--- বিজ্ঞাপন ---

জ্বালানি সংকটের মুখে সারা বিশ্ব

0

কাজী আবুল মনসুর/সিরাজুর রহমান #

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন এবং চলমান বৈশ্বিক মহামন্দার মুখে সারা বিশ্বে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট কাটিয়ে উঠা বড় ধরণের একটি চ্যালেঞ্জিং ইস্যু হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে বিশ্বের কিছু উন্নত ও বড় বড় দেশগুলো কয়েক দশক আগে থেকেই নিজস্ব কৌশলগত জ্বালানি তেল সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলায় এ সংকট তারা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মোকাবিলা করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দুই প্রভাবশালী দেশ ভারত এবং চীনের নিজেদের মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদে বৈরীভাব ও শত্রুতা পোষণ করলেও তারা কিন্তু পরিকল্পনা মাফিক কৌশলগত জ্বালানি তেল রিজার্ভ গড়ে তুলতে কোন রকম ছাড় দেয়নি। নিজ দেশেই তারা গড়ে তুলেছে আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের শত মিলিয়ন ব্যারেলের কৌশলগত তেলের ভান্ডার। এক গবেষণামুলক তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বের বুকে সবচেয়ে বেশি স্ট্যাটিজিক অয়েল রিজার্ভ রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। বর্তমানে আমেরিকার কৃত্রিম ভান্ডারে প্রায় ৭১৪ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল মজুত রাখার সক্ষমতা রয়েছে। তবে গত ১৪ই অক্টোবরের হিসেব অনুযায়ী আমেরিকার প্রকৃত জ্বালানি তেলের মজুত রয়েছে ৪০৫.১ মিলিয়ন ব্যারেল। যদিও অবশ্য প্রকৃত পরিমাণ যুক্তিসঙ্গত কারণে কম বা বেশি হতে পারে। গত মাসে দেশটি তেলের সংকট মোকাবিলায় স্ট্যাটিজিক ওয়েল রিজার্ভ থেকে ১৫ মিলিয়ন ব্যারেল তেল বাজারে ছেড়েছে।

তবে আমেরিকার পর সাম্প্রতিক সময়ে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্ট্যাটিজিক অয়েল রিজার্ভকারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। দেশটির দেয়া তথ্যমতে, বর্তমানে ৪০০ মিলিয়ন ব্যারেলের মজুত রয়েছে চীনের। চীনের শি জিং পিং সরকার স্ট্যাটিজিক অয়েল রিজার্ভ ৪০০ মিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ৫১১ মিলিয়ন ব্যারেলে উন্নীত করার কাজ বাস্তবায়নে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যাচ্ছে।

বৈশ্বিক কৌশলগত জ্বালানি তেলের তৃতীয় বৃহত্তম মজুত রয়েছে জাপানে। জাপানের কাছে এ মুহুর্তে প্রায় ৩২৪ মিলিয়ন ব্যারেল জ্বালানি তেল মজুত রাখার সক্ষমতা রয়েছে। তাছাড়া স্ট্যাটিজিক অয়েল রিজার্ভের দিক দিয়ে চতুর্থ অবস্থানে থাকা দক্ষিণ কোরিয়ার ১৪৬ মিলিয়ন ও স্পেনের ১২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল ভূগর্ভে মজুত রাখতে সক্ষম। তবে ভারতের এই ওয়েল রিজার্ভ কিছুটা কম হলেও তারাও কিন্তু অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ মিলিয়ন ব্যারেলের কাছাকাছি বিপুল পরিমাণ স্ট্যাটিজিক ওয়েল রিজার্ভ গড়ে তুলেছে।

তাছাড়া ইউক্রেনে রাশিয়া যুদ্ধের মধ্যেও ২০২২ সালের শুরু থেকে চীন এবং ভারত নিরবিচ্ছিন্নভাবে একেবারেই পানির দামে রাশিয়ার কাছ থেকে ক্রুড ওয়েল বা জ্বালানী তেল ক্রয় করে বড় ধরণের স্ট্যাটিজিক ওয়েল রিজার্ভ গড়ে তুলেছে। অবশ্য অপরিশোধিত তেল কেনার ক্ষেত্রে এই দেশ দুটি শুধু রাশিয়া নয় বরং সৌদি আরবসহ বিশ্বের অন্যান্য তেল ক্রয়ের উৎসগুলোকে সার্থকভাবে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমা বিশ্বকে অনেক আগেই পেছনে ফেলে দিয়েছে।

