মার্কিন এভিয়েশন জায়ান্ট লকহীড মার্টিন কর্পোরেশনের অস্ত্র বাজার জমজমাট

কাজী আবুল মনসুর / সিরাজুর রহমান

করোনার কারনে বিশ্বে অস্ত্র বাজার কিছুটা নমনীয় থাকলেও এখন পুরোদমে আবার শুরু হচ্ছে। বাড়ছে যুদ্ধের আশঙ্কা। বিশেষ করে ইসরাইল-ফিলিস্তিনের মধ্যে পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে। মাথা ঘামানো শুরু করেছে বিশ্বের অনেক দেশ। এই ফাকেঁ ব্যবসার বাজার আবারও পুরোদমে খুলেছে মার্কিন অস্ত্র নির্মাতা লকহীড মার্টিন কর্পোরেশন। এই লকহিড মার্টিন (ইংরেজি: Lockheed Martin) একটি মার্কিন অ্যারোস্পেস, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা কোম্পানি। ১৯৯৫ সালের মার্চে লকহিড কর্পোরেশন ও মার্টিন ম্যারিয়েট্টা কোম্পানির সংযুক্তির মাধ্যমে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সদর দপ্তর ম্যারিল্যান্ডে। এতে ১১৬০০০ মানুষ কাজ করে। লকহিড মার্টিন বিশ্বের অন্যতম সর্ববৃহৎ অস্ত্র বিক্রেতা। এটি পাঁচটি অংশের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করে।বিশ্ব জুড়ে লকহিড পণ্যের মধ্যে রয়েছে ট্রাইডেন্ট ক্ষেপণাস্ত্র, পি-৩ অরিয়ন, এফ-১৬ ফ্যালকন, এফ-২২ র‍্যাপ্টর, সি-১৩০ হারকিউলিস, এ-৪এআর ফাইটিংহক এবং ডিএসসিএস-৩ উপগ্রহ।

আন্তর্জাতিক সূত্র জানায়, মার্কিন এভিয়েশন জায়ান্ট লকহীড মার্টিন কর্পোরেশন চলতি ২০২১ সালের ১৩ই মে বিশ্বের অত্যন্ত ব্যয়বহুল ১.৫৩ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট জয়েন্ট স্টাইক এফ-৩৫ লাইটনিং-২ স্টিলথ জেট ফাইটারের ২০০ তম ইউনিট আন্তর্জাতিক ক্রেতার কাছে হস্তান্তর সম্পন্ন করেছে। এই প্রজেক্টের মূল মালিকানা বা অংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হলেও বিশ্বের মোট আটটি দেশ রয়েছে এফ-৩৫ লাইফ টাইম অংশীদার হিসেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি যুক্তরাজ্য, নরওয়ে, ইতালী, নেদারল্যাণ্ডস, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক এবং কানাডা এই প্রজেক্টের অংশীদার এবং প্রযুক্তি সরবরাহকারী। তাছাড়া সারা বিশ্বের আরো ৬টি দেশ যেমন ইসরাইল, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, পোল্যাণ্ড, সিঙ্গাপুর এবং বেলজিয়াম হচ্ছে এফ-৩৫ এর অগ্রধিকার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক ক্রেতা। এদিকে আবার মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত হতে যাচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ক্রেতা। তারা ২৩ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রেখেছে ৫০টি এই জাতীয় এফ-৩৫এ স্টিলথ জেট ফাইটার ক্রয়ের জন্য।

তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীতে এ মুহুর্তে ১৮৪টি এফ-৩৫এ সিরিজের, ইউএস মেরিন কর্পোস এ ৮১টি এফ-৩৫বি সিরিজের এবং ইউএস নেভীতে ১৮টি এফ-৩৫সি সিরজের এডভান্স স্টিলথ জেট ফাইটার সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে মার্কিন নেভীর এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ারের জন্য আরো মোট ২৩৬টি নতুন এফ-৩৫সি, মেরিন কর্পোসের জন্য ১০টি এবং বিমান বাহিনীর জন্য আরো মোট প্রায় তিন শতাধিক এফ-৩৫এ সিরিজের জেট ফাইটার অর্ডার দেয়া রয়েছে। যা আগামী ২০৩০ সালের মধ্যেই সরবরাহ করা হবে। অথচ এদিকে রাশিয়া তাদের পঞ্চম প্রজন্মের এসইউ-৫৭ স্টিলথ জেট ফাইটারের প্রডাকশন লাইন চালু করলেও ফাণ্ডের অভাবে বিগত এক দশকে ১০টির বেশি এই জাতীয় জেট ফাইটার সার্ভিসে আনতে পারেনি।

