-- বিজ্ঞাপন ---

সামনের দিনে স্বচ্ছ কাচেঁর গ্লাসে রাখা যাবে ডাটা! গ্লাস রেকর্ডিং টেকনোলজি সরগরম জাপান

সিরাজুর রহমান#
বর্তমানে আমরা সাধারণত তথ্য সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করি। যার মধ্যে রয়েছে মেমোরি কার্ড, পেন-ড্রাইভ, কম্পিউটারের হার্ডডিক্স ইত্যাদি। এসব ডিজিটাল ডিভাইসে কয়েক বছর ব্যাপী তথ্য উপাত্ত সংরক্ষণ করে রাখা গেলেও বাস্তবে এসব ডিভাইসে দীর্ঘস্থায়ীভাবে ডাটা সংরক্ষণের কোন সুযোগ নেই। আর এক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী ডাটা স্টোরেজ সমস্যার সম্ভাব্য এক অভাবনীয় সমাধান হতে পারে ‘ফিউজড সিলিকা বা গ্লাস রেকর্ডিং টেকনোলজি’।
বিজ্ঞানীদের নতুন আবিষ্কৃত এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিজিটাল ডেটাকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র আকারে গ্লাস বা সিলিকার মধ্যে এনকোড করা সম্ভব। যা কিনা হাজার হাজার কিংবা লক্ষাধিক বছর পর্যন্ত ডেটা অবিকৃতভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। এই প্রযুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক বা সুবিধা হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী ডিজিটাল ডাটা সংরক্ষণের সুবিধা। যাতে তথ্য উপাত্ত হাজার হাজার বছর পর্যন্ত যে কোন প্রতিকূল পরিবেশে অবিকৃতভাবে টিকে থাকবে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
ফিউজড সিলিকা বা গ্লাস রেকর্ডিং টেকনোলজি হলো এমন একটি ভবিষ্যত প্রজন্মের অত্যাধুনিক ডেটা স্টোরেজ পদ্ধতি, যেখানে ডিজিটাল ডেটাকে গ্লাস বা সিলিকার মধ্যে এনকোড করে সংরক্ষণ করা হয়। এই প্রযুক্তি মূলত দীর্ঘস্থায়ী ডেটা সংরক্ষণের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী করে তৈরি করা হয়। যেখানে ডেটাকে লেজার বা অন্যান্য উচ্চ-শক্তির আলোর মাধ্যমে গ্লাস বা সিলিকার মধ্যে ন্যানো-স্কেলে এনকোড করা হয়। ডেটা গ্লাসের মধ্যে তিন-মাত্রিক (3D) ফরম্যাটে সংরক্ষিত হয়, যা কিনা ডেটার ঘনত্ব বাড়ায়।
ফিউজড সিলিকা প্রযুক্তিতে সংরক্ষিত তথ্য উপাত্ত উদ্ধার কিংবা ডেটা রিড করার জন্য আবার বিশেষ ধরনের অপটিক্যাল বা মাইক্রোস্কোপিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করে ডেটা ডিকোড করা হয়। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডেটা সংরক্ষণ করা হয় অত্যন্ত ক্ষুদ্র আকারে, যা হাজার কিংবা লক্ষাধিক বছর পর্যন্ত অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এতে সংরক্ষিত ডেটার স্থায়িত্ব এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং পরিবেশের কোন ক্ষতি না করে যে কোন প্রতিকূল এবং এমনকি চরম হাজারো ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পরিবেশেও টিকে থাকতে সক্ষম।
ফিউজড সিলিকা বা গ্লাস রেকর্ডিং টেকনোলজির ডিভাইস হচ্ছে একটি স্বচ্ছ কাচের বা এক ধরনের স্থিতিশীল পদার্থ। যা পরিবেশগত যে কোনো বিরূপ প্রভাব সহ্য করে টিকে থাকতে পারে। বিশেষ করে এতে সংরক্ষিত ডেটা দীর্ঘ সময় ব্যাপী তাপ, আর্দ্রতা, চৌম্বক ক্ষেত্র এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রতি প্রতিরোধী নিশ্চিত করেই বিজ্ঞানীরা এটিকে ডিজাইন ও তৈরি করেছেন। তবে বিজ্ঞানীরা নতুন এই প্রযুক্তি তৈরিতে গবেষণাগারে প্রাথমিকভাবে সফলতা লাভ করলেও এই প্রযুক্তি কিন্তু এখনো পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের উপযোগী করে তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
