সিরাজুর রহমান#
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং গবেষণায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে ব্যাপক আকারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। বিশেষ করে সুপার কম্পিউটিং এবং অতি উচ্চ প্রযুক্তির নতুন প্রজন্মের কোয়ান্টাম কম্পিউটার ডিজাইন এবং ডেভেলপমেন্টে চীন বর্তমানে এক নতুন উচ্চতায় উঠে গেছে। মূলত চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ইউএসটিসি) একদল গবেষকের তৈরি ঝুচংঝি-৩ (Zuchongzhi 3.0) হচ্ছে হাইস্পিড গতির ১০৫ কিউবিটস (qubit) সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম প্রসেসর উন্মোচন করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জুচংঝি-৩ নামে পরিচিত ইউএসটিসির কোয়ান্টাম প্রসেসরে ১০৫ কিউবিটস এবং ১৮২টি কাপলার রয়েছে এবং এটি পরীক্ষামূলকভাবে র্যান্ডম কোয়ান্টাম সার্কিট স্যাম্পলিং কাজে ইতোমধ্যেই এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করেছে। যা কিনা বর্তমানে প্রচলিত থাকা অতি উন্নত ক্লাসিক্যাল সুপার কম্পিউটারের তুলনায় ন্যূনতম ১০¹⁵ গুণ বেশি শক্তিশালী এবং দ্রুত গতির প্রসেসর হবে বলে দাবি করেছেন গবেষকেরা। যা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ক্ষেত্রে একটি বিশাল অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
চীনের গবেষকেরা দাবি করেন যে, তাদের আবিষ্কৃত জুচংঝি ৩.০ (১০৫-কুইট সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম প্রসেসর) ইতোমধ্যেই মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটি অত্যন্ত জটিল গাণিতিক সমস্যা বা গণনামূলক কাজ সম্পন্ন করেছে। এই একই কাজ সমাধান করতে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ‘ফ্রন্টিয়ার’ সুপার কম্পিউটার এর আনুমানিক ৬.৪ বিলিয়ন বছর সময় লাগবে। যদিও চীনের গবেষকদের এহেন দাবি অনেকটাই আনুমানিক প্রেডিকশনের উপর ভিত্তি করে হয়ত উপস্থাপন করা হয়ে থাকতে পারে।
চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ইউএসটিসি) এর উদ্ভাবিত এই সুপারকন্ডাক্টিং প্রসেসরটির নামকরণ করা হয়েছে প্রাচীন চীনা গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিদ জু চংঝি এর নাম অনুসারে। যিনি চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ঝুচংঝি-৩ সুপারকন্ডাক্টিং প্রসেসরটি ৩২-স্তরের র্যান্ডম কোয়ান্টাম সার্কিট স্যাম্পলিং টাস্কের মাধ্যমে এখনো পর্যন্ত প্রায় ৮৩ কিউবিটস (qubit) পর্যন্ত সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। যা কোয়ান্টাম কম্পিউটেশনাল সুবিধা (কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি) অর্জনের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই প্রজেক্টের সাথে সম্পৃক্ত গবেষক দলটি দাবি করে যে, ঝুচংঝি-৩ সুপারকন্ডাক্টিং প্রসেসর এমন সব অভাবনীয় জটিল সমস্যা সমাধান করতে পারে যা বর্তমানে প্রচলিত থাকা ক্লাসিক্যাল সুপার কম্পিউটারগুলির পক্ষে যুক্তিসংগত সময়ে মধ্যে একই সমস্যা সমাধান করা এক কথায় প্রায় অসম্ভব বলা চলে। আর ১০৫ কিউবিটস (qubit) সক্ষমতা সম্পন্ন এই কোয়ান্টাম প্রসেসরের প্রযুক্তির জগতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এটি আমেরিকার টেক জায়ান্ট গুগলের ৫৩ কিউবিটস (qubit) সাইকামোর প্রসেসরের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং দ্রুত গতিসম্পন্ন হবে।উচ্চ প্রযুক্তির এই কোয়ান্টাম প্রসেসর আসলে ক্লাসিক্যাল সুপার কম্পিউটারের চেয়ে ১০¹⁵ গুণ দ্রুত গতিতে গণনা করতে পারে। যা কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ক্ষেত্রে একটি বিশাল সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। যদিও বর্তমানে এটি এখনও পর্যন্ত গবেষণার একেবারে প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। এই উচ্চ প্রযুক্তির কোয়ান্টাম প্রসেসরের ডেভলপমেন্ট সম্পন্ন হলে অদূর ভবিষ্যতে ক্রিপ্টোগ্রাফি, মেটেরিয়াল সায়েন্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, এবং ঔষধ আবিষ্কার-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে নতুন এক বিপ্লব ঘটাতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
এদিকে গুগলের উদ্ভাবিত ৫৩ কুইবিট সাইকামোরের সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম প্রসেসর গত২০১৯ সালের দিকে একটি জটিল সমস্যা মাত্র ২০০ সেকেন্ডে সম্পন্ন করেছিল। যা সম্পন্ন করতে হয়ত একটি ক্লাসিক্যাল সুপার কম্পিউটারের ক্ষেত্রে আনুমানিক ১০ হাজার বছর পর্যন্ত সময় লেগে যেত। আর নতুন উদ্ভাবিত ঝুচংঝি-৩ সুপারকন্ডাক্টিং প্রসেসরের সাফল্যকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে তার উচ্চতর কিউবিট (qubit) সংখ্যা এবং উন্নত কম্পিউটেশনাল ক্ষমতার মাধ্যমে। যা অদূর ভবিষ্যতে প্রচলিত সুপার অ্যাডভান্স কম্পিউটিং এর ধারণাকে হয়ত বদলে দিতে পারে।
জুচংঝি-৩ নামক সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম চিপ বা প্রসেসর এখনো পর্যন্ত পরীক্ষামূলক পর্যায়ে থাকলেও, নতুন এই উদ্ভাবন ইঙ্গিত দেয় যে, চীন কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। আর উচ্চ প্রযুক্তির সক্ষমতার লড়াই এ আমেরিকার মতো উচ্চস্তরের টেক জায়ান্ট দেশকে এখন টেক্কা দিতে শুরু করেছে। চীনের এই কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর উন্নতি ভবিষ্যতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জটিল উপাত্ত বিশ্লেষণ, মহাকাশ গবেষণা, পরমাণু প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার মতো অতি জটিল সমস্যা সমাধানে হয়ত বিপ্লব ঘটাতে পারে।# তথ্যসূত্র: ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং, সাইটেক ডেইলি, দ্য কোয়ান্টাম ইনসাইডার।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.