--- বিজ্ঞাপন ---

সুইস ব্যাংক নিয়ে রহস্যের অন্ত নেই, কালো টাকার পাহাড় বাংলাদেশীদেরও

0

কাজী আবুল মনসুর :

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নাম সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক বা এসএনবি। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো সারা বিশ্বে সুইস ব্যাংক নামেই পরিচিত। সুইস ব্যাংকে সাদা না কালো টাকা রাখা নিয়ে বিশ্বজুড়ে রহস্যের অন্ত নেই। সব দেশের টাকা পরিমান বাড়ছে। বাংলাদেশেরও টাকার পরিমান ক্রমশ বাড়ছে। সাধারনত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর কালো টাকা নিয়ে যেভাবে হৈচৈ হয় উন্নত দেশগুলোতে তেমন একটা হয় না। বাংলাদেশের টাকার পরিমান বাড়লেও এ নিয়ে কোন হৈচৈ নেই। যেমনটা মাঝে মাঝে হয় পাশের দেশ ভারতে। সুইস ব্যাংকে কালো টাকা রাখা নিয়ে পাশের দেশ ভারতের রাজনৈতিক অন্দরমহলে চলে ব্যাপক তোলপাড়। সে দেশের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কালো টাকার মালিকদের তালিকা ইতিমধ্যে জমা দিয়েছে সে দেশের সরকার। ভারতে এমনটি হলেও আমাদের দেশের কালো টাকার মালিকরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অনেকেই সুইস ব্যাংকে টাকা রেখে বহাল তবিয়তে দিন যাপন করছেন। ভারত বলে হয়তো সুইজারল্যান্ড-এর ব্যাংকগুলো নতিস্বীকার করেছে তালিকা প্রদানের ক্ষেত্রে। প্রায় হাজারো ধরপতির তালিকা দেয়া হয়েছে বলে ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্র জানায়।

দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকার একটি বড় অংশ দেশ থেকে পাচার হয়ে বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা হচ্ছে। এসব অর্জিত টাকা দেশে কেউ রাখতে চাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে তাদের প্রথম পছন্দ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো। সুইস ব্যাংকগুলো যে দেশ-বিদেশের পাচার করা গোপন অর্থের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে, তার ইতিহাস বহু আগের। প্রায় ৩০০ বছর আগে থেকেই সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে গোপন অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা জমা রাখার ব্যবস্থা চালু ছিল। ফ্রান্সের রাজাদের সঞ্চিত অর্থ গোপন রাখার প্রবণতা থেকেই এই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল বলে জানা যায়। ১৭১৩ সালে জেনেভার সিটি কাউন্সিলে যে আইন করা হয়, তাতে গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টের হিসাব গোপন রাখার বিধান চালু করা হয়। কেবল গ্রাহক ছাড়া অন্য কারও কাছে অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত তথ্য জানানো ছিল নিষিদ্ধ। মূলত তখন থেকেই বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ পাচার করে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে রাখার প্রবণতা শুরু হয়েছিল। আদিতে সুইস ব্যাংকের গোপনীয়তা রক্ষার আইন ফৌজদারি ছিল না বিধায় গোপনীয়তা ভঙ্গের কারণে কোনো ব্যাংক কর্মচারীকে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ ছিল না। ১৯৩৪ সালের নতুন ব্যাংকিং আইন এই গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টিকে ফেডারেল আইনে পরিণত করে আরও কঠোর করে দেওয়া হয়। ১৯২৯ সালের মহামন্দার ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিং আইনের এই সংশোধন প্রয়োজন ছিল। নতুন আইনে ব্যাংকিং গোপনীয়তার বিষয়টিকে ফৌজদারি দন্ডবিধির আওতায় নিয়ে আসা হয়, ফলে গোপনীয়তা ভঙ্গকারীর শাস্তি ছিল কারাদন্ড। জার্মানিতে হিটলারের শাসনামলে বিদেশে ধনসম্পদ জমা করার জন্য মৃত্যুদন্ডের বিধান চালু করা হলে সুইজারল্যান্ডে এই ব্যাংকিং গোপনীয়তা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপীয় ইহুদিরা তাদের সমুদয় সম্পদ সুইস ব্যাংকে জমা রাখা শুরু করে। যুদ্ধের ডামাডোলে বহু ইহুদি সুইস ব্যাংকের গোপন দলিলপত্র হারিয়ে ফেলে, ফলে যুদ্ধ-পরবর্তীকালে তারা আর তাদের সঞ্চিত অর্থ ফেরত পায়নি। