কাজী আবুল মনসুর :
প্রবাসি ছোট্ট ব্যবসায়ি কায়সার। কায়সারের বাড়ি বাশঁখালিতে। দেশে কন্যা সন্তানের জম্মের কথা শুনে বন্ধু-বান্ধবদের খাওয়াচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে একজন সাংবাদিকও খাবার দাওয়াতে আসবেন এমন আলাপ তারাঁ আগে ভাগেই সেরে রেখেছেন। আরব আমিরাতে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন চৌধুরী জানালেন, ‘এখানে এটাই বাংলাদেশীদের রীতিনীতি। দেশের কোন সুংসবাদটি একত্রে ভাগ করে নেয়।’ আজমান আর শারজাহ থেকে দুবাই যাওয়ার রাস্তায় তেমন কোন জটিলতা নেই। এখানকার ট্রাফিক ব্যবস্থা এমন যে পথ হারালেও এক সময় না এক সময় নির্ধারিত স্থানে পৌছানো যাবে। কোন বেগ পেতে হবে না।
তবে এখানে ভ্রমনের জন্য যে বাহনটি সবচেয়ে জরুরী তা হলো একটি গাড়ী এবং একজন মানুষ যিনি শহরের অলিগলি চেনেন। তবে দুবাই এর পূর্বে ইতিসালাত নামক স্থানে মেট্রোট্রেন আছে বলে শুনেছি। যা শারজাহ ও দুবাই এর সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। এ ট্রেনে চলাচল অপেক্ষাকৃত সস্তা। যাদেও ট্রেন সর্ম্পকে ধারনা আছে তারা ট্রেনে চলাচল করে।
আজমান থেকে দুবাই যেতে লেগেছে মাত্র ৩০ মিনিট। দুবাই এ ঢুকে প্রথম দেখলাম সবজি বাজার। সবজি বাজারে ব্যবসায়ী রাঙ্গুনিয়ার আজিম উদ্দিন গাড়ী সোজা ‘ইতালি’তে নিয়ে যেতে বললেন। ‘ইতালি’র কথা শুনে আমার তো চোখ ছানাবড়া। এখানে আবার ইতালি আসলো কোথা হতে। দুবাই যাবার পথে দেখলাম রাস্তাগুলো একেবারে সোজা। দু’পাশে নানা স্থাপনা। অনেক দুরে দুরে পুরানো দিনের স্থাপত্য নির্ভও বেশ কিছু বাড়ি ঘর দেখতে পেলাম। প্রথম জানলাম, এসব বাড়িতে থাকেন এদেশের অধিবাসীরা। শহর থেকে দুরে থাকতে তারা পছন্দ করেন। থাদেও থাকার পরিবেশ হতে হবে শব্দহিন। শহরের যান্ত্রিককা তাদেও পছন্দ না। দুর থেকে ছোট দেখা গেলেও এ বাড়ির ভেতওে সুইমিং পুল থেকে শুরু করে সবকিছু আছে।
ইতালিতে এসে গেছি। গাড়ি থেকে বের হবার পর দেখরাম ইতালির ইউ-১০ নাম্বারের একটি ফ্ল্যাটে খাবারের আয়োজন। জানলাম, দুবাই সরকার বিভিন্ন দেশকে তাদেও দেশে আলাদা আলাদ ব্লক বিক্রি করেছে থাকার জন্য। যার পরিচিতি হবে ঐ দেশের নামে। ঘুরে দেখলাম ইংল্যান্ড, চীন, আমেরিকা, জাপানসহ বিভিন্ন উন্নত দেশগুলোর নামে বিশাল বিশাল ফ্ল্যাট ব্লক। ইংরেজি ‘এ’ থেকে ‘জেড’ পর্যন্ত নাম্বারিং এর মাধ্যমে এগুলো পরিিেচত। পরিকল্পিতভাবে কিভাবে আবাসন ব্যবস্থা করা যায় তার একটি নমুনা দুবাই এর এই বিদেশ ব্লক। অবশ্য এসব ব্লাকে শুধু সে দেশের লোকজন থাকে সেটা না, ভিন্ন দেশের নামে নামাঙ্কিত হলেও এখানে ভাড়ায় থাকেন দেশি বিদেশী লোকজন।
