কাজী ফেরদৌস:
এই নামটি কি কখনো শুনেছেন? ইহুদিদের ক্লাব মনে হলেও আসলে এটি একটি গুপ্ত সংগঠন যার নেপথ্যে আছে আন্তর্জাতিক ইহুদি চক্র!কিন্তু তথ্য জগৎ তন্নতন্ন করে খুঁজে ও তাদের সম্পর্কে সঠিক কোন ধারণা পাওয়া যাবেনা বিশেষ করে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে।এমন গোপনীয় তাদের তৎপরতা। বলা হয়ে থাকে এটা অনেকটা Friendship & Fraternity Organisation যারা শুদ্ধাচার চর্চা করে এবং মানুষ কে উচ্চতর মানবিক মর্যাদায় উন্নীত করাই এদের কাজ।এর আড়ালে আসলে প্রকৃত উদ্দেশ্য টা কি সেটা জানা খুবই কঠিন। এটার মূল চালিকা শক্তি কিন্তু আন্তর্জাতিক ইহুদি সংঘ। কিন্তু কি কারণে খৃষ্ট জগতের অনেক জ্ঞানীগুনী মানুষ এর সংস্পর্শে এসেছিলেন সেটা বুঝা বড় কঠিন।
বর্তমানে বাংলাদেশে কোন প্রকাশ্য ম্যাসন কার্যক্রম নেই, কোন লজ ও নেই।যা আছে তা অত্যন্ত গোপনীয় কিছু বনেদি ক্লাব ভিত্তিক। যেমন চট্টগ্রাম ক্লাবের একজন সাবেক সভাপতি আমাকে বলেছিলেন তাদের ক্লাবে ম্যাসন লজ নামে একটা এক্সক্লুসিভ গ্রুপ আছে ।চট্টগ্রামের বহুজাতিক কোম্পানি গুলোর স্হানীয় প্রধান কর্মকর্তা ও চট্টগ্রামের গুটিকয়েক এলিট এর সদস্য। তারা সপ্তাহে একবার মিলিত হয়।খায় দায় আমোদ ফুর্তি করে এতটুকুই তিনি জানেন। আমি এদের আন্তর্জাতিক ইহুদি কানেকশন এর কথা বললে ভদ্রলোক বিব্রত বোধ করতে থাকলে আমি আর কথা বাড়াই নি।এরকম প্রায় প্রত্যেকটি বনেদি ক্লাবের মধ্যে এধরনের গোপন লজ আছে বলে মনে করা হয়।তবে ঢাকার সবচেয়ে পুরাতন লজ টি ছিল পুরানা পল্টন মোড়ে।১৯১৯ সালে পুরানা পল্টনের মোড়ে প্রতিষ্ঠিত দুতলা দালানে এই লজটি ইহুদি ক্লাব নামে পরিচিত ছিল যেটা এখন ভুমি মন্ত্রনালয়ের প্রধান হিসাব রক্ষন কর্মকর্তার কার্যালয়ের অফিস। এর আগে রমনা এলাকার তহসিল অফিস ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির গােড়ার দিকে ঢাকায় শ দু’এক ইহুদি পরিবার ছিল বলে জানাযায়। তারা এই ক্লাবে সন্ধ্যায় মিলিত হতেন।স্হানীয় মানুষ এটার আশেপাশে ঘেঁষতে শাহস করতো না।১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ ও ১৯৬৭আরব ইসরায়েল যুদ্ধের পরে রহস্যজনক ভাবে ঢাকার ইহুদিরা ভারতে চলে যেতে শুরু করে। সেখান থেকে তারা ইউরোপ আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে ।বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ক্লাবটি একসময় বন্ধ হয়ে যায়।১৯৮০ সালে বাদবাকি ইহুদিরা ঢাকা ত্যাগ করে কোলকাতা চলে যাবার সময় ক্লাবের ভবন টি তারা সরকারের কাছে হস্তান্তর করে যায়।
