--- বিজ্ঞাপন ---

বুদ্ধিজীবীর দরপতন

0
আবদুল্লাহ আল ইউসুফ##
শিরোনাম নিয়ে অনেকক্ষণ ভেবেছি। একটা বিকল্প শিরোনাম হতে পারত বুদ্ধিজীবীর জীবনচক্র বা দ্য লাইফ সাইকেল অফ বুদ্ধিজীবী’স।
বুদ্ধিজীবীদের বাজারদরের উত্থান পতনের কথা বিবেচনায় রেখে ‘লাইফ সাইকেল’ শিরোনামটা দেয়াই যেতো। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে অন্য জায়গায়।
এদের চাহিদা প্যারাবোলিক কার্ভের মতো ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে চূড়োয় পৌছে ধীরে ধীরে নেমে যায় না। চূড়োয় পৌছায় ঠিকই ধীরে ধীরে। ওখানে গিয়ে কিছুদিনের জন্য স্থিত হয়। একটা প্ল্যাটিউ ফর্ম করে। এরপরই ধপাস করে পড়ে যায় নীচে, একেবারে পপাত ধরণীতল।
হয়তো দ্য লাইফ হাফ-সাইকেল অফ বুদ্ধিজীবী’স শিরোনামটা মানানসই হতো। কিন্তু শুনতে কেমন শোনায় না? তাই ‘দরপতন’ টাই রাখলাম।
ধরা যাক, একজন বুদ্ধিজীবী একটা প্রোডাক্ট বা মাল (মাল শব্দটাতে কারও আপত্তি থাকলে পড়ুন ‘প্রোডাক্ট’। ইংরেজীতে লিখলেও সমস্যা, বাংলায় লিখলেও সমস্যা। কিয়েক্টাবস্থা!!)।
তো, যে কোন প্রোডাক্ট বা মালের লাইফ সাইকেলে চারটা ধাপ থাকেঃ সূচনা, প্রবৃদ্ধি, পরিপূর্ণতা এবং পতন। চলুন তাহলে, প্রোডাক্ট বা মাল বিবেচনায় একজন বুদ্ধিজীবীর পর্যায়ক্রমিক জীবন চক্র আলোচনা করা যাক।
প্রথমেই সূচনা পর্ব। এই পর্ব বেশ কঠিন। বুদ্ধিজীবীদের প্ল্যাটফর্মে জায়গা করে নিতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়। বেশ লেখাপড়া করতে হয়। গবেষণা করতে হয়। লেখালেখি করতে হয়।
সত্যি বলতে কি, এই পর্বটাই আসলে সবচে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এরা যা শেখার এই পর্বেই শেখে। একবার প্ল্যাটফর্মে জায়গা করে নিতে পারলে এরা আর লেখাপড়া করে না। এরপর থেকে এই পর্বে যা শিখেছে সেটাই বেচে বেচে খায়।
আমি এক দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীকে একটি নিয়ত পরিবর্তনশীল বিষয়ের উপর পর পর পাঁচ বছর একই ফোরামে একই স্ক্রিপ্ট পড়ে শোনাতে দেখেছি। ভাবখানা এমন, যেন ঐ পাঁচ বছরে ঐ বিষয়ের ওপোর আর কোন গবেষণা হয়নি। সূচনা পর্বে উনি যা শিখেছিলেন, দ্যাটস দ্য এন্ড অফ লার্নিং। এরপর আর কিছুই নেই। এরপর শুধুই বিক্রী, এবং বিক্রীত মাল (সরি, পণ্য) ফেরত লওয়া হয় না।
এরপর আসি প্রবৃদ্ধি পর্বে। এই পর্বটা বেশ ট্রিকি। সফল হতে হলে বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হয়। এই পর্বে আপনি কলাম লেখা থেকে শুরু করে টক-শো তে অংশ নেয়ার মতো নানাবিধ প্রচারমূখী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হতে পারেন।
মনে রাখা ভাল, প্রথম দিকে এইসব কাজের জন্য কিন্তু কোন সম্মানী পাবেন না। উল্টো সম্পাদক, সঞ্চালক অথবা আয়োজকদের উৎকোচ দিতে হতে পারে যেন তারা আপনাকে একটা সুযোগ দেন। এ নিয়ে বেশী ভাবলে হবে না। একটু ধৈর্য ধরুন না। প্রবৃদ্ধি সম্পন্ন হলে টাকা আসা শুরু করবে।