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, সুইস ব্যাংকে যে কেবল ইহুদিদের সম্পদ গোপন করে রাখা হতো তা নয়, নাৎসি বাহিনী যুদ্ধবন্দী এবং অধিকৃত দেশ থেকে যে সম্পদ লুণ্ঠন করে, সেসবও গচ্ছিত রাখা হয়েছিল সুইস ব্যাংকের গোপনীয়তায়। বিষয়টির মধ্যে কোনো আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। মার্কিন কুটনীতিবিদ স্টুয়ার্ট আইজেনস্ট্যাট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে অর্থনৈতিক অসংগতি এবং ব্যবসায়িক লেনদেন নিয়ে তাঁর বিখ্যাত বই ইমপারফেক্ট জাস্টিস: লুটেড অ্যাসেটস, স্লেভস লেবার, অ্যান্ড দ্য আনফিনিশড বিজনেস অব ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু-তে দেখিয়েছেন যে ১৯৩৯ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৪৫-এর জুন পর্যন্ত জার্মানি তখনকার মূল্যে ৪০ কোটি ডলারের স্বর্ণ ন্যাশনাল ব্যাংক অব বার্নে পাচার করেছে। ধারণা করা যায়, যুদ্ধের খরচ চালানোর জন্য নিয়ে যাওয়া এই স্বর্ণের বেশির ভাগই ছিল হতভাগ্য ইহুদিদের কাছ থেকে লুট করা।

আইজেনস্ট্যাট লিখেছেন, ‘সুইজারল্যান্ড বা অন্য নিরপেক্ষ দেশগুলো যে ভিকটিমদের স্বর্ণ জেনেশুনে গ্রহণ করেছে তার কোনো প্রমাণ নেই তবে সুইজারল্যান্ড ও ইতালিতে পাঠানো স্বর্ণের মধ্যে অন্তত একটা ছোট অংশ ছিল, যা অধিকৃত দেশের নাগরিক এবং কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের হতভাগ্য এবং ক্যাম্পে আনার আগেই মেরে ফেলা লোকজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা।’ এসব স্বর্ণালংকার অন্যান্য সোনার সঙ্গে মিশিয়ে গলিয়ে ফেলা হয়। এতে ধারণা করা যায় যে সুইজারল্যান্ড জার্মান আগ্রাসনের ভয় করছিল।যুদ্ধ শেষে ১৯৪৬ সালে সুইস-ওয়াশিংটন চুক্তির অধীনে সুইস সরকার ত্রিপক্ষীয় গোল্ড কমিশনের কাছে প্রায় ছয় কোটি (৫.৮) ডলারের সমপরিমাণ স্বর্ণ হস্তান্তর করতে সম্মত হয়। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফরাসি সরকার জার্মানি থেকে প্রাপ্ত সব স্বর্ণের সঙ্গে সুইজারল্যান্ড এবং সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের সম্পৃক্ততার দাবি ছেড়ে দেয়। এর ফলে ষাটের দশক পর্যন্ত সুইস ফেডারেল আইনের কারণে সেখানকার ব্যাংক, অ্যাটর্নি অফিস, ট্রাস্টিসহ সর্বত্র জার্মান সহিংসতার শিকার এবং উদ্বাস্ত্তদের সুপ্ত হিসাব খুঁজে বের করার কাজ চলে। এভাবে খুঁজে পাওয়া যায় প্রায় ২৪ লাখ ডলার, (১৯৬২-এর মূল্যমানে) যা যোগ্য উত্তরাধিকারীদের কাছে ফেরত দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৯৯৭ সালে একটা ঘটনা সুইস ব্যাংকের আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টাকে আরও স্পষ্ট করে দেয়। ইউনিয়ন ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ডের (ইউবিএস) এক প্রহরী ধ্বংস করে ফেলার ঠিক আগে ব্যাংকের কিছু পুরোনো লেজার আবিষ্কার করে, যেখানে জার্মানিতে ইহুদি নিধনের সময়কার অ্যাকাউন্টের হিসাব ছিল। বার্লিনসহ বিভিন্ন শহরের ঠিকানাসংবলিত সেই সব হিসাব দেখে ক্রিস্টোফার মেইলি নামের সেই প্রহরী সেসব লেজার তুলে দেন একটা ইহুদি সাহায্য সংস্থার কাছে। বিষয়টি সুইস আইনে অপরাধ হলেও মেইলি এই ঐতিহাসিক দলিল ধ্বংস হতে দিতে চাননি। জার্মানিতে ইহুদি নিধনের সময়কার হিসাবপত্র