-- বিজ্ঞাপন ---

দুবাই এর বিস্ময় বুর্জ খলিফা

0

কাজী আবুল মনসুর  :

আরব আমিরাতের সবচেয়ে ধনী দেশ আবুধাবি। আরব আমিরাতের রাজধানী বলে আবুধাবির টাকায় নাকি অন্যরা চলে। সংযুক্ত আরব আমিরাত বা ইউএ ইর আয়তন প্রায় ৮৩ হাজার ৬ শ’ বর্গ কিলোমিটার। আবুদাবি হচ্ছে দেশটির মোট আয়তনের ৮৬ শতাংশ। এরপর রয়েছে দুবাই এর স্থান ৫ শতাংশ। বাকিগুলো আয়তনের দিক থেকে অতি ক্ষুদ্র। আরব আমিরাত মূলত সাতটি স্বাধীন রাষ্ট্র নিয়েই গঠিত। দুবাই, আজমান, ফুজাইরাহ, রাস আল কায়মা, শারজাহ ও উম্মুল খুওয়াইন। এগুলোকে কেও বলে রাজ্য, কেউ বলে প্রদেশ। আসলে এগুলো এক একটি রাষ্ট্র। কারন তাদের প্রশাসন ও শাসন ব্যবস্থা আলাদা। তারা যৌথভাবে ফেডারেল সুপ্রিম কাউন্সিল গঠন কওে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আছে। তেল সমৃদ্ধ বলে আবুদাবির অবস্থান অন্যদের চেয়ে উচুতে। বংশ পরম্পরায় বা উত্তরাধিকার সূত্রে আবুদাবির রাজ পরিবারই ফেডারেলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল থাকেন। আমিরাতের তেল মজুদ ক্ষমতা বিশ্বে সপ্তম এবং গ্যাসের মজুদ বিশ্বে ১৭তম। আবুদাবি আমিরাতের রাজধানী হিসেবে আধিপত্য বজায় রাখে। আবুদাবি ছাড়া অন্য রাষ্ট্রগুলো কার্যত তেমন ক্ষমতা রাখে না। আরব আমিরাতে মোট জনসংখ্যা এক কোটির মতোন। মজার বিষয় হচ্ছে, মোট জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশই অভিবাসি! এর মধ্যে আমিরাতি মাত্র ১৯ শতাংশ। দক্ষিন এশিয়ার প্রায় ৫০ শতাংশ জনসংখ্যা এ দেশে রয়েছে।
আবুধাবি গিয়ে বুঝলাম সুন্দর পরিপাটি এ রাজ্যে অসংখ্য বাংলাদেশি। বিশেষ করে চট্টগ্রামের লোকদের আধিপত্য। রাঙ্গুনিয়ার রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী জসিম ভাই টানা প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার গাড়ী চালিয়ে আজমান থেকে আবুধাবি নিয়ে আসেন। এখানে নেমে নজরকাড়া সব ভবন দেখে বুঝার উপায় নেই কি পরিমান অর্থবিত্তের মালিক এরা। বাঙ্গালি হোটেলে দেশের খাওয়া। খেতে বসেই চতুর্দিক থেকে চট্টগ্রামের ভাষায় কথার কলকাকলি। যেই সবার মুখে খৈ ফুটছে। ” অড়া বারির খনঅ খবর পাইয়ুছ না…খালেদা জিয়ারে লই সরকারে কেন গরের দে….চিটাগাং অত তুন কমিশনার ভাই আইস্যি। এমন সব কথা। পথে নেমে ফুটপাত ধরে হাটতে হাটতে চট্টগ্রামের ভাষায় শুনছি। বুঝলাম এলাকাটিতে চট্টগ্রামের লোকজনই সবচেয়ে বেশি। পথ চলতে চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলা লোকজনের অভাব নেই। বিশেষ করে বিভিন্ন বড় বড় শপিং মলগুলোর বিক্রয় কর্মী হিসেবে অসংখ্য বাংলাদেশি নজরে পড়ার মতো। চট্টগ্রাম থেকে বেড়াতে গেছি আর সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে অনেকে মনের কখা খুলে বলতে চায়। জানতে চায় দেশের খবর। কোথায় কোথায় যাওয়া যায় তার জন্য পরামর্শ সহ তাদের সাথে দু’একদিন কাটানোর অনুরোধ। দেশের রাজনীতির হাল হকিকত জানতে চায়। অনেকে জানতে চান এখন দেশে গেলে সমস্যায় পড়বে কিনা। এদের কেউ আওয়ামি লীগ আর কেউ বিএনপি। তবে যে দলই করুক না কেন সবাই দেশের ভাল চায়। মঙ্গল চায়। সবার একটাই কথা দেশের সব কিছু ভালো হোক। আবার অনেকে রাজনীতির নামও শুনতে চান না। দেশের কাস্টমসে হয়রানি আর নিজেদের সন্তানের পড়াশুনা নিয়ে সবচেয়ে চিন্তিত থাকেন