যেটা বলছিলাম, এই পর্বটা বেশ ট্রিকি। লেখা বা কথা বলার সময়ে শব্দচয়নে আপনাকে বেশ কুশলী এবং সাবধানী হতে হবে। যেমন ধরুন, কেউ রাত দিন পড়ে পড়ে ঘুমায়। তাকে কি উপাধি দেবেন? উঁহু, তাঁকে অলস বা অকর্মণ্য বলা যাবে না। বলতে হবে ‘স্বপ্নদ্রষ্টা’। ‘নির্মাণ’ শব্দটা কেমন বালসূলভ মনে হয় না? বলতে হবে ‘বিনির্মাণ’। ভুলেও কখনো ‘পতিতা’ বলবেন না, বলবেন ‘যৌনকর্মী’।
আর হ্যাঁ, রেফারেন্স দেবেন সব বিদেশী মনিষীদের। তবে ভুলেও কিন্তু কোর’আন বা হাদীসের রেফারেন্স দেবেন না। খবরদার! তাহলেই শেষ। প্রগতিশীল সমাজে প্রবেশের দুয়ার আপনার জন্য চিরদিনের জন্য বন্ধ।
ইংরেজী অথবা হিন্দী রেফারেন্স হলে ভাল হয়। সবচে বেশী কার্যকর হচ্ছে স্বামী বিবেকানন্দের রেফারেন্স। বলার সময় একটু টেনে টেনে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে হবে। স্বামী বিবেকা—নন্দ। এইভাবে। যেন শুনেই বিবেকের মধ্যে একধরনের আনন্দ অনুভূত হয়।
স্বামীজী কিভাবে যে বুদ্ধিজীবী মহলে এতোটা গ্রহনযোগ্যতা পেলেন সে সম্পর্কে আমার কোন ধারনা নেই। উনার রেফারেন্স এতোটাই কার্যকর যে আপনি যে কোন উদ্ধৃতিকে তাঁর নামে চালিয়ে দিতে পারেন।
‘স্বামী’ শব্দটার প্রতি মহলবিশেষের বিশেষ রকমের দুর্বলতা আছে বলেই মনে হয়। ইদানীং সোস্যাল মিডিয়াতে দুষ্ট লোকেরা প্রায়ই স্বামী-স্ত্রীর রেফারেন্স দিচ্ছে।
স্কুল জীবনে একদিন শিক্ষককে নিরীহভাবে প্রশ্ন করেছিলাম, স্যার, স্বামী বিবেকানন্দ কি সবার স্বামী? সবাই উনাকে স্বামী বলে কেন? শিক্ষক মহোদয় দাত খিচিয়ে বলেছিলেন, আরে বুদ্ধু, এই স্বামী সেই স্বামী নয়, এর মানে হচ্ছে প্রভূ।
পেছন থেকে আর এক কাঠি সরেস, দুষ্টু আরেক বালক জানতে চাইলো, স্যার, ম্যাডাম কি আপনাকে প্রভূ ডাকে? স্যার ডাস্টার ছুড়ে মারলেন। লাগেনি। দুষ্টুটা ক্যাচ ধরে ফেলসে।
যাই হোক, কৌমার্য বিসর্জন দেয়ার পরে জেনেছি, সব প্রভূই স্বামী হয়, কিন্তু সব স্বামী প্রভূ হয় না। কেউ কেউ ভৃত্যও হয় বটে। ভাই, এইটা কিন্তু আমার কোট। বিবেকানন্দের বলে চালানোর চেষ্টা করলে কিন্তু কপিরাইট মেরে দিবো, হ্যাঁ।
এরপর যেন কি? ও হ্যাঁ, পরিপূর্ণতা পর্ব। মাখন খাওয়ার সময়। প্রবৃদ্ধি সম্পন্ন হয়েছে। আপনি মোটামুটি বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন। এবার আপনার নিলামে ওঠার সময়। বিভিন্ন মহল বিভিন্ন দর হাঁকবে। হুট করে রাজী হয়ে যাবেন না কিন্তু।
এটাই কিন্তু আপনার প্রথম এবং শেষ সুযোগ। একবার আপনার রেট ফিক্সড হয়ে গেলে কিন্তু আর দাম উঠবে না, বরং কমার সম্ভাবনা শতভাগ। কাজেই প্রচুর দর কষাকষি করতে হবে। প্রয়োজনে দু এক বছর অপেক্ষা করুন। আরও কিছু টক-শো করুন, পরিচিতি বাড়ান, মার্কেট ভ্যালু বাড়ান।
মনে রাখবেন, এই পর্যায়ে আপনার আর দরদাতাদের সম্পর্ক অনেকটা তামাক-চাষি আর ব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোব্যাকোর মতো। জানেন তো, কোন জমিতে একবার তামাক চাষ শুরু করলে সেখানে কিন্তু আর কোন ফসল ফলানো যায় না।
তামাক-চাষি যেমন নগদ টাকার লোভে একবার তার ধানী জমিতে তামাক চাষ শুরু করলে আর ফিরে আসার পথ পায় না; পরের বছর গুলোতে কোম্পানী যে দাম ধরে দেয়, সে দামেই তাঁকে বাধ্য হয়ে উৎপাদিত তামাক বিক্রী করতে হয়; আপনিও তেমনি একবার বুদ্ধিজীবী হিসেবে কোন বিশেষ ‘ঘরানার’ দলভূক্ত হয়ে পড়লে কিন্তু পরে আর ফ্লোর-ক্রস করতে পারবেন না। বিশ্বাস যোগ্যতা হারাবেন।
