--- বিজ্ঞাপন ---

আর জি কর হাসপাতাল কান্ডে উত্তাল ভারত

0

বিশেষ প্রতিনিধি#
ভারতের কলকাতার আর জি কর হাসপাতাল। বলা হয়, এ হাসপাতালটি এশিয়ার প্রথম বেসরকারী হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৮৬ সালে! এই হাসপাতাল ঘিরে উত্তাল এখন ভারত। গত ৮ আগষ্ট ৩১ বছর বয়সী এক তরুনী ডাক্তারকে ধর্ষণ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যাকান্ডের যে বিবরণ ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে এসেছে তাতে মনে হয়েছে কোন সুস্থ মস্তিকের মানুষ এমনতর কান্ড করতে পারে না।
কলকাতার একটি গণমাধ্যমের রিপোর্ট ছিল এ রকম.‘ গত ৮ আগস্ট নাইট ডিউটি ছিল ওই তরুণী চিকিৎসকের। রাতে আরও বেশ কয়েকজন ছিলেন। অনলাইনে খাবার অর্ডার করেন। একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করেন সকলে। তার পর যে যার মতো বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবে জরুরী বিভাগে চার তলার সেমিনার হলে ঘুমিয়ে পড়েন তরুণী চিকিৎসক। মায়ের সঙ্গে শেষবার ওই সেমিনার হল থেকে ফোনে কথা বলেন তিনি। ৯ আগস্ট সকালে জরুরী বিভাগের চারতলার সেমিনার হলে তাঁর দেহ উদ্ধার হয়। সেই সময় প্রায় বিবস্ত্র ছিলেন তিনি। তরুণী চিকিৎসকের দেহে একাধিক ক্ষতচিহ্নও ছিল। প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হয়, ধর্ষণ করে খুন করা হয় তাঁকে।’ পুলিশ ঘটনার পর পরই অভিযানে নামে। হত্যাকান্ডের ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয় সারা ভারতে। বিশেষ করে কলকাতায় চলে ব্যাপক আন্দোলন। হাসপাতালে ভাংচুর। ধরা হয় অন্যতম সন্দেহভাজন সঞ্জয় রায় নামের একজনকে। ভারতের গণমাধ্যমে এই সঞ্জর সম্পর্কে লেখা হয়, ‘নারীদের উপর নির্যাতনের পর্ন ভিডিও। এগুলিই ক্রমে বিশেষ পছন্দের হয়ে উঠেছিল সঞ্জয়ের। তাই ধর্ষণের সময় মহিলা চিকিৎসকের উপর নারকীয় অত্যাচার করে সঞ্জয়। এমনকী, ধর্ষণের আগে ওই তরুণীর যৌনাঙ্গে তাঁর চুলের ক্লিপ দিয়ে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। তাঁর যৌনাঙ্গের কাছ থেকেই উদ্ধার হয়েছে সেই ক্লিপটি। ধর্ষণের আগে ও পরে তরুণী চিকিৎসকের উপর চরম অত্যাচার চালায় সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়। এমনকী চিকিৎসককে খুন করার পরও তাঁর উপর অত্যাচার চালানো হয়। তাঁর কোমরের হাড়েও বড় ধরনের আঘাত রয়েছে। তদন্ত চলাকালীন পুলিশের অভিমত, আর জি কর হাসপাতালের চারতলায় সেমিনার হলের দরজা বন্ধ করে প্রায় ২৫ মিনিট ক্রমাগত সে অত্যাচার চালিয়ে যায় ওই তরুণী চিকিৎসকের উপর। ধর্ষণের পর যুবতীর দেহের ভিডিও ও ছবি অভিযুক্ত তুলে রেখেছিল কি না, তা মোবাইলের সূত্র ধরে জানার চেষ্টা হচ্ছে। পুলিশের এক আধিকারিক জানান, চিকিৎসক খুন ও ধর্ষণে মূল অভিযুক্ত সঞ্জয় রায় যে অত্যন্ত বিকৃত মানসিকতার, এটাই তার প্রমাণ।’
সারা বিশ্বের কাছে ভারত এখন ধর্ষনের দেশ বলে পরিচিতি লাভ করছে। ধর্ষণ কান্ডের কারনে ভারতে মহিলা পর্যটক আসা কমে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশী পর্যটকও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আর জি কর হাসপাতালের এ ঘটনার পর বর্হিঃবিশে^ ভারতের ইমেজ আবারো নানা প্রশ্নের সম্মুখিন হচ্ছে। ভারতে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত কেউ না কেউ ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। কিছু প্রকাশিত হলেও বেশিরভাগ রয়ে লোক চক্ষুর অন্তরালে। আর জি করের এ ঘটনা নাড়া দিয়েছে ভারতবাসীকে। ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে বিক্ষোভ। বাংলাদেশেও হচ্ছে বিক্ষোভ। প্রশ্ন উঠেছে ভারতে কেন বার বার ধর্ষণকান্ড হচ্ছে। কেন নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। এর জবাব দেবে কে? তাহলে কি ভারত নারীদের জন্য বিপদ সঙ্কুল দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি হচ্ছে?
