--- বিজ্ঞাপন ---

কোন পথে তুরস্কের অর্থনীতি

0

সিরাজুর রহমান, বিশেষ প্রতিনিধি#

সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এবং পশ্চিমা বিশ্বের ষড়যন্ত্রের শক্ত জবাব দিয়ে অবশেষে তুরস্কের শাসন ভার আবারও নিজ নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হলেন বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী লিডার রেসেপ তায়েপ এরদোয়ান। তবে সেই সাথে বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে দেশটি ব্যাপক সফলতা অর্জন করলেও বৈদেশিক বানিজ্য ও সার্বিক অর্থনৈতিক সূচক ও সক্ষমতা যে খুবই স্থিতিশীল ও শক্তিশালী তা মনে করার কোন কারণ নেই।

সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য মতে, তুরস্ক চলতি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সারাবিশ্বে মোট ১৮.৬৩৫ বিলিয়ন ডলারের পন্য ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম রপ্তানি করেছে। অথচ ঠিক একই সময়ে সারাবিশ্ব থেকে ৩০.৭১৪ বিলিয়ন ডলারের পন্য, প্রযুক্তি ও উৎপাদিত পন্যের কাচামাল সারাবিশ্ব থেকে আমদানি করে। একক মাস হিসেবে দেশটি কিন্তু বাস্তবে চরম মাত্রায় ঝুঁকি ও বানিজ্য ঘাটতির মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে।

তবে ইউকীপিডিয়ার দেয়া তথ্য মতে, তুরস্কের নমিনাল জিডিপির আকার ১.০২৯ ট্রিলিয়ন। তবে দেশটির শুধু নমিনাল জিডিপির আকার ও কথিত মাথাপিছু আয় দেখে খুশি হওয়ার খুব একটা সুযোগ নেই। বিশেষ করে গত ২০২২ সালে তুরস্কের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২৫৪ বিলিয়ন ডলার এবং মোট আমদানির পরিমান ছিল ৩৬৩ বিলিয়ন ডলার। অবশ্য দেশটি অতি সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প খাত থেকে বছরে গড়ে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার আয় করে। যদিও নিজস্ব রেমিট্যান্স আয় বলতে তুরস্কের কিছুই নেই।

তাই বৈদেশিক বানিজ্য ও অভার অল ব্যালেন্স অব পেমেন্টে তুরস্ক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিন্তু বড় ধরণের ঝুঁকি ও ঘাটতির মুখে পড়ে রয়েছে। চলতি ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসের হিসেব অনুযায়ী তুরস্কের সেন্ট্রাল ব্যাংকে ফরেক্স এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ ছিল ৬০.৯ বিলিয়ন ডলার এবং সোনার মজুত ছিল ৫৭২ টন। তাছাড়া গত এপ্রিল শেষে তুরস্কের সার্বিক মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল অবিশ্বাস্যভাবে ৪৩.৬৮ শতাংশ।

চলতি ২০২৩ সালের ৫ই জুনের হিসেব অনুযায়ী তুরস্কের নিজস্ব মুদ্রা লিরা প্রতি ১ ডলারের বিপরীতে ২১.১৫ লিরায় লেনদেন করা হয়। অথচ কিনা ২০১৫ সালে ১ ডলারের বিপরীতে লিরার মান ছিল ২.৭৩ লিরা। আর এ থেকে কিন্তু তুরস্কের নিজস্ব মুদ্রা লিরার মানের চরম বিপর্যয়ের সূচক আভাস দেয়। তাই একটি দেশের শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সক্ষমতা অর্জনই কিন্তু বড় কথা নয়।

তুরস্কের জাতীয় অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দেশটিতে প্রায় এক যুগের অধিক সময় থেকে রিফুজি বা বৈদেশিক শরণার্থী চেপে থাকা। বর্তমানে তুরস্কে প্রায় ৫০ লক্ষ শরণার্থী বিভিন্ন রিফিউজি ক্যাম্পে অবস্থান করছে। এদের জন্য জাতিসংঘ থেকে নিদিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হলেও বাস্তবে তুরস্কের নিজস্ব পকেট থেকে অর্থ ব্যয় করে রিফিউজি পালতে হচ্ছে। যা দীর্ঘ মেয়াদে দেশটির অর্থনীতির জন্য বড় ধরণের ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। তাই নতুন এরদোয়ান সরকারের উচিত হবে পার্শ্ববর্তী সকল দেশের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক ও পর্যায়ক্রমে শরণার্থীদের নিজ দেশে নিরাপত্তার সাথে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া।

সুতরাং একটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক সূচকে তুরস্ক কিন্তু বিশ্বের একেবারে প্রথম সারির দেশের পর্যায়ে পরে না। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশ সৌদি আরব কিংবা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশের কাছে দ্বারস্থ হতে হচ্ছে তুর্কী এরদোয়ান সরকারকে। কয়েক মাস আগেই এরদোয়ান প্রশাসনের অনুরোধে সৌদি আরবের মোহাম্মদ বিন সালমান সরকার প্রায় ৫ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ডলারে তুরস্কের সেন্ট্রাল ব্যাংকে ডিপোজিট করে।

যদিও এটা ঠিক যে, আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের কিছু অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং তার পাশাপাশি গোপন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তুরস্কের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সক্ষমতা মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে আমার কেন জানি মনে হয়, তুরস্কের বর্তমান সম্মানিত এরদোয়ান সরকার বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে বৈশ্বিক কৌশলগত সম্পর্ক ও প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে ব্যাপক সফলতা অর্জন করলেও বাস্তবে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সক্ষমতা সেভাবে নিজ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি।

বর্তমানে অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিচারে তুরস্ক ভারত, রাশিয়া বা চীন তো দূরের কথা সৌদি আরব বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের পর্যায়ে পরে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। আর তাই নতুন এরদোয়ান সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হওয়া উচিত পশ্চিমের বাধা ও ষড়যন্ত্রের শিকল উৎপাটন করে নিজ দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোচন করে কাজ করা। তার পাশাপাশি একটি টেকসই ও অতি সম্ভাবনাময় অভ্যন্তরীণ ম্যানুফ্যাকচারিং, ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, পর্যটন ও রপ্তানি শিল্প খাত নির্ভর শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

এখানে প্রকাশ থাকে যে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯১ সালে ভেঙ্গে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল চরম মাত্রায় অর্থনৈতিক সংকট। তৎকালীন সময়ে সভিয়েত ইউনিয়নের প্রবল প্রতাপশালী ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকার জন্য আমেরিকা খুব সহজেই সভিয়েত সম্রাজ্য বিলুপ্ত করে দিতে সক্ষম হয়। তাই তুরস্ক হোক কিংবা অন্য কোন দেশ, যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, নিজ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সক্ষমতা নিয়ে বিন্দুমাত্র অবহেলা করার কোন সুযোগই নেই।##

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.