-- বিজ্ঞাপন ---

চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানী পণ্যবাহী জাহাজ আসা নিয়ে কেন এত তোলপাড়?

চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানি পণ্যবাহি জাহাজ আসাকে কেন্দ্র করে রীতিমতো তোলপাড় চলছে। বিশেষ করে ভারতের বিভিন্ন মহল থেকে প্রকাশ করা হচ্ছে নানা উদ্বেগ। তবে বাংলাদেশের বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকার এ বিষয়ে নির্বিকার। কারণ এটিকে সরকার বাণিজ্য বৃদ্ধিছাড়া আর কিছুই মনে করছে না। ভারত থেকে সরাসরি পণ্যভর্তি বিভিন্ন জাহাজ ইতোপূর্বে এলেও পাকিস্তান থেকে এটাই প্রথম। কোন কন্টেইনার জাহাজ এর আগে আসেনি। ফলে কথাও বেশি হচ্ছে এটি নিয়ে। জাহাজটিত ৩১৭টি কনটেইনার ভর্তি ছিল। স্বাভাবিক নিয়মে এগুলো খালাস করে জাহাজটি বন্দর ত্যাগ করে।
সূত্র মতে, গত সোমবার পানামার পতাকাবাহী ইউয়ান জিয়াং ফা জান নামের কনটেইনার জাহাজটি দুবাই থেকে করাচি হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করে। এটি বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালে ৩১৭ কন্টেইনার পণ্য নামিয়ে ফিরতি পথে কন্টেইনার বোঝাই করে বন্দর ত্যাগ করে। বাংলাদেশের সাথে এটিই প্রথম সরাসরি কন্টেইনার বাণিজ্য। এর আগে বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের কন্টেইনার বাণিজ্য চলমান থাকলেও পাকিস্তানের সাথে ছিলনা। করাচি থেকে পণ্য এই প্রথম বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে আনা হয়। এরপর জাহাজটি ইন্দোনেশিয়া চলে যায়।
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে পাকিস্তানের প্রথম সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগকে ইতিবাচক বলে মনে করছেন ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তান হাইকমিশন। বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানি হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ গণমাধ্যমকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে বাণিজ্যের সরাসরি এটি আমাদের জন্য নতুন রুট। পাকিস্তানের সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধি পেণে উভয় দেশের জন্য নতুন নতুন ব্যবসার উন্মোচন হবে।’
বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সরাসরি সমুদ্র বাণিজ্যকে ইতিবাচক মনে করছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমির হুমায়ন মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে এমন অনেক পণ্য আছে যা পাকিস্তানে প্রয়োজন। আবার পাকিস্তানেও এমন অনেক পণ্য আছে যা বাংলাদেশে প্রয়োজন। কিন্ত বর্তমানে যে বাণিজ্য হচ্ছে তা কলম্বো রুট দিয়ে। সরাসরি হচ্ছে না বলে উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের ব্যয় বেশি হচ্ছে। সরাসরি বাণিজ্য হলে সময় কম লাগবে, অর্থের সাশ্রয়ও হবে। তিনি বলেন, মুক্ত বাণিজ্যে যে কোন দেশের সাথে সরাসরি জাহাজ যোগাযোগ হতে পারে। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের ব্যবসা থাকলেও সরাসরি জাহাজ চলাচল না থাকায় উভয় দেশের ব্যবসাীয়দের অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হলে উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের উপকার হবে। তিনি বলেন, ব্যবসা ও রাজনীতি দুটোই আলাদা বিষয়। ব্যবসার ভেতরে রাজনীতি টেনে আনা ঠিক না।’
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানী জাহাজ কেন এলো, এ নিয়ে ঘুম হারাম ভারতের। এরই মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত। শুক্রবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রতিবেশীদের মধ্যে এ ধরনের সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের কাছাকাছি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।

একাধিক সূত্রের বরাতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, বাকি চালানগুলো খালাস করার আগে প্রাথমিকভাবে কয়েকটি বড় কন্টেইনার জাহাজ থেকে নামানো হয় এবং স্থানীয় পুলিশকে দিয়ে সেগুলোর চারপাশে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়। এটা কোনো স্বাভাবিক নিয়ম নয়। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ পণ্য প্রবেশের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না’ বলেন একটি সূত্র। যিনি আগে শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন।

একজন বিশেষজ্ঞের বরাতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমটি আরও জানিয়েছে, ‘চট্টগ্রাম ও মংলা বাংলাদেশের দুটি প্রধান বন্দর এবং উভয় বন্দরই পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগের বাইরে ছিল। সিঙ্গাপুর বা কলম্বোতে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য হতো। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে নতুন করে তৈরি হওয়া এমন সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ভারতকে নতুন করে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।’