এসব ফ্ল্যাট ব্লকের অনেকাংশে বাঙ্গালীরাও ভাড়ায় থাকেন। দাম বেশি হবার কারনে ১০/১২ বাঙ্গালি একসাথে বাগ করে বাস করেন। একটি রুমের ভাড়া পড়ে বাংলাদেশি টাকায় ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এ রকম একটি ফ্ল্যাটে দেখা হলো ২০ জনের মতো চট্টগ্রামবাসীর সাথে। যারা এসেছেন দাওয়াত খেতে। শুক্রবার ছুটির দিনে সবাই এক সাথে হয়ে আড্ডা, দেশের, পরিবারের খবরা খবর ভাগ করেন এরা। দেশের মানুষের জন্য এদের অনেক টান। এখানে কথা হয় সবজি বাজারের শ্রমিক আলতাফের সাথে।
তাঁর বাড়ি চকরিয়ায়। দুবাই এসেছে দু’বছর হচ্ছে। এখনও তেমন সুবিধা করতে পারে নি। আলাপকালে আলতাফ বলেন, ‘সারাদিন পরিশ্রম করে যদি পরিবার আর দেশ থেকে কোন শান্তি খবর শুনে তাহলে ভালো লাগে। পরিবারের চাহিদার অনেক সময় তাল মেলাতে পারি না। তারা মনে করে এখানে টাকা কামানো সহজ। রাত হলে আমার মতো অনেক শ্রমিকের পরিবার থেকে ফোন আসে এটা-সেটার পর সবার চাহিদা শুধু টাকা আর টাকা। কিন্ত কেউ একবার বুঝতে চেষ্টা করে না, এখানে টাকা কামানো কত কঠিন। তাছাড়া পরিবারের নানা রকম সমস্যার কথা রাত হবার সাথে দেশ থেকে ভেসে আসে। এগুলো সামাল দিয়ে এখানে টাকা রোজগার যে কত কঠিন তা কারে বুঝায়।’
দুবাই এর সাথে চট্টগ্রামের সম্পর্ক অনেক দিনের পুরানো। দুবাইওয়ালা শব্দটি বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত। এক সময় চট্টগ্রামের মানুষ বিদেশ বলতে দুবাইকে বুঝতো। চট্টগ্রামের মানুষেদের অনেকে বংশপরম্পরায় দুবাই আছেন। এক সময় দাদা ছিলেন দুবাই,। পরে দাদার হাত ধরে ছেলে নাতি এমনকি পুতিরাও দুবাই এসেছেন এমন নজির অহরহ। চট্টগ্রামের মানুষ আরব আমিরাত বলতে বুঝত দুবাইকে। পরে আরব প্রদেশগুলো সাত রাজ্যে ভাগ হয়ে গেলেও সাধারন চট্টগ্রাম বাসীর কাছে আরব আমিরাত মানে এখনও দুবাই মনে হয়। দুবাই ভ্রমনে এসে এ বিষয়টি বেশ টের পাচ্ছি। আরব আমিরাতে ১০ থেকে ১২ লাখের মতো শ্রমিক আছে। এর অর্ধেকেরও বেশি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার।
দুবাই ঘুরে মনে হলো এটি এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ট একটি রাজ্য। যেখানে টাকা দিলে সব মেলে। আরব আমিরাতের সবচেয়ে দামি একটি প্রদেশ হচ্ছে দুবাই। পারস্য উপসাগর ঘিরে রয়েছে আরব আমিরাতের বেশ কয়েকটি প্রদেশ। দক্ষিন তীরে দাড়িয়ে আছে দুবাই। ১৮৩৩ সাল থেকে দুবাই শাসন করে আসছে আল মাকতুম পরিবার। আরব আমিরাতের রাজধানী আবুদাবি হলেও দুবাই এর ভূমিকা বহিঃবিশের্^ বেশ প্রভাব বিস্তারকারি প্রদেশ হিসেবে চিহ্নিত। আরব আমিরাতের ৭টি প্রদেশের মধ্যে আবুদাবিতে রয়েছেন আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট আর আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী ও উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে রয়েছেন দুবাই এর বর্তমান শাসক মুহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম।
