--- বিজ্ঞাপন ---

ভারতে করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৩০০ ছুঁই-ছুঁই

বাতিল বহু ট্রেন, অনেকগুলি ঘুরপথে

0

ওড়িশার বালেশ্বরে করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৩০০ ছুঁই-ছুঁই। সেই সংখ্যা ৩০০ পেরিয়েও যেতে পারে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞেরা। শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত রেল সূত্রে বলা হয়েছে, নিহতের সংখ্যা ২৮৮। আহত ৮০০-র উপর। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, এখনও ধ্বংসস্তূপ থেকে দেহাংশ ঝুলছে। ধ্বংসস্তূপের তলাতেও চাপা পড়ে থাকতে পারে অনেক দেহ। ফলে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা। তবে সরকারি ভাবে রেল ‘উদ্ধারকাজ’ শেষ বলে ঘোষণা করেছে। শনিবার থেকেই শুরু হয়েছে পরিষেবা স্বাভাবিক করার উদ্যোগ। তবে তা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ বলেই মনে করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ১০ মে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ১৪৮ জনের। তার অনেক আগে ১৯৯৯ সালের ২ অগস্ট উত্তরবঙ্গের ইসলামপুরের কাছে গাইসালে রেল দুর্ঘটনায় রেলের সরকারি হিসাবে ২৮৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। বালেশ্বরের করমণ্ডল এক্সপ্রেসের এই দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ইতিমধ্যেই তা ছাড়িয়ে গিয়েছে। যদি মৃতের সংখ্যা ৩০০ পেরিয়ে যায়, তা হলে প্রাণহানির নিরিখে এই দুর্ঘটনা পূর্বভারতে সাম্প্রতিককালের মধ্যে সবচেয়ে বড় রেল দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
তদন্তের পরে রেলের প্রাথমিক রিপোর্টে করমণ্ডল দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সিগন্যালে ত্রুটির দিকেই আঙুল তোলা হয়েছে। তবে বিস্তারিত তদন্তে দুর্ঘটনার কারণ আরও স্পষ্ট হবে বলে রেলের আধিকারিকদের একাংশের বক্তব্য। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর এক যৌথ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘‘আপ মেন লাইনে সবুজ সিগন্যাল দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ট্রেনটি সেই লাইনে ঢোকেইনি। ট্রেন ঢুকেছিল লুপ লাইনে। সেখানে আগে থেকে একটি মালগাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। তার সঙ্গে সংঘর্ষে করমণ্ডল এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়।’’ রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ‘‘এর মধ্যে ডাউন লাইন দিয়ে বালেশ্বরের দিকে যাচ্ছিল বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। সেই ট্রেনেরও দু’টি বগি লাইনচ্যুত হয়।’’ কিন্তু মেন লাইনে সবুজ সিগন্যাল পাওয়া সত্ত্বেও করমণ্ডল এক্সপ্রেস কী ভাবে লুপ লাইনে ঢুকে পড়ল, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে সিগন্যাল দেওয়ায় কোনও ত্রুটি হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে অনেকে বলছেন, বন্দে ভারত এক্সপ্রেস নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘অতি সক্রিয়তা’র মাশুল দিতে হচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে ‘সাধারণ’ ট্রেনগুলিকে। বন্দে ভারত তৈরি এবং চালাতে যে ব্যয় হচ্ছে, তার ‘প্রভাব’ পড়ছে রেলের সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণে। তবে এ নিয়ে এখনই কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চাইছেন না। সকলেই বিস্তারিত তদন্ত রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছেন। তবে তা কবে পাওয়া যাবে, তা নিয়ে কেউই নিশ্চিত নন।