ঢাকায় একসময় ইহুদিদের হোটেল রিজ নামক একটি বনেদি হোটেল ছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে।এখানেই তখন সরকারি বেসরকারি অনুষ্ঠান গুলো হত।পঞ্চাশের দশকে সেটার মালিকানা পরিবর্তন হয়ে Rex Restaurant নাম ধারণ করে বিখ্যাত হয়েছিল এবং বহুবছর টিকে ছিল। ঢাকা টেলিভিশন এর প্রথম অনুষ্ঠান ঘোষকও সংবাদ পাঠক ছিলেন ম্যাসন সদস্য ইহুদি মর্ডিকোহেন।তাঁর সহকারী ছিলেন মাসুমা খাতুন যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভয়েস অব আমেরিকায় যোগ দেন।কোহেন এর আগে রাজশাহী বেতারে সংবাদ পাঠক ছিলেন। তিনি সাগিনা মাহাতো এবং নবাব সিরাজুদ্দৌলা ছবিতে অভিনয় ও করেছিলেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ফিলিপ হার্টগ ও ছিলেন একজন ইহুদি এবং ম্যাসন সদস্য। চল্লিশের দশকে আরও একজন ইহুদি ঢাবি শিক্ষক ফ্রীম্যাসনের সদস্য ছিলেন। এর আগে তিনি রবিঠাকুরের শান্তি নিকেতনে শিক্ষক ছিলেন।
আসলে ফ্রিম্যাসনের কার্যকলাপ এত গোপনীয় ও নিখুঁত আপনি নিজে বুঝতেই পারবেন না আপনি কখন এদের জালে আটকে গেছেন। ষাটের দশকে কোন একটা কাগজে পড়েছিলাম পাকিস্তানের অনেক বড় বড় সামরিক বে সামরিক আমলারা নিজের অজান্তে কখন এদের জালে জড়িয়ে পড়েছেন তাঁরা নিজেরা ও জানতে পারেন নি।ওদের সঙ্গ ছেড়ে বের হলে ও বিপদ আছে। মৃত্যুর ভয় আছে। অথবা আপনার জীবনের এমন কোন গোপন তথ্য ফাঁস করে দেবে যে আপনার মানসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। অতএব সবাই চুপসে যায়।তাহলে বুঝুন কত ভয়ংকর এদের তৎপরতা।আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বা সিনেট নির্বাচন ঘনিয়ে আসলে দেখা যায় কোন না কোন প্রার্থীর নামে গোপন কোন স্ক্যান্ডাল ফাঁস হয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে যাচ্ছে। এসবই হচ্ছে ইহুদিদের কাজ।তারা যাকে টার্গেট করে তার সর্বনাশ করেই ছাড়ে।তাই আমেরিকার সকল পর্যায়ের নির্বাচনে প্রার্থীরা ইহুদি লবীর ভয়ে তটস্থ থাকে।ওরা প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির গোপন তথ্য খুব গুরুত্ব সহকারে সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করে। আর এসব করে তাদের বিভিন্ন গুপ্ত সংগঠনের মাধ্যমে যার অন্যতম হচ্ছে ফ্রীম্যাশন।
এদের সম্পর্কে জানা খুব কঠিন। কারন তথ্যের অভাব। সারা পৃথিবী তন্নতন্ন করে খুঁজে ও পাবেন না কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য। এজন্য ওদের লক্ষ্য ওউদ্দ্যেশ্য জানা কঠিন। যাকিছু এদের সম্পর্কে বলা হয় সব আন্দাজ অনুমান ভিত্তিক। এজন্য ইহুদিরা এসব তথ্য কে Antisemitic /Anti Masonic Propaganda বলে উড়িয়ে দেয়। তবে রোমান ক্যাথলিক চার্চ এদের সম্পর্কে অবগত আছেন বলে জানা যায়। প্রোটেস্টান্ট খৃষ্টান ও চার্চের সাথে তাদের সম্পর্ক ভাল বলে মনে হয়। ইংল্যান্ডে প্রটেস্টান্ট চার্চের প্রসারএর সাথে সাথে ইহুদিদের প্রভাব ও বহু গুণ বেড়ে যায়। ইংল্যান্ডের সাথে সাথে তাদের কলোনি যুক্তরাষ্ট্রে ও এদের প্রভাব বেড়ে যায়।তবে ফরাসী বিপ্লবের পর ইংল্যান্ডে তাদের উপর কড়া নজরদারী ছিল।কারন ফরাসী বিপ্লবের পেছনে ইহুদীদের নেপথ্য ইন্ধন ছিল বলে ধারনা প্রচলিত আছে।