কাজী আবুল মনসুর##
বাংলাদেশে শিশুদের অনুপ্রেরণা এবং উৎসাহ দিতে ঢাকায় এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশবিষয়ক সংস্থার-নাসার প্রধান মহাকাশচারী জোসেফ এম আকাবা। রোববার (১৫ ডিসেম্বর) সকালে রাজধানী বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্লেপেন স্কুলে আয়োজিত ‘এক্সপ্লোরিং স্পেস, ইন্সপায়ারিং ইয়ং মাইন্ড’ শিরোনামে এক অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি।
জোসেফ মাইকেল আকাবা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৭ সালের ১৭ মে। তিনি হলেন একজন মার্কিন মহাকাশচারী এবং নাসার প্রধান মহাকাশচারী অফিসের প্রথম হিজপানিক (হিসপানিক শব্দটি সাধারণত এমন ব্যক্তিদের বোঝায় যাদের পূর্বপুরুষ স্পেনীয় বা স্প্যানিশ-ভাষী দেশ থেকে এসেছে, বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকা। এটি একটি সাংস্কৃতিক পরিচয় যা ভাষা এবং ঐতিহ্যের ভিত্তিতে গঠিত। হিসপানিক ব্যক্তি সাধারণত স্প্যানিশ ভাষা, সংস্কৃতি, এবং ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কিত) নেতা। ক্যালিফোর্নিয়ার ইনগেলউডে জন্মগ্রহণ করা আকাবা ভূতত্ত্বে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, সান্তা বারবারা থেকে এবং একই বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি করেন ইউনিভার্সিটি অফ অ্যারিজোনা থেকে। পরবর্তীতে তিনি টেক্সাস টেক ইউনিভার্সিটি থেকে শিক্ষা ও পাঠক্রম পরিকল্পনায় আরেকটি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।
পেশাগত জীবনের শুরুতে তিনি মার্কিন মেরিন কর্পস রিজার্ভে এবং পিস কর্পসে কাজ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি শিক্ষক হিসেবে ফ্লোরিডার স্কুলে বিজ্ঞানের পাঠদান করেন। ২০০৪ সালে তিনি নাসার মহাকাশচারী হিসেবে নির্বাচিত হন। মহাকাশে তিনি মোট ৩০৬ দিন কাটিয়েছেন এবং তিনটি ভিন্ন অভিযানে অংশগ্রহণ করেছেন। এগুলোর মধ্যে ছিল স্পেস শাটল ডিসকভারি মিশন (STS-119), যেখানে তিনি দুটি স্পেসওয়াক সম্পন্ন করেন এবং ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের একাধিক অভিযানে অংশ নেন। বর্তমানে তিনি আর্টেমিস প্রোগ্রামের অংশ, যা ২০২০-এর দশকের মাঝামাঝি চাঁদে মানব মিশনের পরিকল্পনা করছে। আকাবার মিশন এবং শিক্ষাগত পটভূমি তাকে পরবর্তী প্রজন্মের মহাকাশচারীদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আকাবার আসন্ন বাংলাদেশ সফর উল্লেখযোগ্য। এটি বাংলাদেশের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিক্ষাক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা যোগানোর জন্য নাসার একটি নতুন উদ্যোগ। তার সফরের মূল উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের মহাকাশ বিজ্ঞান, রোবটিক্স, এবং STEM (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত) বিষয়ক পড়াশোনায় আগ্রহী করা। আকাবা শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করবেন এবং তাদের মহাকাশ গবেষণার গুরুত্ব, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় মহাকাশ প্রযুক্তির ভূমিকা সম্পর্কে জানাবেন। বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন, কৃষি, এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহারের উপর জোর দেওয়া হবে। আকাবা বাংলাদেশের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত খাতের সঙ্গে সহযোগিতার নতুন সম্ভাবনা অন্বেষণ করবেন, বিশেষ করে নাসার আর্টেমিস প্রোগ্রামের মাধ্যমে। নাসার এই উদ্যোগ বাংলাদেশের মহাকাশ ও প্রযুক্তি খাতে তাদের ক্রমবর্ধমান আগ্রহকে প্রকাশ করে। ২০১৮ সালে উৎক্ষেপিত বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট বাংলাদেশের মহাকাশ গবেষণার পথিকৃৎ। আকাবার সফর বাংলাদেশের মহাকাশ গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচনে ভূমিকা রাখতে পারে।
