কাজী আবুল মনসুর::
চট্টগ্রাম সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব সৃষ্টি। পাহাড়, সাগর, হ্রদ, নদী এ প্রধান ৪টি জিনিষের সমন্বয় পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। চট্টগ্রামকে বলা হয় সুন্দরের লীলাভুমি। চট্টগ্রাম নামটি নিয়েও রয়েছে নানা রহস্য। এখানে আবার পীর আউলিয়াদের পদচারনা ছিল বলে ঐতিহাসিকরা বলেন।
‘সিন্ধু মেখলা ভূধরস্তনী, রম্যানগরী চট্টলা, অয়ি বরাঙ্গি, শ্যামলা-শোভন নিবিড় কাননকুন্তলা, বাড়ব ঘোড়ারে বাঁধিয়া রেখেছ দুয়ারে তোমার সুন্দরী বক্ষে পুষিছ দিব্য অনল করাল শিখাঠি সংবরি…’। এভাবেই চট্টগ্রামের সৌন্দর্যের কথা তুলে ধরেছিলেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। চট্টগ্রামের নামকরণের ইতিহাস অসম্পূর্ণ ও প্রহেলিকায় ভরা। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, চট্টগ্রাম অঞ্চলটি খুবই প্রাচীন। পৌরণিক যুগ থেকে আবাসভূমির অযোগ্য এ চট্টগ্রামে অনেক স্বাধীন রাজবংশ রাজত্ব করেছে। তারা আবার কালের গর্ভে বিলীনও হয়ে গেছে। এখানে মনুষ্য বসতির পত্তনও হয়েছে একাধিকবার। তাই এর আদি নাম বা চট্টগ্রামের নামকরণের ইতিহাসটিই গভীর অন্ধকার ও রহস্যজালে আবৃত।
বিখ্যাত জিওগ্রাফিক্যাল ডিকশনারি অব এনসেন্ট ইন্ডিয়া গ্রন্থে প্রত্নতত্ত্ববিদ নন্দলাল দে চট্টগ্রামের আদি নাম চট্টলা এবং ফুল্লগ্রাম বা পুষ্পগ্রাম বলে উলেল্গখ করেন। প্রাচীন অনেক গ্রন্থে চট্টল শব্দ থেকে এ অঞ্চলের নাম ‘চট্টলা’ হয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে। যেমন চূড়ামণি তন্ত্রে আছে, ‘চট্টলে দক্ষ বাহুর্যে ভৈরব চন্দ্রশেখর। ব্যক্তরূপা ভগবতী ভবানীতন্ত্র দেবতা’। আবার ‘বরাহতন্ত্রে’ উল্লেখ আছে_ ‘চট্টলে দক্ষিণে বাহু ভৈরব চন্দ্রশেখর। সূর্য্যের কটিদেশস্থো বিরূপাক্ষা মহেশ্বর।’ অনেক ইতিহাসবিদ একমত, পৌরাণিক যুগ থেকে চট্টগ্রামের নাম ছিল ‘চট্টলা’। প্রাচীনকালে চট্টভট্ট নামে একটি জাতি এ অঞ্চলে বসতি করার সময় চট্টলা নাম দেয় বলেও কেউ কেউ মনে করেন। ১৩৪৫ বঙ্গাব্দে সত্যবার্তা নামে একটি ম্যাগাজিনে এক লেখক ‘বাংলায় ভ্রমণ’ শীর্ষক এক কাহিনীতে এ অঞ্চলের নাম সপ্তগ্রাম থেকে চট্টগ্রাম হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। ওই লেখক ঐতিহাসিক সূত্র টেনে বলেন, ‘কারও কারও মতে সপ্তগ্রাম থেকে লোক এসে এখানে উপনিবেশ স্থাপন করায় তারা এ স্থানের নাম রাখেন সপ্তগ্রাম এবং পরে রূপান্তরিত হয়ে সপটগ্রাম, সপড্গ্রাম বা চট্টগ্রামে পরিণত হয়।’ অনেক ইতিহাসবিদের মতে, বৌদ্ধরা এ অঞ্চলের নাম চট্টগ্রাম রেখেছে। তাদের যুক্তি হলো, এখানে অনেক চৈত্য বা বৌদ্ধ মঠ ছিল বলে এ অঞ্চলের নামকরণ চৈত্যগ্রাম করা হয়। পরবর্তীকালে যা রূপান্তর হয়ে হয় চট্টগ্রাম।
আরাকান রাজ ষোলসিংহ চন্দ্র নিজ রাজ্যের উপকণ্ঠে থুর থুনকে পরাজিত করে ৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম অধিকার করেন। দিগ্গি্বজয়ের স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ চট্টগ্রামে তিনি একটি বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করেন। যাতে লেখা ছিল ‘চিৎ-ত-গৌং’। এ আরাকানির ভাষার বাংলা অর্থ হলো_ ‘যুদ্ধলব্ধ স্থান’। পণ্ডিত ও বৌদ্ধরা এখনও মনে করেন ওই ‘চিৎ-ত-গৌং’ থেকেই এসেছে চট্টগ্রাম। পৌরাণিককালে চট্টগ্রামে বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য চৈত্যগ্রাম নির্মিত হয়েছিল। চীন পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ যখন সিল্ক রোড ধরে চট্টগ্রাম আসেন তখন এর অনেক স্মৃতি তিনি তার গ্রন্থে তুলে ধরেন। ওই গ্রন্থে তিনি চৈত্য শব্দের অর্থ বৌদ্ধ বিহার এবং গ্রাম শব্দের অর্থ ‘সমূহ’ বলে উল্লেখ করেন। আবার অনেক ইতিহাসবিদের মতে চট্টগ্রামের নাম একসময় ছিল কর্ণফুলী। প্রাক ইসলামী যুগে আরব বণিকরা বাণিজ্য করার লক্ষ্যে ভারতীয় দ্বীপাঞ্চলে আসতে শুরু করলে এ অঞ্চলটি তাদের নজরে পড়ে। তখন থেকে আরব সংস্কৃতির সঙ্গে এ অঞ্চলের অধিবাসীদের সংযোগ ঘটে। বিখ্যাত এক আরব কবি তার লেখায় এ অঞ্চলকে যেভাবে তুলে ধরেন বাংলায় এর অর্থ দাঁড়ায়_ ‘লঙের সুগন্ধি ভারাক্রান্ত প্রবাহিত প্রাচ্য মলয়সম।’আরব লেখক ‘ইদ্রিসি’ ১২০০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের নাম ‘কর্ণফুলী’ বলে উল্লেখ করেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স-কাউন্সিল একজন চিফের অধীন এলাকা রূপে ইসলামাবাদকে গড়িয়া তুলিতে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রাম নামও ক্রমে অধিকতর সুস্পষ্ট রূপে চালু হইয়া যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথমদিকের কাগজপত্রে ইসলামাবাদ বা চট্টগ্রামকে দেশ বা প্রদেশ রূপে উল্লেখ করা হইয়াছে।’ এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোনসের মতে, ‘এ অঞ্চলের সুন্দর ক্ষুদে পাখি ‘চট্গা’ থেকেই চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি।’ তাই বলা চলে চট্টগ্রামের নামকরণের বিষয়টি এখনও প্রহেলিকাময়।##১৭.১০.২০