বাংলাদেশে নিষিদ্ধ পণ্য আসার শঙ্কা প্রকাশ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এখন যেহেতু পাকিস্তানি জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রামে আসবে, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ পণ্য পাঠানোর সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারেন না।’ ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে অস্ত্র উদ্ধারের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘যা এখনও দক্ষিণ এশিয়ায় অবৈধ অস্ত্রের বৃহত্তম জব্দ করা চালান। সে সময় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ট্রলারে করে আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী দল উলফার জন্য ১ হাজার ৫০০ চাইনিজ অস্ত্র পাঠিয়েছিল। কিন্তু সেগুলোর উলফার হাতে যাওয়ার আগেই জব্দ করা হয়।’

টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া বলছে, মিয়ানমারে এখন টালমাটাল অবস্থা। ভারতের শঙ্কা মিয়ানমার থেকে ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং মাদক কারবারি বেড়ে যেতে পারে।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সরকারি কোনো সূত্রের কোনো বক্তব্য প্রকাশ করা হয়নি। যদিও দুই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটিকে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এদিকে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইন্ডিপেনডেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বন্দরে পাকিস্তানি কার্গো জাহাজের নোঙর করার বিষয়টি ঐতিহাসিক পরিবর্তনের প্রতীক। এটি পাকিস্তান-বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত জটিল কূটনৈতিক সম্পর্কে উষ্ণতার নতুন দিগন্তের সূচনা করছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সাধারণ শুল্ক ও বাণিজ্য চুক্তি আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেছিল। তখন পাকিস্তান এই বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ফোরামে আপত্তি তোলে। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চুক্তিভুক্ত দেশ বা সদস্য হিসেবে যোগ দেয়। ১৯৭৪ সালে, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এটি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পথও সুগম করে। তবে নানা কারণে এই দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য এখনও উল্লেখযোগ্য গতিতে এগিয়ে যায় নি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ছিল ৭৮২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যেখানে বাণিজ্য ভারসাম্য পাকিস্তানের পক্ষে। গত দেড় দশকে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, বিশেষত হাসিনা সরকারের ভারতমুখী নীতির কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনমন ঘটে। গত ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ভারতের পথ অনুসরণ করে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য সার্ক সম্মেলনে যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ হিসেবে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ বলে উল্লেখ করা হয়। মূলত এটা ছিল, এ সময় আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামী নেতাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করলে পাকিস্তানে প্রতিবাদ হয়েছিল। এ কারনে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। এ ছাড়াও শেখ হাসিনা সরকারের আমলে পাকিস্তানি পণ্যের আমদানিতে বেশ কিছু শুল্ক আরোপ করা হয়। নানা কারনে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকেরাও পাকিস্তানে বিভিন্ন শুল্ক সংক্রান্ত বাধার মুখোমুখি হন। ফলে পাকিস্তানে রপ্তানি কমতে থাকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো রপ্তানি ১০০ মিলিয়ন ডলার অতিক্রম করলেও, ২০২২-২০২৩ সালে ৮৪ মিলিয়ন এবং ২০২২- ২০২৪ অর্থবছরে ৫৪ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
সমুদ্র বাণিজ্যে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা কলম্বো রুট ব্যবহার করতেন। অর্থাৎ পাকিস্তান থেকে পণ্য আনতে হলে প্রথমে কলম্বো পরে চট্টগ্রাম বন্দরে আনা হতো। একই পদ্ধতিতে রফতানিও করা হতো। এর ফলে ব্যয় ও সময় দুটোই বেড়ে যায়। উভয় দেশের জন্য সরাসরি পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা না থাকা বড় একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। সমুদ্র বাণিজ্যে ট্রান্স-শিপমেন্ট এমনিতে ব্যয়বহুল। কোন উপায় নেই বলে দীর্ঘদিন ধরে এটি চালু রয়েছে।
চট্টগ্রাম ইপিজেড প্রতিষ্টার পর থেকে টেক্সটাইল সেক্টরে পাকিস্তানের বেশ বিনিয়োগ রয়েছে। প্রথম দিকে বেশ ভালো অবস্থানে থাকলেও নানা কারনে পাকিস্তানী ব্যবসায়ীরা ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস সেক্টরের অনেক কাচাঁমাল আমদানি হতো। উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক ইতিবাচক না থাকায় ধীরে ধীরে ব্যবসার গদিও থমকে যেতে থাকে। ২০১১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে রফতানি ছিল ৯৪৭ মিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে এটি নেমে আসে ৫৮৩ মিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশের পাটজাত পণ্যের বড় বাজার ছিল পাকিস্তান। পাটজাত পণ্যের বাজার বন্ধের সাথে সাথে এখানকার কল-কারখানাগুলোও একে একে বন্ধ হতে শুরু করে। এ অবস্থায় পাটজাত পণ্যের বাজার পুনঃউদ্ধারে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচল ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।###

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.