হাওড়া থেকে দক্ষিণ ভারতগামী রেল পরিষেবা কবে স্বাভাবিক হবে? এ নিয়ে সরকারি ভাবে রেলের তরফে কিছু জানানো হয়নি। তবে রেলের উদ্ধার সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে যুক্ত এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের একাংশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানিয়েছেন, সোমবারের আগে ধ্বংসস্তূপ পুরোপুরি সরানো সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে রেল পরিষেবা স্বাভাবিক হতে হতে মঙ্গলবার। বস্তুত, এখন রেলের মাথাব্যথা ওই রেলপথে পরিষেবা পুরোপুরি স্বাভাবিক করা নিয়ে। শনিবার থেকেই শুরু হয়েছে সেই কাজ। তবে দুর্ঘটনাস্থলে রেলের লাইন বলতে কিছু নেই। সিমেন্টের স্লিপার ভেঙেচুরে, লোহার রড বেরিয়ে কঙ্কালসার। রেলের একটি সূত্রের দাবি, মঙ্গলবারের আগে ওই পথে রেল পরিষেবা পুরোপুরি স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে আপৎকালীন ভাবে অন্তত একটি লাইন দিয়ে আপ এবং ডাউন লাইনে ট্রেন চালানোর চেষ্টা শুরু হবে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহু মানুষ চিকিৎসার জন্য দক্ষিণ ভারতে যান। পাশাপাশিই বাঙালির অন্যতম জনপ্রিয় তীর্থক্ষেত্র পুরী যাওয়ার সমস্ত ট্রেন বালেশ্বরের উপর দিয়ে যায়। রবিবার স্নানযাত্রা হওয়ায় বহু পুণ্যার্থীর পুরীগামী ট্রেনের টিকিট কাটা ছিল। সে ক্ষেত্রে বহু ট্রেন বাতিল হওয়ায় বড় আর্থিক লোকসানেরও আশঙ্কা রয়েছে। অন্য দিকে, সংরক্ষিত আসনের টিকিট কেটে রাখা যাত্রীরা কী ভাবে নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছনো নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন। অনেকেই বিকল্প উপায়ে গন্তব্যে পৌঁছনোর চেষ্টা করছেন।

বাতিল বহু ট্রেন, অনেকগুলি ঘুরপথে

করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার জেরে শুক্রবারের পর শনিবারেও বাতিল করা হয়েছে অনেকগুলি ট্রেন। সেগুলির মধ্যে অন্যতম হাওড়া-পুরী-হাওড়া বন্দে ভারত এক্সপ্রেস, হাওড়া-সেকেন্দ্রাবাদ ফলকনুমা এক্সপ্রেস, হাওড়া-বেঙ্গালুরু দুরন্ত এক্সপ্রেস, হাওড়া-তিরুপতি-হাওড়া হমসফর এক্সপ্রেস। খড়্গপুর থেকেও বাতিল করা হয়েছে বেশ কয়েকটি ট্রেন। সেগুলি হল খড়্গপুর-খুর্দা রোড এক্সপ্রেস, খড়্গপুর-ভদ্রক-খড়্গপুর মেমু স্পেশাল। হাওড়ার অদূরে শালিমার স্টেশন থেকে শালিমার-পুরী ধৌলি এক্সপ্রেস, শালিমার-হায়দরাবাদ ইস্ট কোস্ট এক্সপ্রেস বাতিল করা হয়েছে। বাতিল হয়েছে জলেশ্বর-পুরী-জলেশ্বর মেমু স্পেশাল, বালেশ্বর-ভুবনেশ্বর মেমু স্পেশাল, বাংরিপোসি-পুরী-বাংরিপোসি সুপারফাস্ট, বালেশ্বর-ভদ্রক-বালেশ্বর মেমু স্পেশাল, ভদ্রক-হাওড়া বাঘাযতীন এক্সপ্রেস, জাজপুর কেওনঝড়-খড়্গপুর মেমু, জনশতাব্দী এক্সপ্রেস, হাওড়া-পুরী-হাওড়া শতাব্দী এক্সপ্রেস, পুরী-আনন্দবিহার নন্দনকানন এক্সপ্রেস, পুরী-পটনা এক্সপ্রেস, বেঙ্গালুরু-গুয়াহাটি সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস, চেন্নাই-শালিমার করমণ্ডল এক্সপ্রেস, পুরী-হাওড়া সুপারফাস্ট, পুরী-শালিমার জগন্নাথ এক্সপ্রেস, পুরী-ভঞ্জপুর স্পেশাল, পুরী-সাঁতরাগাছি স্পেশাল, কন্যাকুমারী-হাওড়া সুপারফাস্ট, দিঘা-পুরী-দিঘা সুপারফাস্ট, বেঙ্গালুরু-কামাখ্যা সুপারফাস্ট, বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট, বেঙ্গালুরু-ভাগলপুর অঙ্গ এক্সপ্রেস। দুর্ঘটনার কারণে বেশ কয়েকটি ট্রেনের রুটও পরিবর্তন করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে সাঁতরাগাছি-চেন্নাই সেন্ট্রাল এসএফ এক্সপ্রেস, দিঘা-বিশাখাপত্তনম এক্সপ্রেস, হাওড়া-মাইসুরু এক্সপ্রেস-সহ একাধিক ট্রেন। জলেশ্বর-পুরী এক্সপ্রেস-সহ বেশ কয়েকটি ট্রেন সংক্ষিপ্ত যাত্রাপথে চলবে।
শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ দুর্ঘটনা ঘটে। তার পর থেকেই বালেশ্বরের পরিস্থিতি ভয়াবহ। যাত্রীদের উদ্ধার করতে রাতভর চলেছে উদ্ধারকাজ। ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন উদ্ধারকর্মী থেকে শুরু করে হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। ছিলেন বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর আধিকারিক থেকে শুরু করে দমকলকর্মীরা। রাতের অন্ধকারেই উদ্ধারকাজ চলছে শনিবার সকাল পর্যন্ত। শুক্রবার সন্ধ্যায় দুর্ঘটনা ঘটার পর ঘটনাস্থলে পৌঁছয় অ্যাম্বুল্যান্স এবং মোবাইল হেল্‌থ ইউনিটের গাড়ি। শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে মোট ২০০টি অ্যাম্বুল্যান্স, ৫০টি বাস এবং ৪৫টি মোবাইল হেল্‌থ ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। লাইনচ্যুত কামরার তলা থেকে যাত্রীদের উদ্ধার করতে গ্যাসকাটার ব্যবহার করা হয়েছে। এগিয়ে এসেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। আহত যাত্রীদের উদ্ধার করে কখনও তাঁদের জলের তেষ্টা মিটিয়েছেন। কখনও রেললাইনের আশপাশে ছড়িয়ে থাকা মালপত্র জোগাড় করে এক জায়গায় জড়ো করেছেন। আহতদের জন্য রক্তদান করতে হাসপাতালে লাইন দিয়েছিলেন বহু মানুষ।

