গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশে

পুরোদমে এগিয়ে চলছে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের কাজ। আগামী ২০২৬ সালে বিশাল এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। কাজটি শেষ হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। কারন গভীর সমুদ্র বন্দরের অভাবে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং বন্দরের মাধ্যমে। প্রতি বছর এই আমদানি রফতানি বাণিজ্য সামলাতে জাহাজ ভাড়া বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা চলে যায়। মাদার ভেসেল (বৃহদাকার কন্টেনার জাহাজ) চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে না পারার কারনে বাংলাদেশের সাথে বিশে^র বাণিজ্য উপরোক্ত তিন দেশের সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে হয়ে থাকে। যেহেতু বাংলাদেশে মাদার ভেসেল নোঙ্গর করতে উপযুক্ত গভীরতা নেই সেহেতু বিপুল টাকা দেশে থেকে চলে যাচ্ছে জাহাজ ভাড়া খাতে। মাতারবাড়ী সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশ বহুল আকাংখিত এ অভাব পূরণ করতে পারে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশের সোনাদিয়ায় ৪২ হাজার কোটি টাকায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মানের বিলাস বহুল একটি প্রকল্প প্রথমে হাতে নেয়া হয়। পরে দেখা যায় এটি দেশের কোন কাজে আসবে না। পরে পায়রা বন্দরকে গভীর সমুদ্র বন্দর হিসেবে তৈরির সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এ প্রস্তাবও দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না বলে বিশেষজ্ঞ মতামত আসে। এক পর্যায়ে মাতারবাড়িতে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের পাশাপাশি গভীর সমুদ্র নির্মানের আলোচনা শুরু হয়। মাতারবাড়ীতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের জন্য নির্মান করা হয় জেটি। গত ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রথম বৃহদাকারের বাণিজ্যিক জাহাজ ‘এমভি ভেনাস ট্রায়াস’ পণ্য নিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আসে। দেখা যায় গভীর সমুদ্র বন্দরের জন্য যে গভীরতা দরকার তার সবকিছু এখানে আছে এবং সহজেই জাহাজ ভীড়ছে একর পর এক। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিগুলোতে সমুদ্রগামী জাহাজ হ্যান্ডলিং করার পর বন্দর কর্তৃপক্ষ গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মানের বিষয়ে চুড়ান্তভাবে সিদ্ধান্তের কথা সরকারকে জানায়। নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয় সার্বিক বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলের মতামত জানতে চাইলে এখানে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মান করার বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত মেলে। বিদ্যুৎ প্রকল্প করতে গিয়ে যে পরিমান ড্রেজিং করতে হয়েছে তাতে সহজেই ১৪ থেকে ১৬ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভীড়তে পারছে। সমুদ্রের নাব্যতা বেড়ে যাওয়ার কারনে এটি সম্ভব হয়েছে। দেশে গভীর সমুদ্র বন্দর না থাকার কারনে বিদেশ থেকে এলপিজি বা এলএনজি আনতে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা চলে যায়। সিঙ্গাপুরের মাধ্যমে এগুলো দেশে আনা হয়। যেখান থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টন মাল আনতে পাঠাতে হয় ১০টি ছোট জাহাজ। প্রতি টনে যেখানে খরচ হয়ে পড়ে ৫০ থেকে ৬০ ডলার। বর্তমানে এলপিজি নিয়ে জাহাজ আসছে সরাসরি।
সূত্র জানায়, জাপান সরকার মাতারবাড়িতে ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজটি শুরু করে। এর সফলতার কারনে এ প্রকল্পের পাশাপাশি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কাজও শুরু হয়। মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিকভাবে ১৮ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এরই মধ্যে ১৩ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা ঋণ দেবে জাপানী উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা দেবে। ২ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এবং ২ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা অন্যান্য সংস্থা থেকে সংস্থান করা হবে বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহাজাহান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্র বন্দরটি ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমদানি-রপ্তানি কেন্দ্রে পরিণত হবে। স্বপ্নের গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পের কাজ পুরোদমে চলছে। প্রকল্পটি আগামী ২০২৬ সালে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি প্রতিবেশী দেশের বন্দরগুলোর মধ্যে মাদার ভেসেলের জন্য এই অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্¦পূর্ণ ফিডার পোর্টের খ্যাতি অর্জন করবে।’
সূত্র মতে, পুরোদমে মাতারবাড়ি বন্দর চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভ‚মিকা রাখবে। পরিসংখ্যান বলছে গভীর সমুদ্র বন্দর জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে ২ থেকে ৩ শতাংশ অবদান রাখবে। একই সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের উপর থেকে চাপ কমবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে ৩২ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করে। ২০৩৩ সালের মধ্যে এ ক্ষমতা দাড়াবে ৪০ লাখ টিইইউএস এ। চট্টগ্রাম বন্দরের পক্ষে এটি সামাল দেয়া কঠিন। তাছাড়া ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলো যদি চট্টগ্রাম বন্দর এই সময়ের মধ্যে পুরোদমে ব্যবহার করে তাহলে সামাল দেয়া আরও কঠিন হয়ে দাড়াবে। তাই বন্দরকে সমুদ্র বন্দর নির্মানের আগে সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। বিশ^ পরিস্থিতির সাথে সাথে বর্তমানে বাংলাদেশের সামুদ্রিক যোগাযোগ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জানা গেছে, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষে পুরোদমে কাজ শুরু করেছে জাপানী কোম্পানি “জাইকা’। সমুদ্র বন্দর নির্মানের লক্ষে ১ হাজার ২২৫ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিগুলোতে সাধারনত মাত্র ৯.৫ মিটার ড্রাফ্ট বিশিষ্ট জাহাজ বার্থ করতে পারে। তবে সম্প্রতি ১০ মিটার ড্রাফটের একটি জাহাজ ভেড়ানো হয়েছে। কিন্ত এসব জাহাজ ৮০০ থেকে সর্বোচ্চ ২৪০০ টিইইউস কন্টেইনার বহন করতে পারে। এগুলো দিয়ে মাদার ভেসেলের কাজ সম্ভব না। বাংলাদেশ থেকে কন্টেনার নিয়ে এসব জাহাজ সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং এ যায়। এখান থেকে মাদার ভেসেল এ ইউরোপ-আমেরিকায় পণ্যগুলো পাঠানো হয়। কারণ একটি মাদার ভেসেলের ধারণ ক্ষমতা ৮০০০ থেকে ১০ হাজার টিইইউএন কন্টেনার। মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মান হলে ৮ হাজার টিইইউস এর বেশি সক্ষমতা সম্পন্ন কন্টেইনার বহনকারী জাহাজ নোঙ্গর করতে পারবে। সহজেই আসতে পারবে বৃহদাকার কন্টেনার জাহাজ। এখান থেকে পণ্য নিয়ে আর ছুটতে হবে না সিঙ্গাপুর, কলম্বো আর মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং বন্দরে।##

কক্সবাজারগভীর সমুদ্র বন্দরচট্টগ্রাম বন্দরমহেষখালীমাতারবাড়ী
Comments (০)
Add Comment