পবিত্র রমজান মাসকে সামনে রেখে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয় ইতিবাচকভাবে বৃদ্ধি পেলেও পশ্চিমা বিশ্বে সামরিক উত্তেজনা ও চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দার মুখে রপ্তানি বানিজ্যে কিছুটা ভাটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো’র দেয়া তথ্যমতে, চলতি ২০২৩ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৪.৬৪ বিলিয়ন ডলার। যা কিনা গত ফেব্রুয়ারি মাস অপেক্ষা ২.৪৯% কম। যদিও গত মার্চ মাসে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫.০২ বিলিয়ন ডলার। গত ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ বৈশ্বিক বাজারে পন্য রপ্তানি করে ৫.৩৭ বিলিয়ন ডলার।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে জুলাই’ ২০২২ থেকে মার্চ’২০২৩ পর্যন্ত) বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ৪০.৭১ বিলিয়ন ডলার। তবে রপ্তানি আয়ের বর্তমান প্রবণতা বা ধারা অব্যাহত থাকলেও বাংলাদেশ ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে ১২ মাসে মোট আনুমানিক প্রায় ৫৬ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় অর্জন করতে পারে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো’র দেয়া তথ্য মতে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট রপ্তানি আয় ছিল ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলার এবং একই সময়ে মোট আমদানি ব্যয় ছিল ৮৩.৬৮ বিলিয়ন ডলার।
আসলে স্বল্প আয়ের একটি দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিচারের ক্ষেত্রে শুধু জিডিপি আকার ও হার, মাথাপিছু আয় ইত্যাদি বিবেচনা করলে দেশটির বাস্তব অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে একেবারে সঠিক ধারণা লাভ করা যাবে না। বিশেষ করে এক অর্থবছরের রপ্তানি আয়, বৈদেশিক সেবা খাতের আয় ও রেমিট্যান্সের প্রাপ্তির বিপরীতে মোট আমদানি ব্যয়ের ভারসাম্য ইতিবাচক না নেতিবাচক তা সবার আগে হিসেব করে বিবেচনা করতে হবে। আর এক্ষেত্রে অভার অল ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি থেকে গেলে তা কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জন্য বড় ধরণের আর্থিক ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া স্বল্প আয়ের দেশগুলোর আরেকটি কমন অর্থনৈতিক ঝুঁকি বা সমস্যা হলো বিভিন্ন কৌশলে দেশ থেকে অর্থ বিদেশে পাচার।
বৈদেশিক বানিজ্যে দীর্ঘ মেয়াদে নেতিবাচক প্রবণতা বা ঘাটতি চলমান থাকলে দেশের হাতে থাকা ব্যবহার যোগ্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশাঙ্খাজনহারে হ্রাস পেতে পারে। শেষমেষ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঘাটতি মোকাবেলায় এক রকম বাধ্য হয়ে অন্য কোন দেশ কিংবা আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে শর্ত সাপেক্ষে মোটা অংকের বৈদেশিক ঋন নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। তবে আমাদের সম্মানিত সরকার চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরু থেকে ব্যয় সংকোচন নীতির আওতায় অপ্রয়োজনীয় পন্য আমদানি বন্ধ করা বা শক্ত লাগাম টেনে হলেও অভার অল ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি অনেকটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্যমতে, চলতি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩২.২৬৭ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের (১লা জুলাই থেকে মার্চের ১৭ তারিখ পর্যন্ত) প্রবাসী কর্মীরা বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে মোট ১৫.১৮ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। সে হিসেবে চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট রেমিট্যান্স আয় হতে পারে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার। যদিও গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১.০৩২ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪.৭৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে আসে।
এদিকে ভারতের বৈশ্বিক রপ্তানি বিষয়ক এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারতের মোট রপ্তানি আয় ছিল ৪৪৭ বিলিয়ন ডলার এবং একই সময়ে আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৭১০ বিলিয়ন ডলার। তাছাড়া রিজার্ভ ব্যাংক ইন্ডিয়ার দেয়া তথ্যমতে, চলতি ২০২৩ সালের ৩১শে মার্চের হিসেব অনুযায়ী ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৫৭৮.৪৪ বিলিয়ন ডলার।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে ২০২২ অর্থবছরে পাকিস্তানের মোট রপ্তানি আয় হয় ৩৯.৪২১ বিলিয়ন ডলার এবং তার বিপরীতে মোট আমদানি ব্যয় ছিল ৮৪.১২১ বিলিয়ন ডলার। আর রপ্তানি আয় অপেক্ষা প্রায় ২.৫ গুণ বেশি আমদানি ব্যয় করার জন্য আজ কিন্তু পাকিস্তান একটি দেউলিয়া দেশের খাতায় নাম লিখিয়েছে। অন্যদিকে ২০২২ অর্থবছরে পাকিস্তান ৩১.২৭৯ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স আয় করলেও দেশটির সার্বিক ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘটতি থেকে যাচ্ছে ১৩.৪২ বিলিয়ন ডলার। এদিকে চলতি ২০২৩ সালের ৩১শে মার্চের হিসেব অনুযায়ী পাকিস্তানের সেন্ট্রাল ব্যাংকের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ৪.২০৮ বিলিয়ন ডলার।
আবার উন্নয়নের নামে পাকিস্তান এক দশক আগে থেকে পর্যায়ক্রমে ১২০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋন নিয়ে বসে আছে। যা এখন সুদে আসলে মোট বৈদেশিক ঋনের স্থিতির পরিমাণ প্রায় ১২৮ বিলিয়ন ডলারের সীমাকে স্পর্শ করেছে। আর তাই পাকিস্তান বর্তমানে অন্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋনের আসল ও সুদের কিস্তি পরিশোধের জন্য অত্যন্ত কঠিন ও জটিল শর্তের মুখে অন্য কোন উৎস থেকে বৈদেশিক ঋন নিয়ে কোন রকমে টিকে আছে। আমাদের আরেক বন্ধুদেশ শ্রীলংকার অবস্থাও ঠিক একই রকমের হয়ে গেছে। যা কিনা বিশ্বের অন্যান্য স্বল্প ও মধ্যম আয়ের সকল দেশগুলোর জন্য সচেতন হওয়ার শিক্ষা ও চরম সতর্ক বার্তা বহণ করে।##