ভারতে এ রকম ঘটনা নতুন নয়। ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এদিন দিল্লীতে একটি পাবলিক বাসে ২৩ বছর বয়সী এক ছাত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ঐ ছাত্রীর সাথে থাকা পুরুষ বন্ধু রড দিয়ে মেরে মারাত্মক জখম করা হয়। কিশোরী ছাত্রীর স্পর্শকাতর স্থানে রড দিয়ে এমন অবস্থা সৃষ্টি করা হয় যার ফলে ঘটনার কয়েকদিন পর মৃত্যু ঘটে। এ সময় রাজধানী দিল্লীর মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। অনেক দিন ধরে চলেছিল বিক্ষোভ। সরকার ও বিরোধী দলের সবাই এক বাক্যে অপরাধীদের বিচারের জন্য সোচ্চার হলে ৬ অপরাধী ধরা পড়ে। এদের মধ্যে একজন ১৭ বছরের কিশোরও ছিল। প্রবল প্রতিবাধের মুখে ২০২০ সালে ৪ জনের ফাসিঁ হয়। একজন নিজ থেকে আত্মহত্যা করে। বিচারের দীর্ঘসুত্রতার কারনে এসব ঘটনা সাধারনত শেষ হয় না। ২০১২ সালের পর ২০১৩ সালেও ভারতের মুম্বাইতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। মুম্বাই এর ২২ বছর বয়সী এক নারী সাংবাদিককে একই কায়দায় গনধর্ষণ করে একদল দুবৃত্ত। ঐ নারী সাংবাদিক দক্ষিণ মুম্বাইয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে এক পুরুষ সহকর্মীর সাথে। এ ঘটনার পরও শুরু হয়েছিল আন্দোলন সংগ্রাম। ঘটনার ৯ বছর পর ৫ জন আসামীর মধ্যে তিনজনকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হলেও পরবর্তিতে ভারতের মৃত্যুদন্ড আইনের নতুন প্রণীত বিধিমালায় যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়। ২০১৬ সালের ২৯ মার্ট ১৭ বছর বয়সী এক দলিত মেয়ের লাশ পাওয়া যায়। তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে হোস্টেলের পানির ট্যাঙ্কে ফেলে দেয়া হয়। পরে হোস্টেলের ওয়ার্ডেন, শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক এবং অধ্যক্ষকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ঘটনাটি রাজনৈতিক হয়ে উঠলে অপরাধীদের অপরাধ অনেকাংশে ঢাকা পড়ে যায়। ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারী জম্মু ও কাশ্মীরের কাঠুয়ার কাছে রাসানা গ্রামে ৮ বছর বয়সী নাবালিকা আসিফাকে ধর্ষণ ও খুন করা হয় । ঘটনার পর আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হলে ঘটনাটি জাতীয় সংবাদে পরিণত হয়। এ ঘটনাকেও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এভাবে ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে প্রতিদিন কোন না কোন ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলেছে।
অনুসন্ধান মতে, ভারতের মহিলাদের ক্ষেত্রে ধর্ষণ এখন চতুর্থ সর্বাধিক সাধারণ অপরাধ। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর বার্ষিক রিপোর্ট মতে, ২০১৯ সালে সারা দেশে ৩১,৬৭৭টি, ২০২০ সালে ২৮,০৪৬টি, ২০২১ সালের ৩২,০৩৩টি মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছে। তার মানে প্রতিদিন গড়ে ৮৬টি মামলা রুজু করা হয়েছে। ২০২১-এর পরিসংখ্যান অনুসারে, ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে রাজস্থানে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, তারপরে মধ্যপ্রদেশ এবং উত্তর প্রদেশ। মেট্রোপলিটন শহরগুলির মধ্যে, জাতীয় রাজধানী দিল্লিতে ২০২১ সালে সর্বোচ্চ ১,২২৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। জয়পুরে সর্বোচ্চ ধর্ষণের হার ছিল প্রতি লাখে জনসংখ্যার ৩৪টি। মেট্রোপলিটন শহরগুলির মধ্যে কলকাতায় ধর্ষণের ঘটনা সবচেয়ে কম হলেও ২০২৪ সালের আর জি কর কান্ডের ফলে কলকাতা আবারো শিরোনাম হয়ে উঠে।