দুবাই বিমান বন্দর বিশ্বের অন্যতম বিমান বন্দর হিসেবে স্বীকৃত। বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর তৃতীয় ব্যস্ত বিমান বন্দর হচ্ছে দুবাই। দুবাই বিমান বন্দরের ব্যস্ততা বুঝা যায় প্রতি ক্ষনে ক্ষনে বিমান নামা দেখে। রাস্তা দিয়ে চলার পথে বিমান বন্দরের কাছে এলে দেখা যায় বিমান নামার চিত্র। এ বিমান বন্দর বহু দেশের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার হয়। ফাঁকা রাস্তায় দুবাই ঘুরার মজাই আলাদা। সাধারনত ছুটির দিনে রাস্তায় তেমন জ্যাম থাকে না। তবে খোলার দিনে অফিস সময়ে জ্যাম থাকে। তবে পরিকল্পিত ট্রাফিক ব্যবস্থার কারনে জ্যাম ছুটতে বেশি সময় লাগে না।
দুবাই শপিং মল দেখে মোহিত না হয়ে পারা গেল না। এর আগে দুবাই এর বিদেশী ব্লক গুলোর পাশে চীনাদের ‘ড্রাগন মার্কেট’ নজর কেড়েছে। চীনারা তৈরি করেছেন এ বিশাল মার্কেট। এ টু জেড সব ধরনের পন্যে ঠাসা এ মার্কেটি সব সময় সরগরম থাকে। বিশেষ কওে সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে খোলা থাকার কারনে এখানে লোকসমাগম প্রচুর হয়। ড্রাগন মার্কেটের প্রবেশ মূখে নির্মিত ড্রাগনের ‘ফোয়ারা’ টি মার্কেটের অস্তিত্বকে জানান দেয়।
এ মার্কেটে রয়েছে অনেক বাংলাদেশি। বিভিন্ন দোকানে বিক্রয় কর্মী হিসেবে তারা কাজ করছে। তবে সবচেয়ে সেরা হচ্ছে দুবাই এর কেন্দ্রে অবস্থিত দুবাই শপিং মল। অত্যাধুনিক এ শপিং মলটিতে বিনোদনের ব্যবস্থা থেকে শুরু সব কিছু রয়েছে। বিদেশি নানা দামি ব্রান্ডের পণ্যই এখানে শোভা পাচ্ছে। ইউরোপ, আমেরিকান পর্যটকে ভরা। বাইরে নানা দামি গাড়ির বহর দেখলে বুঝা যায় দুবাই এর আসল রূপ। পৃথিবীর অন্যতম উন্নত শহর দুবাই ঘিরে রয়েছে নানা কথা। কেউ কেউ এ বিলাসবহুল শহরকে বলে থাকেন মাফিয়াদের স্বর্গরাজ্য। যাদের অঢেল টাকা আছে তাদের জন্য দুবাই হচ্ছে টাকা খরচ করার জায়গা। পথ চলতে যদি কোন সোনায় মোড়ানো গাড়ী বা উড়ন্ত কোন হেলিকপ্টার যদি পথিমধ্যে নামতে দেখা যায় তাহলে তা অসম্ভব কিছু নয়। সাধারনত মানুষ মেশিন থেকে টাকা উত্তোলন করে, কিন্ত দুবাইতে সোনা উত্তোলনের মেশিনও আছে।
দুবাই গণতান্ত্রিক রাজতন্ত্র ব্যবস্থায় চলছে। দুবাই এ পরিচয় সেখানকার অধিবাসী সাইদ বিন আবরার এর সাথে। তিনি বলেন,‘দুবাইকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে মানুষ সে যে হোক আইনের মধ্যে থেকে সব কিছু করতে পারে। টাকা থাকলে দুবাই এ ব্যবসা করা সহজ। এখানকার ব্যাংকি ব্যবস্থা সহজ। ইচ্ছে করলে ইনভেস্টও ভিসা নিয়ে একাউন্ট করতে পারে। এখানে কেউ প্রশ্ন করবে না এত টাকা কোথা থেকে কিভাবে এলো। তিনি বলেন, ব্যাংকিং সহজতার কারনে এখানে বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা তাদেও কোটি কোটি ডলার গচ্ছিত রাখেন। আইন কানুন কড়া এবং ব্যাংকিং গোপনীয়তার কারনে কারও হিসেব কেউ জানতে পারেন না। সব লেনদেন অনলাইনে এবং গোপন পাসওয়ার্ডেও মাধ্যমে হয়ে থাকে।’