ক্যাথলিক চার্চের ধারনা তারা নৈরাজ্যবাদ ও নাস্তিকতা চর্চা করে এসব ব্যাপক আকারে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়ে একটা নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে সমগ্র মানব সভ্যতাকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়ে একসময় সমগ্র পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ এদের মূল লক্ষ্য।মুসলিম পণ্ডিতরা ও এমন ধারণাই পোষণ করেন ।এদের পবিত্র গ্রন্থে এরকম প্রতিশ্রুতি নাকি ইশ্বর তাদের দিয়েছে যে একসময় সমগ্র পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ তাদের কব্জায় চলে আসবে।তারাই পৃথিবীতে ইশ্বরের মনোনীত এবং শ্রেষ্ঠ জাতি গোষ্ঠী। বর্তমান বিশ্বে ইহুদিদের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা কি সেই ধরনের কোন ইঙ্গিত বহন করে?
১৯৭২ সালে জুলফিকার আলি ভুট্টাে পাকিস্তানে এদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে দেয়।ইরাকে সাদ্দাম হোসেন ও ওদের নিষিদ্ধ করেছিলেন।এমনকি ম্যাসন কার্যক্রমে কেউ যুক্ত হলে তাদের মৃত্যুদণ্ড দিতেন।সাদ্দাম তাঁর পরিনতি কি ভোগ করেন নি? গাদ্দাফি, মুরসী সবার পরিনতির কারণ ও আন্তর্জাতিক ইহুদি চক্র। ইরানে এখন মেসনের প্রবেশ একরকম অসম্ভব।শুরু থেকে আন্তর্জাতিক ইহুদি চক্র ইরানের ইসলামী বিপ্লব ধ্বংসের তৎপরতায় লিপ্ত।পঞ্চাশ দশক থেকে পৃথিবীর প্রথম ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান ছিল ইহুদীদের প্রথম হিট লিষ্টে।তবে এখন ইরান এক নম্বরে পরে তুরস্ক পাকিস্তান ও কাতার। তবে অনেক মুসলিম রাষ্ট্র খবর ও রাখেনা এই ভয়ংকর সংগঠন সম্পর্কে। মনে হয় বাংলাদেশের সরকারের কেউ এদের নাম জানে কিনা সন্দেহ আছে!
ভারতে ফ্রীম্যাসন-
তবে ভারতে এখন ওদের রমরমা অবস্থা।ভারতে এদের কার্যক্রম শুরু হয় বৃটিশ শাসনের শুরুর পর ১৮৮৪ সালে কোলকাতা গ্রান্ডলজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন ইহুদি ডেন ব্রাউন ও অশ্বিনী সেঙ্গী নামক এক হিন্দু।পরে বম্বে শহ আরো অনেক শহরে লজ প্রতিষ্ঠিত হয়।ভারতের বিভিন্ন শহরে এখন ৩৮০ টি লজ সক্রিয় আছে যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করে দিল্লির গ্রান্ডলজ।
স্বামী বিবেকানন্দ নাকি প্রথম ভারতীয় ফ্রীম্যাসন।১৮৮৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী ২১ বছর বয়সী নরেন্দ্রনাথ দত্ত নামক একযুবক ম্যাসন সদস্য পদ গ্রহণ করে এবং পরবর্তী তিন মাসে অবিশ্বাস্য ভাবে তাঁকে গ্রান্ড ম্যাসন পদে অভিষিক্ত করা হয়।পরবর্তী নয় বছরে সেই যুবক স্বামী বিবেকানন্দ নামে বিশ্ব ব্যাপী ভারতীয় দর্শনের একজন অবিসংবাদিত পণ্ডিত রুপে আবির্ভূত হন।১৮৯৩ সালে আমেরিকা সফর ও সেখানে তাঁর বক্তৃতামালার সকল আয়োজন নাকি ফ্রীম্যাসনই করেছিলেন।ভারতের পরবর্তী উল্লেখযোগ্য ম্যাসন সদস্যদের মধ্যে পণ্ডিত মতিলাল নেহেরু, রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ ও ফখরুদ্দীন আলী আহমেদ এর নাম আছে। ভারতে বর্তমানে এদের সদস্য সংখ্যা নাকি প্রায় ত্রিশ হাজার।আমেরিকার পরে পৃথীবির আর কোথায় ও ম্যাসনের এত সদস্য আর নেই মনে হয়।
