বিশেষ প্রতিনিধি#
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গত ১৩ আগস্ট মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী টেলিফোনে স্বাগত জানান এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারকে সম্ভাব্য সব সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এসময় প্রধান উপদেষ্টা মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। পাশাপাশি দুতাবাসের মাধ্যমে উপদেষ্টার পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ পত্রও পাঠানো হয়। এর প্রেক্ষিতে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে সরকারি সফরে আসলেন।
আনোয়ার ইব্রাহিম ৫৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। দুপুর আড়াইটায় তার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান তিনি। প্রায় ১১ বছর পর মালয়েশিয়ান কোনো প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আসছেন। মালয়েশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দ্বিতীয় দেশ এবং এশিয়ার প্রথম মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র যারা ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারী বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের শুরুটা তখন থেকেই। ১৯৭৪ সালে প্রথম মালয়েশিয়া সফরে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একই বছর দেশটির সরকার প্রধান ট্যাংকু আব্দুল হালিম প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফর করেন। এরপর ১৯৮৩, ১৯৯৩, ও ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশে আসেন দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহম্মদ। আর শেখ হাসিনা ২০০০, ২০১০ ও ২০২১৪ সালে মালয়েশিয়া সফর করেন। আর সবশেষ ২০১৩ সালে মালয় প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাক ঢাকায় আসেন। অর্থাৎ গত এক দশকের মধ্যে মালয়েশিয়ার কোন সরকার প্রধানই রাষ্ট্রীয় সফর করেনি।
মালয়েশিয়া সৌদি আরবের পর একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। বর্তমানে ১২ লক্ষাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি মালয়শিয়ার বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত রয়েছেন। কিন্তু সিন্ডিকেট জটিলতায় শ্রমবাজারটি বন্ধ রয়েছে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, নুর আলী ও স্বপনের সিন্ডিকেটের পিছনে সরাসরি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদে অনিয়ম দূর্নীতির কারণে তিনবার বন্ধ হয় শ্রম বাজারটি। প্রথম ২০০৮ সালে বন্ধ হয়। ৮ বছর পর ২০১৬-তে চালু হয়। ২০১৮ সালে আবার বন্ধ হয়। ২০২২ সালে আবার কর্মী যাওয়া শুরু হলেও ২৪ সালের জুনে আবার বন্ধ করে মালয়েশিয়া, যা এখনো চলমান। আনোয়ার ইব্রাহীমের এই সফরে সেই জট খুলতে যাচ্ছে।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে আনোয়ার ইব্রাহিমের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে ঐকমত্য হয়েছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দাতো সেরি আনোয়ার ইব্রাহিম। সেইসাথে বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য সুখবর দিয়েছেন তিনি।
বৈঠক শেষে শুক্রবার (৪ অক্টোবর) বিকেলে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেছেন আনোয়ার ইব্রাহিম।
তিনি বলেন, ‘ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের ওপর পূর্ণ আস্থা রয়েছে আমার। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এবং সর্বাত্মক সহযোগী থাকবে।’
টিকিট জটিলতার কারণে মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা ১৮ হাজার শ্রমিককে সব সহায়তা দেয়া হবে জানিয়ে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, ‘মালোয়েশিয়ার শ্রমবাজারে প্রথম পর্যায়ে ১৮ হাজার বাঙালি নেয়া হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমার পুরনো বন্ধু এবং বাংলাদেশের পুরনো বন্ধু আসায় আমি খুবই খুশি। এরওপর আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর এটা প্রথম কোনো সরকার প্রধানের বাংলাদেশ সফর।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সম্মত হয়েছি। যেখানে তারুণ্যের শক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছি। সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে।’
চতুর্থ ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, শিক্ষা, প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয় এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন, জনশক্তি রফতানি, যোগাযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলো নিয়ে কথা বলেছি। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশীদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি এবং ভিসা সহজীকরণের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।’
আসিয়ান জোটে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে মালয়েশিয়ার সক্রিয় সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এর আগে শুক্রবার দুপুর সোয়া ২টার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান আনোয়ার ইব্রাহিম। তাকে স্বাগত জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পরে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে বিমানবন্দরে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। সেখানেই দুজনের একান্ত বৈঠক হয়।
আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ৫৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল রয়েছে।##