নতুন এই প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্বের বেশকিছু টেক জায়ান্ট কোম্পানির নাম উঠে আসলেও বাস্তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক জায়ান্ট মাইক্রোসফটের নাম সবার উপরে উঠে আসে। বিশেষ করে মাইক্রোসফটের প্রজেক্ট সিলিকা (Project Silica) গ্লাস রেকোর্ডিং টেকনোলজির একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। তারা সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ প্রযুক্তির সাহায্যে লেজার টেকনোলজি ব্যবহার করে পরীক্ষামূলকভাবে স্বচ্ছ কাঁচ বা গ্লাসের মধ্যে ডেটা এনকোড করে এবং মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করে সেই সংরক্ষিত ডেটা পরবর্তীতে আবার রিড করতে সক্ষম হয়েছে বলে দাবি করেছে।
এদিকে মাইক্রোসফটারে পাশাপাশি ফিউজড সিলিকা বা গ্লাস রেকর্ডিং টেকনোলজি নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা করে যাচ্ছে জাপানের হিটাচি কর্পোরেশন। মূলত প্রায় এক যুগ বা তার আগে থেকেই জাপানের ‘হিটাচী’ কর্পোরেশন শত শত বছর ডিভাইসে তথ্য সংরক্ষণ কিংবা অক্ষত থাকতে সক্ষম এমন উচ্চ প্রযুক্তির ডাটা স্টোরেজ টেকনোলজি উদ্ভাবনে কাজ করে যাচ্ছে। আর তাদের নতুন উদ্ভাবিত উচ্চ প্রযুক্তির গ্লাস রেকর্ডিং টেকনোলজি’ অদূর ভবিষ্যতে হয়ত অসীম সময়ের জন্য ডাটা স্টোরেজ সমস্যা সমাধানের এক অকল্পনীয় সমাধান হতে পারে।
জাপানের ‘হিটাচি’ কোম্পানি গত ২০০৮ সাল থেকেই এই দীর্ঘস্থায়ী ডেটা সংরক্ষণ প্রযুক্তি নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা গবেষণাগারে নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করে দেখে যে, তাদের নতুন উদ্ভাবিত টেকনোলজির কাঁচে সংরক্ষিত তথ্য ২ ঘণ্টা যাবত ১ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসে উত্তপ্ত করলেও তাতে সংরক্ষিত থাকা ডাটা নষ্ট কিংবা হারিয়ে যায় না। এই পরীক্ষা থেকে প্রমাণিত হয় যে কাঁচের ফলকে রক্ষিত তথ্য আনুমানিক হয়ত ৩০০ মিলিয়ন বছর পর্যন্ত অক্ষত থাকতে পারবে। যদিও অবশ্য এটা একটি অনুমান ব্যতীত আর কিছুই নয়।
ভবিষ্যতে কাঁচের ফলকে ডেটা সংরক্ষণের পাশাপাশি এই সংরক্ষিত তথ্যকে খুব দ্রুত, সহজ এবং যুগের প্রচলিত থাকা ডিভাইস দিয়েই যাতে ডেটা রিড করা কিংবা তথ্য উপাত্ত উদ্ধার করা যায়, এ বিষয়টি নিশ্চিত করা বিজ্ঞানীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। এই সমস্যা সমাধানে বর্তমানে কাজ করে যাচ্ছে হিটাচিসহ বিশ্বের কিছু প্রথম সারির টেক জায়ান্ট কোম্পানি। আর তাই ‘হিটাচি’ এবার তথ্য সংরক্ষণ এবং তা উদ্ধারের জন্য ব্যবহার করছে অতি উচ্চ প্রযুক্তির ‘ফেমটোসেকেন্ড পালস লেজার টেকনোলজি’।
‘হিটাচি’ কর্পোরেশন জাপানের কিয়োটো ইউনিভার্সিটির সাথে ২০১১ সাল থেকে যৌথভাবে কাজ করে এই অভাবনীয় ফিউজড সিলিকা বা গ্লাস রেকর্ডিং টেকনোলজি উদ্ভাবনে অনেকটাই সফল হয়েছে বলে দাবি করে। তবে এই প্রযুক্তির সহজ ব্যবহার, সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা কিংবা বাণিজ্যিক উৎপাদন সম্ভব না হলেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ‘ফেমটো লেজার টেকনোলজি’ কিন্তু সারা বিশ্বের হাজার হাজার মানুষের চোখের দৃষ্টি পুনঃস্থাপন কাজে প্রযুক্তিগতভাবে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। তাছাড়া বিজ্ঞানীদের মতে, এই প্রযুক্তি কিন্তু পরিবেশের জন্য মোটেও ক্ষতিকর নয়।