কলকাতায় মর্মান্তিক এ ঘটনার পেছনে অনেকগুলো রহস্য বেরিয়ে আসছে। ভারতীয় গণমাধ্যম বলছে, আর জি কর হাসপাতালে, ‘জাল ওষুধ হাসপাতালে ঢুকছে এবং দিনের পর দিন নির্দ্বিধায় তা-ই ব্যবহার হচ্ছে জেনে ফেলা? মেডিক্যাল বর্জ্য থেকে সিরিঞ্জ, রক্তের পাউচ-সহ নানা জিনিস বিক্রির কালোবাজারি ধরে ফেলা? সেই মেডিক্যাল বর্জ্য থেকেই রাসায়নিক আলাদা করে মাদক কারবারে কাজে লাগানোর চক্র চলছে জেনে ফেলা? না কি হাসপাতালের হস্টেল, ক্লাসরুমে যৌন-চক্রের প্রতিবাদ করা? ঠিক কোনটা কাল হল আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিহত চিকিৎসকের? এই প্রশ্ন এখন তুলছেন ওই হাসপাতালের সঙ্গে যুক্তদের অনেকেই। মৃতার এক সহপাঠী বলেন, “মৃতদেহ যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, এটা নারকীয় অত্যাচারের উদাহরণ। যে ভাবে মারা হয়েছে, যে অত্যাচার করা হয়েছে, সেটা কারও উপর তীব্র রাগ না থাকলে কেউ করে না!” কিন্তু এত রাগ কেন? অনেকটা কেচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতো নানা কাহিনী বেরিয়ে আসছে যা শিউরে উঠার মতো। কলকাতার ঘটনায় উঠে আসছে সৌমিত্র বিশ্বাস নামে এক ডাক্তারের নাম। আরজি করের হস্টেল থেকে সৌমিত্রের মৃতদেহ উদ্ধার হয় ২০০১ সালের ২৫ আগষ্ট। চিকিৎসকদের দাবি, তাঁর ঝুলন্ত মৃতদেহ দেখে আত্মহত্যা ধরে নিয়ে তদন্ত চালায় পুলিশ। কিন্তু সৌমিত্রের পরিবার খুনের অভিযোগ দায়ের করে। কলকাতা হাই কোর্ট সিআইডি তদন্তে নির্দেশ দেয়। আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল, এই মামলায় বেশ কয়েকটি দিক খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। চিকিৎসকদের দাবি, মূল দিকটি ছিল হাসপাতালের মধ্যে যৌন-চক্র। এক চিকিৎসকের দাবি, “সেই সময়ে আমি আরজি করের ছাত্র। আমরা জানতাম সৌমিত্রের মৃত্যু শুধুই আত্মহত্যা নয়। হাসপাতালের ক্লাস ঘর, সেমিনার রুম বা হস্টেলে সেই সময়ে যৌনকর্মী নিয়ে আসা হত। যৌনকর্মীদের দিয়ে ভিডিয়ো শুট করানো হত। এর পর সেই ভিডিয়ো ছড়িয়ে দেয়ার চক্র চলত। তৎকালীন হাসপাতালের কর্তারা সবই জানতেন। এমনও হত, যৌনকর্মী জোগাড় করতে না পারলে ব্যবচ্ছেদের জন্য রাখা মৃতদেহের সঙ্গেই যৌনতা চলেছে। সেই ভিডিয়োয় মৃত মানুষটির মুখের জায়গায় বসানো হত কোনও অভিনেত্রীর মুখ। এর পর ছড়িয়ে দেয়া হতো সেই ভিডিয়ো। কর্তৃপক্ষ সব জানতেন।” আর এক চিকিৎসকের দাবি, “মেডিক্যাল কলেজে পড়তে আসা মেয়েদের মুখের ছবি কেটে নিয়ে বসানো হত ভিডিয়োর যৌনকর্মীর মুখে। সৌমিত্রের এক বান্ধবীর সঙ্গেও এমন ঘটে। তাঁর জন্মদিনের কেক কাটার ছবি থেকে মুখ কেটে নিয়ে বসানো হয়েছিল একটি ভিডিয়োয়। সৌমিত্র প্রতিবাদ করলে কত রকম ভাবে যে ওকে শেষ করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত সৌমিত্র আত্মহত্যা করেছিলেন না কি তাঁকে খুন করা হয়েছিল, স্পষ্ট হয়নি।”
আর জি কর হাসপাতালে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও খুন হওয়া এ চিকিৎসকও আত্মহত্যা করেছেন বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছিল। পরে নানা কান্ডে ধরা পড়ে তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। অনেকে মিলে এ কাজটি করেছে। এই নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার যে বিবরণ বের হচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করা আসলে কঠিন।##

 

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.