এই সফর কেবলমাত্র বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং গ্লোবাল স্পেস এডুকেশন এবং সহযোগিতার ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
সূত্র জানায়, জোসেফ এম. আকাবা তার সফরে আর্টেমিস প্রোগ্রামের লক্ষ্য এবং বাংলাদেশের মতো দেশ কীভাবে এই মিশনে অবদান রাখতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করবেন। আর্টেমিস মিশন পৃথিবীর বাইরের গবেষণা এবং ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে অভিযান সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আকাবা শিক্ষার্থীদের জন্য সেশন পরিচালনা করবেন, যেখানে মহাকাশ বিজ্ঞান এবং গবেষণার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হবে। এছাড়া, মহাকাশ প্রকৌশল এবং রোবোটিক্স সম্পর্কে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে পারে। বাংলাদেশের স্যাটেলাইট প্রকল্পের উন্নয়নে নাসার প্রযুক্তিগত সহায়তার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণের পর, এই সহযোগিতা বাংলাদেশের মহাকাশ প্রযুক্তি উন্নয়নের গতি আরও বাড়াতে পারে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর একটি। মহাকাশ থেকে পৃথিবীর পর্যবেক্ষণ এবং স্যাটেলাইট ডেটা কিভাবে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিকল্পনা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, তা নিয়ে বিশদ আলোচনা হতে পারে। আকাবার সফর শুধুমাত্র মহাকাশ প্রযুক্তি নয়, বরং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, প্রকৌশল, এবং গণিত (STEM) বিষয়ে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মহাকাশ গবেষণা ও প্রযুক্তি নিয়ে উদ্দীপনা বাড়ানোর মাধ্যমে দেশীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
জোসেফ এম. আকাবা নাসার আর্টেমিস প্রোগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা চাঁদে পরবর্তী পর্যায়ের গবেষণা এবং অভিযানের জন্য পথ তৈরি করছে। তিনি আর্টেমিস টিমের সদস্য হিসেবে এই মিশনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে অবদান রাখছেন, যার লক্ষ্য প্রথম নারী এবং পরবর্তী পুরুষকে চাঁদের পৃষ্ঠে পাঠানো। এই মিশনে বৈচিত্র্য ও নতুন উদ্ভাবনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
নাসায় তার কাজ ছাড়াও, আকাবা বিজ্ঞান শিক্ষক ও জলবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ (হাইড্রোজিওলজিস্ট) হিসেবে কাজ করেছেন, যা তার বিজ্ঞান এবং শিক্ষার প্রতি অঙ্গীকারের প্রতিফলন। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সান্তা বারবারা এবং অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূবিজ্ঞানে ডিগ্রি অর্জন করেন, যা তার পৃথিবী বিজ্ঞান এবং মহাকাশ গবেষণায় সাফল্যের ভিত্তি তৈরি করেছে। এছাড়াও, তিনি জনসাধারণের সাথে যোগাযোগ এবং পরামর্শদানের কাজে জড়িত ছিলেন, বিশেষ করে অনুন্নত সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (STEM) বিষয়ক স্বপ্ন ও শিক্ষার গুরুত্ব প্রচারে কাজ করেছেন।
বর্তমানে, আকাবা শুধু একজন মহাকাশচারী হিসেবেই নয়, বরং বৈশ্বিক বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে অবদান রাখার জন্য ছাত্র এবং পেশাজীবীদের অনুপ্রেরণা প্রদান করছেন। তার নেতৃত্ব এবং অভিজ্ঞতা মহাকাশ অন্বেষণ এবং এর পৃথিবীজুড়ে প্রয়োগে তাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব করে তুলেছে।
জোসেফ এম. আকাবা নাসার প্রধান মহাকাশচারী, যিনি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই পদে নিয়োগ পান। তিনি প্রথম হিস্পানিক বংশোদ্ভূত ব্যক্তি, যিনি এই সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত হন। আকাবা, একজন প্রাক্তন মেরিন, হাইড্রোজিওলজিস্ট, এবং অভিজ্ঞ মহাকাশচারী, তিনটি মহাকাশ মিশনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং মহাকাশে ৩০৬ দিন অতিবাহিত করেছেন।##
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.