সারা পৃথিবীতে এখন ষাট লক্ষ বা ছয় মিলিয়ন সদস্য আছে বলে তাদের দাবি।
মুসলিম বিশ্বে ম্যাসনের প্রকাশ্য কার্যক্রম অত্যন্ত সীমিত। এর কারণ ইহুদি ধর্মীয় জনগোষ্ঠী সম্পর্কে মুসলমানদের অতি সতর্কতা ও স্পর্শকাতরতা।একমাত্র তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক ও তার বিপ্লবী পরিষদের ১১ সদস্য ছাড়া আর কোন মুসলিম ফ্রীম্যাসনের সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ নেই। বৃটিশ ও ইহুদি চক্রের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে কামাল তুরস্কের ওসমানী খেলাফত ধ্বংস করে সেকুলার তুরস্ক গঠন করে এবং ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন।মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্র কে স্বীকৃতি দেন।
ম্যাসনের সদস্য পদ গ্রহণ ও সহজ নয়।কোন একজন পুরাতন সদস্য কারও নাম প্রস্তাব করলে অনেক যাচাই বাছাই করে সদস্য পদ দেওয়া হয়।একেক দেশের জন্য সদস্য হবার যোগ্যতা বা ক্রাইটেরিয়া একেক রকম।কোন কোন দেশে নির্দিষ্ট ধর্মীয় গ্রুপের মধ্যে সদস্য পদ সীমাবদ্ধ থাকে।তবে সদস্য পদ ত্যাগ বা তথ্য ফাঁস করার মত কাজের জন্য বড় মূল্য বা খেসারত দিতে হতে পারে।১৮২৬ সালে ডেভিড মরগ্যান নামক একজন আমেরিকান খৃষ্টান অতি কৌশলে একেবারে ম্যাসনের গুপ্ত চক্রে ঢুকে পরে তাদের অনেক গোপন রহস্য জেনে যায়।তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এসব তথ্য নিয়ে সে বই লিখে বাজারে ছাড়বে।এটা জানতে পেরে ম্যাসন খুব বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যায়।এরপর তাঁকে অপহরণ করে গুম করে ফেলে। তাঁর আর কোন হদিস পাওয়া যায় নি।এই ঘটনায় ম্যাসন তাদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করলেও আমেরিকায় তাদের কার্যক্রম ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। ইংল্যান্ডে ও এখন তাদের কর্মকাণ্ড সন্দেহের চোখে দেখা হয়।জুডিশিয়ারি ও পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ প্রাপ্তদের ম্যাশন কানেকশন থাকলে তা প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছ বর্তমান বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য বদলাতে এবং নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার সৃষ্টির পেছনে গোপন তৎপরতার সাথে ফ্রীম্যাসন জড়িত বলে অনেকের ধারণা।প্রায় হাজার বছর এর বেশি সময় ধরে তারা এই লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। অর্থোডক্স মুসলিম পণ্ডিত গন এমনকি খৃষ্টান অর্থোডক্স চার্চ ও মনে করে ম্যাসনের গোপন এজেন্ডা হলো তাদের প্রতিশ্রুত মসিহা বা ত্রানকর্তার আবির্ভাব এর পথ পরিস্কার করা এবং এর মধ্যেদিয়ে পুরো বিশ্বের উপর ইহুদি তথা ইজরায়েলীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই তাদের মিশনের চুড়ান্ত লক্ষ্য।
নাসিরাবাদ, চট্টগ্রাম।
২২/৮/২০২০