কাজী আবুল মনসুর/সিরাজুর রহমান##
গত ২০১৯ সালের দিকে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল বোটানিক গার্ডেনস, কিউ ও স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা উদ্ভিদের উপর গবেষণা করে দেখেন যে, গত ২৫০ বছরে পৃথিবী থেকে প্রায় ৫৭১ প্রজাতির উদ্ভিদ হারিয়ে গেছে বা একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আবার ঠিক একই সময়ের মধ্যেই পশু, পাখি ও সরীসৃপ মিলে বিলুপ্ত প্রাণীর প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ২১৭টি। তাদের গবেষণায় প্রকাশ পায় যে, উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের এই গণ বিলুপ্তির অধিকাংশই ঘটেছে দ্বীপাঞ্চল ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে (ট্রপিক্যাল রেইন ফরেস্ট)। এ দুটি অঞ্চলেই রয়েছে মূলত পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি উদ্ভিদের আবাসস্থল ও আশ্রয়স্থল।
এদিকে আবার পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত ‘অ্যামাজন’ রেইন ফরেস্টের উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের বিলুপ্তি ঘটছে ভয়াবহ গতিতে। ব্রাজিলের ন্যাশনাল স্পেস এন্ড রিসার্চ ইনিস্টিটিউটের দেয়া তথ্য মতে, গত ২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মাত্র ৪ বছরে অ্যামাজন রেইন ফরেস্ট ধ্বংস করা হয়েছে প্রায় ৪৫,৫৮৬ বর্গকিলোমিটার। যা কিনা আয়তনে হবে অনেক দেশ অপেক্ষা বড় একটি অঞ্চল। তার সাথে ইতোমধ্যেই এই মহাবন থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক দুর্লভ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী।
এ অবস্থা চলতে থাকলে চলতি একবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এই মহাবন অ্যামাজনের ৭০ শতাংশ পর্যন্ত একেবারেই চীর বিলুপ্তি হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। তবে আশার কথা হলো যে, পৃথিবীর এই মহাবন ‘অ্যামাজন’ রেইন ফরেস্ট রক্ষায় এবার সচেতন হচ্ছে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো। মূলত কয়েক মাস আগে ব্রাজিলে দক্ষিণ আমেরিকার ৮টি দেশ বলিভিয়া, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, পেরু, সুরিনাম, ভেনিজুয়েলা ও গায়ানা অ্যামাজন মহাবন সুরক্ষায় একত্রে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশেষ করে ‘অ্যামাজন’ রেইন ফরেস্ট একেবারে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে তারা এখনই বাস্তব সম্মত ব্যবস্থা নিতে চান। এজন্য তারা উন্নত দেশগুলোকে পর্যাপ্ত ফান্ড বরাদ্দ দিয়ে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, দক্ষিণ আমেরিকার ‘অ্যামাজন’ রেইন ফরেস্ট আজ থেকে প্রায় ৫৬ মিলিয়ন থেকে ৪০ মিলিয়ন বছর আগে সৃষ্টি হয়েছে। সে হিসেবে এটি অতি প্রাচীন রেইন ফরেস্ট হিসেবে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক রেইন ফরেস্ট নিয়ে এই বিশাল ‘অ্যামাজন’ এখনো পর্যন্ত টিকে রয়েছে। যদিও আজ এটি মানুষের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য আস্তে আস্তে চীর বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
তাছাড়া গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ (জিএফডাব্লিউ) দেয়া তথ্যমতে, গত ২০২২ সালে সারা বিশ্বে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে প্রায় ৪১,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। যা কিনা গত ২০২১ সালে ছিল ৩৭,৫০০ বর্গকিলোমিটার। আর গত ২০২২ সালেই তার আগের বছর অপেক্ষা ১০% অধিক বনাঞ্চল সারা পৃথিবীতে নিধন করা হয়েছে। তবে বিগত দুই দশকে সবচেয়ে বেশি ২০১৬ সালে প্রায় ৬০,০০০ বর্গকিলোমিটারের অধিক বনাঞ্চল নির্বিচারে ধ্বংস করে ফেলেছে মানুষ।
এদিকে নির্বিচারে বনাঞ্চল ধ্বংস করার ফলে মূল যে সমস্যাটি দেখা দিয়েছে তা হলো বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি। বিশেষ করে শুধু গত ২০২২ সালেই বনাঞ্চল ধ্বংস করার ফলে এখানে সঞ্চিত থাকা আনুমানিক ২.৭ গিগাটন কার্বন ডাই অক্সাইড সরাসরি বায়ুমণ্ডলে চলে গেছে। এর এভাবে দীর্ঘ মেয়াদে বায়ুমণ্ডলে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিকর কার্বন ডাইঅক্সাইড (গ্রিন হাউজ গ্যাস) চলে যাওয়ার বিরূপ প্রভাবে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে আমাদের চেনা জানা জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবেশ।
বর্তমানে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রাক ইন্ডাস্ট্রিয়াল যুগ অপেক্ষা গড়ে প্রায় ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। তার সাথে যোগ হয়েছে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে মজুত থাকা ট্রিলিয়ন টন বরফ গলে যাওয়ার মতো ভয়াবহ বিপর্যয়। যা কিনা আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই সমুদ্র পৃষ্ঠের স্বাভাবিক উচ্চতা বৃদ্ধি করে প্লাবিত হতে পারে পৃথিবীর অনেক নিম্নাঞ্চল ও দেশ। আর এ জন্য সরাসরি দায়ী করা হয় ট্রপিক্যাল অঞ্চলের বনাঞ্চল ধ্বংস করে নতুন নতুন শিল্পায়ন ও কৃষি ভিত্তিক খামার গড়ে তোলাকে। যা অবশ্যই যে কোন মূল্যে এই বনাঞ্চল ধ্বংস রুখে দিতে পৃথিবীর সকল দেশকে এক যোগে আজ করে যেতে হবে।##