গ্লাস রেকোর্ডিং প্রযুক্তিতে ডেটা সংরক্ষণের জন্য কাঁচের ভিতর বিভিন্ন স্তরে অসংখ্য ক্ষত সৃষ্টি করা হয়। যেগুলো আবার এক একটা ২ডি/৩ডি কোড হিসেবে কাজ করে। বাস্তব ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তিকে অত্যন্ত কার্যকর করার জন্য ‘হিটাচি’ পুরু কাঁচের ফলকে একাধিক স্তরে এই লেজার এনগ্রেভিং করার এক অভাবনীয় প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। এখন পর্যন্ত ‘হিটাচি’ এক কাঁচের ফলকের ভেতরে সর্বোচ্চ ১০০ লেয়ারে তথ্য সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। যাকে দীর্ঘস্থায়ী ডেটা সংরক্ষণের একটি বড় প্রযুক্তিগত বৈপ্লবিক অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গত ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসের দিকে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ৩০ কোটি বছরের ভবিষ্যতের ছবি এবং বার্তা সম্বলিত একটি ফিউজড সিলিকা গ্লাসের লিথোগ্রাফ তৈরি করা হয়েছিল। জাপানের কিউশু ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি এবং কাগোশিমা বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে তৈরি করা (শিন-এন-২) একটি ছোট আকারের স্পেস প্রোবের পেলোডের অংশ হিসেবে হায়াবুসা-২ রকেটে করে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়। যা কিনা এখনো পর্যন্ত ফিউজড সিলিকা গ্লাসে মানব জাতির ইতিহাস নিয়ে মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ফিউজড সিলিকা বা গ্লাস রেকর্ডিং টেকনোলজি নিয়ে বিভিন্ন দেশের টেক জায়ান্ট কোম্পানি ব্যাপক আকারে গবেষণা চালিয়ে গেলেও এটি কিন্তু এখনও পর্যন্ত উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এর পাশাপাশি এতে ডেটা রাইট এবং রিড করার গতি, উৎপাদন ব্যয় বা খরচ এবং প্রযুক্তিগত বিভিন্ন দিক কিন্তু চ্যালেঞ্জিং হয়ে রয়ে গেছে। তবে এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে দীর্ঘস্থায়ী ডেটা স্টোরেজের ক্ষেত্রে এক নতুন বিপ্লব আনতে পারে। বিশেষ করে যেখানে দীর্ঘমেয়াদি ডেটা সংরক্ষণের বিশেষ প্রয়োজন হয়।
আবার গ্লাস রেকোর্ডিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে অত্যন্ত ক্ষুদ্র আকারে বিপুল পরিমাণ ডেটা সংরক্ষণ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি ক্রেডিট কার্ডের আকারের গ্লাস ডিস্কে আনুমানিক কয়েক টেরাবাইট পর্যন্ত ডেটা সংরক্ষণ করা সম্ভব বলে মনে করেন গবেষকেরা। তাছাড়া নতুন প্রযুক্তি দ্বারা হয়ত লক্ষ লক্ষ বছর পরে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানব জাতি বা উন্নত কোন সভ্যতা বর্তমানের সংরক্ষিত ডাটা খুব সহজেই এবং ভবিষ্যৎ কালের প্রচলিত প্রযুক্তি দিয়ে ডাটা রিড করতে পারে তা নিশ্চিত করতেই কাজ করে যাচ্ছেন গবেষকেরা। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ব্যবহারের উপযোগী না হলেও এই গবেষণায় তারা এখন অনেকটাই সফল হয়েছে বলে মনে করা হয়।
তথ্যসূত্র: নিউ এটলাস, হিটাচি সোশ্যাল ইনোভেশন, ডাটা সেন্টার ম্যাগাজিন, ফিজিক্স ডট ওআরজি।

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.