এরা। এখানে অফিসের নিয়ম কানুন খুবই কড়া। কড়ায় গন্ডায় কাজ আদায় করে নেয়। ফাকিঁর কোন অবকাশ নেই। সন্ধ্যা হলে এরা আবুদাবি মূল কেন্দ্রে জড়ো হয়। সুখ দুঃখ শেয়ার করে। কারও কারও দোকানে টেলিভিশন চলে। সবার নজর কোন গান বাজনা বা কোন নাটক সিনেমা নয়। টেলিভিশনের সংবাদের প্রতি আগ্রহটা সবচেয়ে বেশি। নিজের দেশের নতুন কাউকে পেলে দেশটির আইন কানুনের কড়াকড়ি আর বৈধভাবে থাকলে নিজের নিরাপত্তা কতটুকু শক্তিশালি তাও তুলে ধরে। একই সাথে বাংলাদেশের চিত্র ঘুরেফিরে চলে আস। সবার মধ্যে সবসময় ঘুরেফিরে একটাই প্রশ্ন,কবে আমাদের দেশটি এ দেশের মতোন হবে। ওদের সাথে সাথে আমিও উত্তর খুজে বেড়াচ্ছি। বিদেশে আসলে নিজের দেশের দুবর্লতাগুলো স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। কত পদ্ধতিগত ভাবে একটি দেশ নিজেদের সমৃদ্ধ করে তা আবুদাবিতে এসে আরও বুঝলাম। আবু ধাবির সবচেয়ে বিস্ময়ের বস্তু হলো শেখ জায়েদ গ্রান্ড মসজিদ। সুন্নি মতাদর্শী বলে খ্যাত এ মসজিদটি এমনভাবে নিমার্ন করা হয়েছে যা দেখলে যে কারও চোখ জুড়িয়ে যাবে। প্রায় সাড়ে ৫’শ মিলিয়ন দেরহামে নিমির্ত এ মসজিদে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ একসাথে নামাজ পড়তে পারে। ২৪ ক্যারেটের স্বর্ন দিয়ে বানানো হয়েছে মসজিদের অনেক স্তম্ভ। আবুধাবির মূল কেন্দ্রে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে মসজিদটি। আবুধাবির পাশ দিয়ে বয়ে চলা পারস্য উপসাগরের একপাশ ঘিরে বানানো হয়েছে ধনী শেখ দের অনেক বাড়ীঘর। অনেকটা নদী শাসন করে বানানো হয়েছে সৈকত। সৈকতকে তারা বলে ‘কর্নিশ’। অনন্য সুন্দর এ কনির্শ’ ঘিরে পযর্টনকে তারা উচ্চ মাত্রায় নিয়ে গেছে।
দিনভর আবুদাবিতে ঘুরাঘুরি করে দুবাই এর পথে যাত্রা। যাত্রা পথে দেখা যায় মরুভুমির মাঝ বরাবর বিমাল রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। পাশে ধু ধু মরুভুমি। অনেকাংশে তৈরি করা হয়েছে ফ্লাইওভার। সন্ধ্যা নাগাদ পৌছুতে হবে দুবাই এর কেন্দ্রে। রাতে দুবাই এর র্বুজ খলিফা না দেখলে ভ্রমন মাটি হয়ে যাবে। যাত্রা পথে রয়েছে গাড়ীর তেল কেনা ও বিশ্রামের জায়গা। মূল রাস্তার বাইরে ইউ টার্ন করে অল্প দুওে পেট্রোল পাম্প। প্রতিটি পেট্রোল পাম্প এর সাথে বড় আকৃতির ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। পথ চলতে ‘ওয়াশরুম’ ব্যবহার বা কোন কিছু কিনে খেতে এ ব্যবস্থাটি করা হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে। গাড়ীর তেল নেয়া এবং আনুসাঙ্গিক কাজ সেরে যাতে দুরের যাত্রায় যেন ক্লান্তি না আসে তার জন্য এ ব্যবস্থা।
বিলাসি আরবরা যে আকাশ ছুতে চায় তা দুবাই এসে বুঝলাম। আকাশের নাগাল না পারলে তারা ধরবে চায় মেঘ। তাদের সে আশা পূরন হয়েছে। দুবাইতে তারা এমন একটি স্থাপনা নির্মান করেছেন যাতে তারা সত্যিকার অর্থে মেঘ ধরতে পারেন। সে স্থাপনার নাম ‘র্বুজ খলিফা’। উপরের দিকে আধা মাইল লম্বা এ র্বুজ খলিফা দেখতেই  বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে আসেন হাজার হাজার পর্যটক। বর্তমানে বিশে^র সবচেয়ে উচুঁ ভবন। যার উচ্চতা ১৬৩ তলা। দুবাই এর বিস্ময়কর নির্মান। পাশাপাশি আর এক বিস্ময়কর নির্মান হচ্ছে দুবাই এর ‘মিরাকেল গার্ডেন।’ নাম যেমন তেমনই, মিরাকেল গার্ডেন আসলেই মিরাকেল।