পরিপূর্ণতা বা ম্যাচিওরিটি পর্বে আপনি অনেকটা ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরের মতো হয়ে পড়বেন। তাহলেই ভাবুন। ঋত্বিক রোশন যদি এখন মাউন্টেন ডিউ ছেড়ে প্রাণ ম্যাংগো জুসের অ্যাড দেয়া শুরু করে, কেউ খাবে? ভাববে, আরে, এই লোক তো ভুয়া! একবার বলে এইটা ভালো, আরেকবার বলে ওইটা! আপনিও তেমনি দরপতনের কারনে এক ঘরানা থেকে সুইচ করে অন্য ঘরানার পক্ষে বুদ্ধি বিক্রী করা শুরু করলে মার্কেট হারানোর ঝুকিতে পড়বেন।
অবশ্য বাঙ্গালীর স্মৃতিশক্তি বেশ দুর্বল। আপনি গতকাল কি বলেছেন, আর আজ কি বলছেন, সে দুটোর তুলনা করে আপনাকে জাজ করার মতো স্মৃতি বা মেধা বেশীরভাগ বাঙ্গালীরই নেই। তবে কারও কারও তো আছে। ঐ দুর্জনেরা কিন্তু সবাইকে মনে করিয়ে দিতে পারে। কাজেই ঝুকি না নেয়াই ভাল।
যাই হোক সুবিধেমতো একটা দাম দর ঠিক করে কোন এক ঘরানার হয়ে বিবৃতি দিতে থাকুন, যতোদিন পারেন। মাখন-জুস খেয়ে নিন। পরিনতির কথা ভেবে আর কি হবে? এরপর তো পতন পর্ব। ওটা শুরু হবার আগেই আখের গুছিয়ে নিন।
হ্যাঁ, অবশেষে পতন বা ট্র্যাজেডি পর্ব। যে পথে এতোদূর এসেছেন, সে পথের শেষ মাথায় খাঁদ, একেবারে সোজা নীচে নেমে গেছে। পতন অবধারিত। ঠেকাবার উপায় নেই।
আপনার কঠোর সাধনায় লব্ধ জ্ঞান যাদের স্বার্থে বিক্রী করে দিয়েছেন, যাদের পক্ষে বিবৃতি দিয়ে প্রশংসা, অর্থ এবং সম্মান কুড়িয়েছেন এতোদিন, তাদের হাত এখন অনেক শক্তিশালী। আপনিই করেছেন, আপনারাই করেছেন। ওদের বিচরণ এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে।
ওদের জন্যে যে সম্পদের পাহাড় আপনারা গড়ে দিতে সাহায্য করেছেন, তা দিয়ে এখন ওরা বিদেশী বুদ্ধিজীবীদের বিবৃতি কেনার সামর্থ্য রাখে। ওখানেও কতো কতো বুদ্ধিজীবীরা বসে আছে না বিক্রী হবার জন্যে! টাকা দিয়ে মার্ক, ক্রিস্টোফার, চার্লস আর রোজ দের বিবৃতি কিনতে পারলে ওরা কি আর আপনার মতো আবুলের বিবৃতির কেয়ার করে?
তা মার্ক আর চার্লসদের আপনার মতো ডিগ্রী থাকুক বা না থাকুক, ওদের নামগুলোতেই কেমন প্রভূ প্রভূ গন্ধ আছে না? আর যদি সে সোনালী চুলের কোন মহিলা বুদ্ধিজীবী হয়, তাহলে তো কথাই নেই। আপনার সময় শেষ।
আর সবচে বড় কথা, আপনার ঘটে যে বিদ্যেটুকু ছিল, ঐ যে কয়েক যুগ আগে যেটা সূচনা পর্বে আহরণ করেছিলেন, সেটা তো সেই কবেই শেষ। আর তো লেখাপড়া করেননি। এক জিনিষ আর কতো বিক্রী হবে। বাজারে নতুন মাল এসেছে না?
অন্য ঘরানায় নাম লেখাবেন? সম্ভব না। আদর্শিক ব্যাপারটা না হয় বাদই দিলেন। ইউজড মালের দাম কি থাকে তেমন? আর আপনার যে ব্র্যান্ড, রি-সেইল ভ্যালু নাই বললেই চলে। পতন, পতন। বিকল্প নেই আর।
পতন কি ঠেকানো যেতো না? অবশ্যই যেতো, যদি আপনি ভিন্ন পথে হাটতেন। আপনার পতন তো সেদিনই শুরু, যেদিন আপনি নিজেকে নিলামে তুলেছিলেন।
যারা নিলামে ওঠেনি, বিক্রী হয়নি, তাদের দরপতন নেই। তারা টিকে থাকে সারাজীবন, বেচে থাকে মৃত্যুর পরেও। এমন অনেকেই আছেন। আশে পাশে তাকিয়ে দেখুন। অনেক আছে। তাদের জন্য শ্রদ্ধা, শুভ কামনা।##
আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.