্ঠির একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিনত হয়েছে। সন্ত্রাসীরা অভিনব কায়দায় বনভূমি ধ্বংস ও খাস জমি বিক্রয় করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস সলিমপুরে ভূমিদস্যু সৃষ্ট সকল প্রতিবন্ধকতা প্রতিহত করার জন্য প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দ্রæত কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন।
প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিবের নির্দেশনার পর জঙ্গল সলিমপুর ঘিরে মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় প্রকল্পসমূহের মধ্যে রয়েছে স্পোর্টস ভিলেজ, হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, সাফারি পার্ক, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বেতার স¤প্রচার কেন্দ্র, পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কাস্টমস ডাম্পিং হাউজ, সবুজ শিল্প এলাকা, চট্টগ্রাম সেনানিবাস ও বিএমএ এবং আনসার ও ভিডিপি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন।##
পূর্ববর্তী সংবাদ
পরবর্তী র্সবাদ