--- বিজ্ঞাপন ---

চীন কেন এগিয়ে যাচ্ছে

0

সিরাজুর রহমান #

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে চীন ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়ে। কোটি কোটি সাধারণ মানুষ একেবারেই কর্মহীন হয়ে যায়। আর এহেন চরম অর্থনৈতিক সংকট ও বিপর্যয়ের মুখে চীনের মাও সেতুং কমিউনিস্ট সরকার দেশকে রক্ষা করতে বেশ কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়। চীনের সরকার আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে প্রথমে সারা দেশজুড়ে প্রায় এক যুগ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাস্তরে সকল ধরণের আর্থিক সহায়তা এবং অনুদান বন্ধ করে দেয়।

তবে এর বিকল্প হিসেবে চীন দেশের বেকার তরুণ এবং তরুণীদের স্বল্প মেয়াদে বাস্তব জীবন নির্ভর কারিগরি প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। তার পাশাপাশি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে ভোকেশনাল বা কারিগরি শিক্ষাকে এক রকম বাধ্যতামুলক করে নতুন শিক্ষানীতি প্রনয়ন করে চিনের কামিউনিস্ট মাও সেতুং সরকার। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তোলা হয় এক একটি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে।

যার ফলে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে সারা দেশে কোটি কোটি দক্ষ কর্মী গড়ে উঠে এবং তারা চাকরীর পেছনে না ছুটে নিজ বাড়িতেই যে যার দক্ষতা অনুযায়ী স্বল্প খরচের নতুন নতুন প্রযুক্তি পন্য এবং সেবা তৈরি করতে থাকে। তার সাথে আস্তে আস্তে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে চীনের বৈদেশিক বানিজ্য ও প্রভাব। আর দীর্ঘ মেয়াদী মহা পরিকল্পনার আওতায় দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহার এবং কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের উপর নির্ভর করে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই চীন তার অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠে সারা বিশ্বের রপ্তানি বানিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠে। তারপর থেকে কিন্তু কমিউনিস্ট শাসিত চীনকে আর কোন দিনই পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

আর এখন কিনা চীনের অধিকাংশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়গুলো নিজস্ব উদ্ভাবনী সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে প্রতি নিয়ত নতুন নতুন প্রযুক্তি পন্য এবং সেবা দেশের সামনে এনে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও গবেষণায় টক্কর দিচ্ছে বিশ্বের এক নম্বর সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। তার পাশাপাশি চীন নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও গবেষণায় ৮০ থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যাচ্ছে প্রতি বছর। বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বের বৈশ্বিক রপ্তানির ৪০% একাই নিয়ন্ত্রণ করে চীন একাই। দেশটির নমিনাল জিডিপির আকার ২০২২ সালের হিসেব অনুযায়ী ১৮.৩২ ট্রিলিয়ন ডলার এবং মাথাপিছু আয় প্রায় ১২,৯৭০ ডলার। যা কিনা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত ৩০টি দেশের সম্মিলিত জিডিপি অপেক্ষা বেশি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্বের বুকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জিডিপি অর্জনকারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। যেখানে ২০২২ সালে আমেরিকার নমিনাল জিডিপি দেখানো হয়েছে ২২.০৪ ট্রিলিয়ন ডলার।

তাছাড়া একক মাস হিসেবে ২০২২ সালের আগস্ট মাসে চীনের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩১৫ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২১ সালের ১২ মাসে চীন সারা বিশ্বে ৩.৩৬ ট্রিলিয়ন ডলারের পন্য রপ্তানি করেছে। আবার ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাস শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩.০২৯ ট্রিলিয়ন ডলার। তাছাড়া ২০২২ সালের হিসেব অনুযায়ী চীনের কাছে প্রায় ২ হাজার টন সোনার বিশাল মজুত রয়েছে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের সময়ের ৯০% গ্রামীন কৃষি নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেড়িয়ে এসে খুব দ্রুত মেগা শিল্প ও উৎপাদন খাত নির্ভর অর্থনীতি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে চীনের জাতীয় অর্থনীতিতে ভারি শিল্প নির্ভর ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান ৯৪.% এবং কৃষির অবদান মাত্র ৫%। আর এখনো পর্যন্ত চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অবিশ্বাস্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।

এখানে প্রকাশ থাকে যে, চীনের এই বৈপ্লবিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলে রয়েছে দেশটির বাস্তব জীবন নির্ভর এবং এক বিংশ শতাব্দীর উপযোগী আধুনিক ভোকেশনাল বা কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা। যা কিনা আজ দেশটিকে পর্যায়ক্রমে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে গেছে। অথচ আমাদের দেশের মতো স্বল্প আয়ের দেশগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত পড়ে রয়েছে সেই পুরনো আমলের মুখস্ত বিদ্যা নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার উপর। তাই এক বিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যে কোন ভাবেই হোক, আমাদের অবশ্যই মূখস্ত বিদ্যা নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেড়িয়ে এসে দীর্ঘ মেয়াদী এক বাস্তব জীবন মুখী কারিগরি শিক্ষা প্রচলন এবং বাস্তবায়নে কাজ করে যেতে হবে। আর এক্ষেত্রে নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে চীনের কারিগরি শিক্ষা পদ্ধতি ও কৌশল আমাদের দেশের জন্য একটি উত্তম দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। তাই চীনের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ৫০% হলেও দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করে দেশের প্রতিটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক বিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাস্তব জীবন নির্ভর কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার কোন বিকল্প কিছু হতে পারে না। কারণ আনাদের দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের প্রায় ৩৫% শিক্ষার্থী তাদের পড়াশোনা সমাপ্ত না করেই শিক্ষা জীবন থেকে হারিয়ে যায়। তাই এ জাতীয় শিক্ষা বঞ্চিত শিশুদের কথা বিবেচনা করে হলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে জীবনে কাজে লাগে এমন বাস্তব কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষা প্রনয়ণ ও পরিকল্পনা মাফিক তা দেশে বাস্তবায়ন করা উচিত।

 

চীনের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোকে যতটা সম্ভব গবেষণামুলক এবং প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অবশ্যই নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের রূপরেখা বাস্তবায়নে প্রযুক্তি নির্ভর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রিসার্চ সেন্টারগুলোতে দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনুযায়ী ফান্ড বরাদ্দ দেওয়ার বিকল্প কিছু হতে পারে না। তাই শুধু নতুন শিক্ষানীতির প্রনয়ণ করা নয় বরং তার সাথে কার্যকরভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।##

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.