চীন খুব সম্ভবত বিগত এক বছরেই প্রায় ১২০ বিলিয়ন ডলারের বিপুল পরিমাণ তেল কিনেছে রাশিয়া ও বিশ্বের অন্যান্য উতস হতে। আবার চীন এক মাসের হিসেবে চলতি ২০২২ সালের মে মাসেই রাশিয়া থেকে ৭.৪৭ বিলিয়ন ডলারের তেল ও গ্যাস কিনেছিল। সে হিসেবে চীন গত ৯ মাসে রাশিয়া থেকে আনুমানিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারের রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল ও গ্যাস সংগ্রহ করেছে।

অন্যদিকে ভারতও কিন্তু ঠিক একই সময়ে প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানী তেল কিনে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছে এবং এখনো পর্যন্ত হচ্ছে। তাছাড়া স্বল্প দামে অপরিশোধিত তেল কিনে এনে তা নিজস্ব রিফাইনিং প্লান্টে পরিশোধন করে ভারত বর্তমানে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর কাছে আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যে জ্বালানী তেল রপ্তানি করে যাচ্ছে। অথচ ভারত নিজে তেল উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও সুদক্ষ পরিচালনায় ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার আলোকে নিজেই এখন কিন্তু জ্বালানী তেল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে।

২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত ভারত অতিরিক্ত মোট প্রায় ৭০ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানী তেল খুব কম দামে রাশিয়ার থেকে আমদানি করে। যেখানে কিনা দেশটি ২০২১ সালের সারা বছরে রাশিয়ার কাছ থেকে ১২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল কিনেছিল। মার্কিন ও তার পশ্চিমা শিবিরের প্রবল বাধা ও সমালোচনাকে কন রকম পাত্তা না দিয়েই নিজস্ব পরিকল্পনা মাফিক স্ট্যাটিজিক ওয়েল রিজার্ভ সুরক্ষিত করতে রাশিয়া থেকে এখনো পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ তেল আমদানি করে যাচ্ছে ভারত। আর এক্ষেত্রে চীনের অবস্থান ও কৌশল আগেই তো তুলে ধরা হয়েছে।

এখন চীন ও ভারতের মতো দেশগুলোকে নিয়ে যতই সমালোচনা করা হোক না কেন, দেশ পরিচালনার দক্ষতা এবং বৈদেশিক নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে এরা একেবারেই স্বাধীন এবং নিজের শক্ত অবস্থান বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে। যেখানে কিনা অতীতের এক সময়ের সুপার পাওয়ার যুক্তরাজ্য বর্তমানে আমেরিকার হাতের পুতুল সেজে নিজের অর্থনীতিকে একেবারেই ধ্বংসের মুখে নিয়ে গেছে। এদিকে আমেরিকা নিজেই কিনা তার অর্থনৈতিক সংকট এড়াতে বিপুল পরিমাণ তেল চীনের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে জ্বালানি তেল সংরক্ষণ ক্ষমতা প্রায় ৯ লক্ষ টন বা ৭ থেকে ৮ মিলিয়ন ব্যারেল। যার মধ্যে ডিজেলের মজুদ ক্ষমতা রয়েছে ৬ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি। অকটেন মজুদ ক্ষমতা ৪৬ হাজার মেট্রিক টন, পেট্রোলের মজুত ৩২ হাজার মেট্রিক টন, কেরোসিনের মজুত ৪২ হাজার মেট্রিক টন এবং ফার্নেস অয়েল মজুদ রাখার ব্যবস্থা রয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন।

চলমান বৈশ্বিক মহামন্দা এবং পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বিশেষ করে স্বল্প আয়ের দেশগুলো কিন্তু বড় ধরণের ঝুঁকির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘ মেয়াদি অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় দেশের চাহিদা মাফিক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার পাশাপাশি অন্তত এক বছরের জ্বালানি তেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিকল্প আর কিছুই হতে পারে না। সে হিসেবে বাংলাদেশের সার্বক্ষণিকভাবে ১০ মিলিয়ন ব্যারেলের সমপরিমাণ স্ট্যাটিজিক ওয়েল রিজার্ভ এবং তার পাশাপাশি ৫০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে বলে তারা মনে করেন।##

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.