ঘটনাস্থলে মমতা

শনিবার সকালে হাওড়ার ডুমুরজলা থেকে হেলিকপ্টারে করে বালেশ্বরে পৌঁছন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার রাতেই কলকাতা থেকে ঘটনাস্থলে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী নিজে ওড়িশা সরকার এবং রেলের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছিলেন। শনিবার দুর্ঘটনাস্থলে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের পাশে দাঁড়িয়েই রেলের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মমতা। প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মমতা নির্দিষ্ট ভাবে রেলের সমন্বয়ের দিকে আঙুল তুলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘রেলে মনে হয় সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। আরও যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। আরও গুরুত্ব দিতে হবে।’’ প্রত্যাশিত ভাবেই রেলমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি কী কী ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই কথাও বলেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘আমি রেলমন্ত্রী থাকার সময় অ্যান্টি কলিশন ডিভাইস চালু করেছিলাম। কিন্তু এই ট্রেনে (করমণ্ডল) সংঘর্ষ এড়ানোর যন্ত্র ছিল না। থাকলে দুর্ঘটনা ঘটত না।’’ রেলও জানিয়েছে, দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনে ‘কবচ’ পদ্ধতি ছিল না। তবে একই সঙ্গে রেল জানিয়েছে, দু’টি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়নি। পাশাপাশি ধাক্কা খেয়েছে দু’টি ট্রেন। ফলে ‘কবচ’ পদ্ধতি থাকলেও লাভ হত না।

মালগাড়ির ভূমিকা

করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় লাইনে দাঁড়িয়ে-থাকা মালগাড়ির ভূমিকা নিয়ে রেলের তরফে একপ্রকার ‘লুকোচুরি’ খেলা শুরু হয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত রেল মেনে নিল যে, করমণ্ডল এক্সপ্রেস প্রথমে একটি মালগাড়ির পিছনে গিয়ে ধাক্কা মেরেছিল। আগে রেলের একাধিক সূত্রে দাবি করা হয়েছিল, সংঘর্ষে মালগাড়ির কোনও ভূমিকাই নেই! কিন্তু দুর্ঘটনাস্থলের যে সমস্ত ছবি দেখা গিয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক হল মালগাড়ির নীল রঙের ওয়াগনের উপরে করমণ্ডলের ইঞ্জিন উঠে যাওয়া। যা করমণ্ডল এক্সপ্রেস এবং মালগাড়িটি একই লাইনে না থাকলে সম্ভব ছিল না। তবে রেলের তরফে প্রথমে মুখোমুখি সংঘর্ষ তো বটেই, একই লাইনে করমণ্ডল এক্সপ্রেস এবং মালগাড়ি থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বস্তুত, দুর্ঘটনার খবর আনুষ্ঠানিক ভাবে জানাতে গিয়ে কোনও মালগাড়ির কথা উল্লেখই করেনি রেল! অথচ ছবিতে এবং খোলা চোখেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল রেল লাইনের উপর মালগাড়িটির অস্তিত্ব।(সৗজন্যেঃ আনন্দবাজার)

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.