দেওয়ার জন্য সুইস ব্যাংকগুলো বিভিন্নমুখী চাপের মুখে থাকলেও মেইলির এই বোমা ফাটানো ঘটনা তাদের নতুন চাপের মুখে ফেলে দেয়। শাস্তি এড়ানোর জন্য মেইলি আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। মেইলির এই উদ্ঘাটন অবশ্য সুইজারল্যান্ডের মানুষ এবং সংবাদমাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। এক পক্ষ মেইলির সাহসী বিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপের প্রশংসা করে, অন্য পক্ষ তাঁকে দেশপ্রেমরহিত বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করে। প্রতিক্রিয়া যা-ই হোক, পরের বছরই সুইস ব্যাংকের তরফ থেকে ইহুদি সংস্থাগুলোর সঙ্গে ১২৫ কোটি ডলারের ক্ষতিপূরণ রফা হয়। ঘটনাটা ইউবিএস কর্তৃপক্ষকে যথেষ্ট বেকায়দায় ফেলে দেয়, কারণ এটি নতুন সুইস আইনে জার্মানি কর্তৃক ইহুদি নিধনের প্রমাণস্বরূপ যেকোনো আলামত সংরক্ষণ করার যে বিধান রয়েছে তার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ফলে বিষয়টা যে এক দুঃখজনক ভুল, সেটা স্বীকার করতেও হয়েছে তাদের। কোনো প্রাচীন দলিল ধ্বংস করার আগে ব্যাংকের নিজস্ব একজন ইতিহাসবিদ সেসব পরীক্ষা করে দেখতেন যে সেগুলোতে ইহুদি নিধন সম্পর্কে কোনো প্রমাণ রয়েছে কি না। মেইলির আবিষ্কারের আগে আরও যেসব দলিল ধ্বংস করা হয়েছে, সেখানে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি বলে সেই ইতিহাসবিদ সেসব ধ্বংসের অনুমতি দিয়েছিলেন বলে জানায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তবে ধ্বংস করা দলিলগুলোর কোনো তালিকা না রাখার কারণে সেই ইতিহাসবিদকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। অবশ্য মেইলি একা নন, পরবর্তী সময়ে রুডলফ এলমার নামের একজন সুইস ব্যাংক কর্মকর্তা কর ফাঁকি দেওয়ার টাকার হিসাব ফাঁস করে দেওয়ার পর সুইস কর্তৃপক্ষ তার পেছনে লাগে। উইকিলিকসকে দেওয়া তার তথ্যগুলো কর ফাঁকি দেওয়া কালোটাকার অভয়ারণ্য হিসেবে সুইস ব্যাংকের ভূমিকা আর গোপন থাকে না। এরপর ব্র্যাডলি বার্কেনফেল্ড নামের আর একজনের ভূমিকার কারণে ইউবিএস আরও একবার কর ফাঁকিতে সহায়তা করার জন্য ধরা পড়ে। এর জন্য ইউবিএসকে সাত কোটি ৮০ লাখ ডলার জরিমানা দিতে হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রকে প্রায় সাড়ে চার হাজার সন্দেহভাজন মার্কিন করখেলাপি হিসাবধারীর তালিকা সরবরাহ করতে হয়। আগে সুইজারল্যান্ডের এই ব্যাংকটি আমানতকারীদের টাকা অত্যন্ত গোপনে রেখে দিত। ফলে বিশেষ করে দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতির টাকা এই ব্যাংকে জমা রাখত। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে দেশটি দুর্নীতিবাজদের টাকার নিরাপদ জিম্মাদার হওয়ায় সারা বিশ্বে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। ফলে তারা দুর্নীতির টাকার কলংকের দায় এড়াতে ২০০২ সাল থেকে বিদেশী আমানতকারীদের দেশওয়ারি টাকার পরিমাণ প্রকাশ করতে শুরু করে। এতেই সারা বিশ্বে হইচই পড়ে যায়। একই সঙ্গে আইনের সুযোগে অনেক দেশ পাচারের তথ্য সংগ্রহ করে নিচ্ছে। এসব কারণে সুইস ব্যাংক থেকে একদিকে যেমন দুর্নীতিবাজরা টাকা উঠিয়ে নিচ্ছেন, অন্যদিকে নতুন করে টাকা জমা হচ্ছেও কম। ফলে এখন আমানতের পরিমাণ কমতে শুরু করেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সুইস ব্যাংকে বিদেশীদের জমা টাকার পরিমাণ ২০০৭ সাল পর্যন্ত বেড়েছে। এরপর থেকে কমতে শুরু করেছে। সুইস ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৫ সালে ব্যাংকে বিদেশীদের আমানতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬২ হাজার ফ্রাঁ। ২০০৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৯০ হাজার ফ্রাঁ। ওই এক বছরে আমানত বেড়েছে ২৮ লাখ ফ্রাঁ। শতকরা হিসাবে এই বৃদ্ধির হার ১৭ দশমকি ২৮ শতাংশ। ২০০৭ সালে তা আরও ১৭ লাখ ফ্রাঁ বেড়ে দাঁড়ায় ২ কোটি ৭ লাখ ফ্রাঁয়। ওই বছরে বিদেশীদের আমানতে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০০৮ সাল থেকেই সুইস ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ কমতে থাকে। ওই বছরে ২০০৭ সালের তুলনায় আমানতের পরিমাণ ৩৩ লাখ ফ্রাঁ কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ৭৪ লাখ ফ্রাঁ। ওই সময়ে আমানত কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। ২০০৯ সালে আরও ৪০ লাখ ফ্রাঁ থেকে কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ৩৪ লাখ ফ্রাঁ। ওই সময়ে শতকরা হিসাবে কমেছে প্রায় ২৩ শতাংশ। ২০১০ সালে আমানতের পরিমাণ আবার সামান্য বাড়ে। ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১০ সালে ১ লাখ ফ্রাঁ বেড়ে ১ কোটি ৩৫ লাখ ফ্রাঁয় দাঁড়ায়। ওই এক বছরে শতকরা হিসাবে আমানত বেড়েছে দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০১০ সালের তুলনায় ২০১১ সালে আমানতের পরিমাণ ৫ লাখ ফ্রাঁ বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৪০ লাখ ফ্রাঁয়। শতকরা হিসাবে ওই এক বছরে বিদেশী আমানত বেড়েছে ৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। ২০১২ সাল থেকে ব্যাংকের আমানত আবার কমতে থাকে। যা ২০১৩ সালেও অব্যাহত রয়েছে। পরের বছরগুলোতে টাকার পরিমান কম বেশি উঠা নামা করেছে। ২০১২ সালে ব্যাংকের আমানত ২০১১ সালের তুলনায় ১১ লাখ ফ্রাঁ কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ২৯ লাখ ফ্রাঁয়। ওই সময়ে আমানত কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে আমানতের পরিমাণ ৫ লাখ ফ্রাঁ কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ২৪ লাখ ফ্রাঁয়। ওই বছরে শতকরা হিসাবে কমেছে প্রায় ৪ শতাংশ। সুইস ব্যাংকে আমানতের পরিমান উঠানামা কললেও ২০১৬ সাল পর্যন্ত টানা ছয় বছর বাংলাদেশিদের আমানত কিন্ত বেড়েছে। মাঝে ২০১৭ সালে কিছুটা কমলেও  ১৮তে আবার বেড়েছে। বাংলাদেশিদের টাকা বাড়লেও সামগ্রিকভাবে ২০১৮ সালে আমানত কমেছে সুইস ব্যাংকগুলোতে। সার্ক দেশগুলোর মধ্যে সুইস ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি টাকা জমা রেখেছে ভারতের নাগরিকরা। তাদের জমা টাকার পরিমাণ ১৯৫ কোটি ফ্রাঁ। ২০১২ সালে ছিল ১৪২ কোটি ফ্রাঁ। এক বছরে তাদের আমানত বেড়েছে ৪০ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান। সুইস ব্যাংকে তাদের আমানতের পরিমাণ ১০১ কোটি ফ্রাঁ। তৃতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে এদেশের আমানতের পরিমাণ ছিল ৩৭ কোটি ২০ লাখ ফ্রাঁ। ২০১২ সালে এর পরিমাণ ছিল ২২ কোটি ৯০ লাখ ফ্রাঁ। এক বছরে আমানত বেড়েছে ১৪ কোটি ৮০ লাখ ফ্রাঁ। শতকরা হিসাবে বেড়েছে প্রায় ৬২ শতাংশ। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে নেপাল। তাদের আমানতের পরিমাণ ৮ কোটি ৪৮ লাখ ফ্রাঁ। পঞ্চম অবস্থানে শ্রীলংকা। তাদের আমানতের পরিমাণ ৮ কোটি ২০ লাখ ফ্রাঁ। ১ কোটি ৩০ লাখ ফ্রাঁ জমা রেখে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে ছোট দেশ মালদ্বীপ। ১ কোটি ২১ লাখ ফ্রাঁ জমা রেখে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে আফগানিস্তান। ২০১৮-র ডিসেম্বরের তথ্য মতে, বাংলাদেশিদের আমানত দাঁড়িয়েছে ৬১ কোটি ৭৭ লাখ সুইস ফ্রাঁ; দেশি মুদ্রায় ৫ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে এ অঙ্ক ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ ফ্রাঁ বা ৪ হাজার কোটি টাকা। এক বছরে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত বেড়েছে ১ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের আমানত বাড়লেও েএ নিয়ে সোচ্চার না কেউ। তবে ভারত থেকে পাচার হওয়া অর্থের তথ্য দিতে সম্মত হয়েছে সুইস ব্যাংক। সম্প্রতি এ বিষয়ে সুইজারল্যান্ড সরকারের সঙ্গে চার বছরের একটি চুক্তি করেছে ভারত। ফলে ভারতের কর কর্তৃপক্ষ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে ভারতীয় নাগরিকদের অর্থের তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। কালোটাকার তথ্য প্রদানের পাশাপাশি ই-মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের তথ্যও আদান-প্রদানে রাজি হয়েছে দেশ দুটি। এরপর থেকে বিদেশে কালো টাকা সরিয়ে নেয়া ভারতীয়দের নাম প্রকাশ শুরু করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার। এর অংশ হিসেবে সম্প্রতি তিন ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ করা হয়। সুইস ব্যাংকে অবৈধ অ্যাকাউন্ট রাখার দায়ে ডাবর গ্রুপের সাবেক নির্বাহী পরিচালক প্রদীপ বর্মণসহ এতে অভিযুক্ত হয়েছেন রাজকোটের স্বর্ণ ব্যবসায়ী পঙ্কজ চিমনলাল লোধিয়া ও গোয়ার খনি ব্যবসায়ী রাধা টিম্বলো।এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে নরেন্দ্র মোদী সরকার ৬২৭ জনের নামের তালিকা আদালতে জমা দিয়েছে। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা বিদেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কালো টাকা গচ্ছিত রেখেছে। তবে আপাতত তাঁদের নাম গোপনই থাকছে। কালো টাকার রহস্য উদ্ধারে যে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন হয়েছে, তার চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যানই শুধু এই নাম জানতে পারবেন। বিগত জাতীয় সংসদে দেয়া বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।এরপর সরকারী নির্দেশে এ সংক্রান্ত নানা উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে অর্থপাচার সংক্রান্ত তথ্য দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষর চুক্তি করতে রাজি হচ্ছে না সুইস ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ব্যাংকগুলো। এতে করে বিষয়টি একেবারেই অনিশ্চিয়তার দিকে চলে গেছে।  দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৩ সালের গ্রাহক তথ্য দিয়ে ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৩’ শীর্ষক এক বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা রাখা টাকার পরিমাণও উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৩ সাল শেষে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের প্রায় ৩৭ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ জমা রয়েছে। মার্কিন ডলারে যা ৪১ কোটি ৪০ লাখ ডলার। টাকার অংকে এর পরিমাণ ৩ হাজার ১৬২ কোটি ৩৭ লাখ। অথচ ২০১২ সালে ছিল ১হাজার ৯০৮ কোটি টাকা। মাত্র এক বছরের ব্যবধানেই বেড়েছে ১ হাজার ২৫৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতীয় নাগরিকদের জমা করা অর্থের পরিমাণ হচ্ছে ১৩ হাজার ৬০০ কোটি রুপি। তবে এই হিসাবে ব্যাংকের ভল্টে রাখা স্বর্ণ বা মূল্যবান কোনো সামগ্রীর আর্থিক পরিমাণ যোগ করা হয়নি। এই প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার ঝড় উঠে। জাতীয় সংসদেও আলোচনা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, টাকা পাচারকারীদের তথ্য প্রকাশ করা হবে। নড়েচড়ে বসে অর্থ মন্ত্রণালয়। পাচারকারীদের তথ্য ও টাকা ফেরত আনতে প্রক্রিয়া শুরু করতে নির্দেশ দেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে। সুইস ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকের তথ্য কাউকে দেয় না। শুধু যেসব দেশের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করা আছে তাদেরকেই এই সংক্রান্ত তথ্য দেয়া হয়। সমঝোতা চুক্তি করতেও উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ।অবৈধভাবে অর্থ পাচারকারীদের তথ্য ও পাচারকৃত অর্থের বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদানে একসঙ্গে কাজ করতে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাংলাদেশের পক্ষে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ইউনিট (বিআইএফইউ) গত ২৪ জুন সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগকে এই চিঠি দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এগমন্ড গ্রুপের সদস্য দেশ হিসাবে এই প্রস্তাবটি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন প্রতিরোধ ও অর্থপাচার রোধসহ আর্থিক খাতের দুর্নীতিসহ যেকোনো ধরণের তথ্য-আদান প্রদানের জন্য গঠিত সংস্থার নাম এগমন্ড গ্রুপ।বাংলাদেশ ব্যাংক এগমন্ড গ্রুপের সদস্য। সুইজারল্যান্ডও এই গ্রুপের সদস্য দেশ। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বিশ্বের ২৪টি দেশের এই ধরনের চুক্তি রয়েছে। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছে বিশ্লেষকরা। তাদের মতে পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের সঙ্গেই সুইস ব্যাংকের চুক্তি নেই। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এব্যাপারে আশা ছাড়েনি। এদিকে ইউএনডিপি বা জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি উন্নয়নশীল দেশ থেকে কি পরিমাণ অর্থপাচার হয় তার ওপর ভিত্তি করে একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সম্প্রতি। প্রতিবেদনে ৮টি উন্নয়নশীল দেশের তথ্য তুলে ধরা হয়। তালিকা অনুসারে অর্থপাচারের দিক থেকে প্রথম অবস্থানে রয়েছে আইভরিকোস্ট। দেশটি থেকে বছরে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১০ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে গত বছরে গড়ে ৬ হাজার ২৪০ কোটি টাকা বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটির প্রতিবেদন মতে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার হয় সাধারণত এলসির মাধ্যমে পণ্য আমদানির সময়ে আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিং করে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে। তবে বছরে ঠিক কী পরিমাণ টাকা বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে এর সঠিক কোনো হিসাব বাংলাদেশের সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই। সুইস ব্যাংকগুলো যেভাবে তাদের গ্রাহকদের গোপনীয়তা রক্ষা করে, সেজন্য বিত্তশালীদের অনেকেই তাদের বিপুল সম্পদ গোপনে গচ্ছিত রাখেন এসব ব্যাংকে। কিন্তু সুইস ব্যাংকগুলোর এই গোপনীয়তার নীতির সুযোগ নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার বড় বড় কোম্পানী এবং বিত্তশালীরা তাদের কর ফাঁকি দেয়া অর্থ সেখানে পাচার করছেন বলে অভিযোগ অনেক দিনের। সুইস ব্যাংকগুলো যাতে তাদের এই নীতি বদলায় এবং গ্রাহকদের সব তথ্য প্রকাশ করে সেজন্যে চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর প্রেক্ষিতে কিছু কিছু তথ্য তারা প্রকাশ করছে। বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের চাপের মুখে সুইস ব্যাংকগুলো কতদিন তাদের গোপনীয়তার নীতি পুরোপুরি ধরে রাখতে পারবে? সেটাই এখন দেখার বিষয়।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.