তাছাড়া মাল্টি-নেশন এফ-৩৫ প্রজেক্টে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের পর তুরস্ক ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং প্রযুক্তি সরবরাহকারী দেশ। ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই প্রজেক্ট থেকে আনুমানিক ১৬টি এফ-৩৫ জেট ফাইটার পাওয়ার কথা ছিল এবং প্রথম ব্যাচে তুরস্কের চাহিদার ভিত্তিতে এবং বিশেষভাবে কাস্টমাইজড করা ৮টি এফ-৩৫এ সিরিজের এডভান্স স্টিলথ জেট ফাইটার তৈরি সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। তবে রাশিয়া থেকে তুরস্কের এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সংগ্রহের বিবাদে জড়িয়ে পূর্বের মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসন এফ-৩৫ সরবরাহ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয় এবং চলতি ২০২১ সালের শুরুতে বর্তমান মার্কিন বাইডেন প্রশাসন এই প্রজেক্ট থেকে তুরস্কের পার্টারশীপ বাতিলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তুরস্ককে অফিসিয়ালী জানিয়ে দেয়। তাছাড়া চুক্তি মোতাবেক ২০১৯ সাল থেকেই বেশকিছু তুর্কী পাইলট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লকহীড মার্টিনের ট্রেনিং ফ্যাসালিটিতে এফ-৩৫ পরিচালনার প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করলেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

যা হোক তুরস্ক কিন্তু ইচ্ছে করলে ২০২০ সালের মধ্যে ৮টি এই জাতীয় এফ-৩৫ জেট ফাইটার হাতে পাওয়ার পর রাশিয়া থেকে এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ের বা সংগ্রহের বিষয়টি নিশ্চিত করলে কোন অসুবিধা হতো বলে মনে হয় না। তাছাড়া অল্প সংখ্যক এফ-৩৫ তুরস্কের হাতে চলে আসলে সেক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরবর্তীতে যথেষ্ঠ চাপে থাকত এবং তুরস্ক নিজেই ব্যাপকভাবে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটানোর সুযোগ পেত। যেমন ভেনিজুয়েলা এখনো পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-১৬ জেট ফাইটার ব্যবহার করে। কোন এক সময় ভেনিজুয়েলার সাথে মার্কিন প্রশাসনের সম্পর্ক চরম অবনতি হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেনিজুয়েলার বিমান বাহিনীতে থাকা এফ-১৬ এর প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় এবং অপগ্রেডিং করতে অস্বীকার করে। তবে ভেনিজুয়েলা তাদের হাতে থাকা এফ-১৬ রাশিয়া কিংবা চীনের হাতে তুলে দেবার হুমকী দিলে পরবর্তীতে আমেরিকা তাদের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও গোপন কিছু শর্ত দিয়ে ভেনিজুয়েলার এফ-১৬ আপগ্রেডেড করে দেয় এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ সরবরাহ করতে বাধ্য হয়।

তবে একটা বিষয় জানা দরকার যে, এফ-৩৫ এর দাম যাই হোক না কেন এর পার আওয়ার অপারেটিং কস্ট অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বর্তমানে এফ-৩৫ স্টিলথ জেট ফাইটারের মূল্য ৯০ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হলেও এর পার আওয়ার অপারেটিং কস্ট ৩৬ হাজার ডলারের কাছাকাছি এবং স্টিলথ ক্যাপাবিলিটি ধরে রাখার জন্য নিদিষ্ট একটি সময় পর পর আবশ্যিকভাবে এর এয়ার ফ্রেমে গোপন কোটিং দেয়া খুব জটিল এবং অস্বাভাবিক রকমের ব্যয়বহুল হয়ে যায়। তাই আপাতত উন্নয়নশীল কোন দেশের পক্ষে প্রতিনিয়ত সাদা হাতি পালার মতো এই ধরণের ব্যয় মেটানো মোটেও সহজ কোন কাজ হবে বলে মনে হয় না।

বিশ্বের অস্ত্র নির্মাতামার্কিন অস্ত্র বাজারমার্কিন লকহীড প্রতিষ্ঠানলকহীড কোম্পানিলকহীডের অস্ত্র
Comments (০)
Add Comment