দুবাই ঘুরে জানা গেছে, মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিম থেকে শুরু করে হলিউড-বলিউডের নানা দামি তারকারাও এখানে নিজেদের অলস সময় কাটান। অনেকের ব্যবসা বাণিজ্য রয়েছে। অনেকের সাথে সম্পর্ক রয়েছে দুবাই এর বড় ব্যবসায়ী বা রাজপরিবারের সদস্যদের সাথেও। ১০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করলে এখানে টাকার উৎস সর্ম্পকে কোন প্রশ্ন করবে না। দুবাই এর রিয়েল এস্টেট ব্যবসা ও সোনার ব্যবসায় বিনিয়োগ করার জন্য বরং দুবাই সরকার স্বাগত জানায়। দুবাই এর ২১টি শপিং মলের মধ্যে অনেকগুলোর মালিক বিদেশিরা। গোল্ড বা শউক মার্কেট বলে পরিচিত দুবাই এর সোনার বাজার আরেক বিস্ময়ের। বিশেষ কওে দুবাই এর ‘দেরা’ বা ‘দেরা দুবাই’ খ্যাত সোনার বাজার বেশ প্রসিদ্ধ। এখান থেকে সোনা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যায়। সোনার বাজার প্রতিদিন শেয়ার বাজারের মতোন উঠা নামা করে।
দুবাই দেখার জন্য এখন বাংলাদেশের মতোন উন্নয়নশীল দেশগুলোর নাগরিকদের ট্যুরিস্ট ভিসা সহজ করে দিয়েছে সরকার। পূর্বে এটি কঠিন ছিল। এখন যে কোন ব্যবসায়ী যিনি ইনভেস্টও ভিসায় দুবাই থাকেন তিনি ভিসা বের করতে পারেন এজেন্টদেও মাধ্যমে। বাংলাদেশেও এয়ার এরাবিয়া কতৃপক্ষ সহজভাবে এ সুযোগ কের দিচ্ছে প্যাকেজের মাধ্যমে। খরচ পড়বে ৫০ থেকে ৫২ হাজার টাকার মতো। ভিজিট ভিসা খোলার পর থেকে বাংলাদেশ থেকে গত ক’মাসে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ দুবাই গেছেন। দুবাই বিমান বন্দরে বাংলাদেশি পাসপোর্ট হলেও কোন বাড়াবাড়ি নেই। কোন হয়রানি নেই। কারন হিসেবে জানা গেছে, আমিরাত পুলিশ তাদের পর্যবেক্ষনে উপলদ্ধি করেছেন, বাংলাদেশের ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে এসে ফেরত যায় নি এমন কোন নজির নেই। তাই ভিসা প্রক্রিয়াও আরও সহজ করা হচ্ছে। দুবাই পুলিশের নজর ফাকিঁ দিয়ে এখানে কাজ করা অনেক কঠিন। বর্তমান প্রশাসন দুবাই এর পুলিশ বাহিনীর জন্য অত্যাধুনিক সব গাড়ী ব্যবহার করতে দিয়েছে যার মূল্য তিন থেকে পাচঁ লাখ ডলার। দুবাই এর অত্যাধুনিক সিসিটিভি ব্যবস্থা ও ডিজিটাল ব্যবস্থার কারনে এখন অবৈধভাবে এ দেশে বাস করা কঠিন। যে সব বাঙ্গালি এখনও অবৈধ আছেন তাদের কেউ কোন না কোনভাবে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। বৈধ ভাবে ভিসা নিয়ে যেতে পারলে এখানও দুবাইতে টাকা উপাজর্নের বিস্তর সুযোগ রয়েছে।