কেন মানুষ দুবাই ভ্রমন করতে চায়, তার দুটি নমুনা হচ্ছে র্বুজ খলিফা ও মিরাকেল গার্ডেন। স্বর্ন আর সৌন্দর্য্যেও কথা বাদ দিলাম। মিরাকেল গার্ডেন আর বুর্জ খলিফা দুবাইকে নিয়ে গেছে অন্য এক মাত্রায়। প্রতিদিন এ দুটি পর্যটন কেন্দ্র দেখতে বিশ্বের  হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে। আরবরা র্কুজ খলিফা নির্মান করে বিশ্বে  তাক লাগিয়ে দিয়েছে। দুবাই এর কেন্দ্র স্থলে এ র্বুজ খলিফা নির্মান কওে তারা দেখিয়ে দিয়েছে স্থাপত্য ও নির্মান শিল্পে বিশ্বের আরবদের স্থান কোন অংশে কম নয়। রাতে র্বুজ খলিফার সৌন্দর্য্য দেখার কথা কেশ আগেভাগেই শুনছিলাম। র্বুজ খলিফা শুধু ভবন নয়, এই ভবনকে ঘিওে অসাধারন সব আয়োজন ছিল নজরে পড়ার মতোন। বিশেষ করে র্বুজ খলিফাকে সামনে রেখে জলের নৃত্য অসাধারণ। এ নৃত্য দেখার জন্য আগে ভাগেই ফোয়ারার পাশে জায়গা দখলে রাখতে হয়। তা না হলে দুর থেকে দেখলে তাতে আনন্দ পাওয়া যায় না। ফোয়ারা পাশে দাড়িয়ে কয়েক মিনিটের আতশবাজি আর জলের নৃত্য পর্যটকদের মোহগ্রস্ত করে রাখে।
‘বুর্জ খলিফা’র উচ্চতা ১৬৩ তলা । ২০০৬ সালের ৬ জানুয়ারী এর নির্মান কাজ শুরু হয়। ২০০৯ সালের মধ্যে শেষ হয় এর বাইরের কাঠামো নির্মানের কাজ। ২০১০ সালে এটি পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে। এ ভবন নির্মানের আগে তাইওয়ানের ১০১ তলা ভবনটি ছিল  বিশ্বের সবচেয়ে উচূ ভবন। ২০১০ সালে ভবনটি খুলে দেয়া হয়। নাম ছিল দুবাই টাওয়ার। অনেকটা জাপানের টোকিও টাওয়ার বা ফ্রান্সের প্যারিস টাওয়ারের মতোন। কিন্ত আরব আমিরাতের শাসক খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ানকে সম্মান জানাতে গিয়ে নাম পাল্টে রাখা হয় ‘র্বুজ খলিফা’। এ ভবনটি তৈরি করতে দুবাই এর প্রশাসন আবুদাবিসহ বিভিন্ন প্রদেশ থেকে ঋণ নিয়েছিল। পরে তা শোধ করা হয়। এ ভবনে রয়েছে সেভেন স্টার মানের হোটেল। এ র্বুজ খলিফা একটি গগনচুম্বি অট্টালিকা। বলা হয়ে থাকে এটি পৃথিবীর অনন্য সৃষ্টি। দু’হাজার ৭১৭ ফুেটর এ ভবনটি বানাতে খরচ হয়েছে এক দশমিক পাচঁ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রায় ১২ হাজার ৫শ কোটি টাকা। ১৬৩ তলার এ ভবনটিতে মসজিদ, দর্শনাথিদের কক্ষ, থাকার হোটেলসহ বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে। এখানে স্থাপন করা লিফটের গতিবেগ ঘন্টায় ৪০ মাইল। মাত্র ৬ বছরে এ বিশাল ভবনটি নির্মান করা হয়েছে। বাইরে ফোয়ারা নির্মানে ব্যয় প্রায় ১৩৫ মিলিয়ন বৃটিশ পাউন্ড। এ র্বুজ খলিফার ভেতরে রয়েছে ৫৭টি এ্যলিভেটর ও ৮টি এ্যস্কলেটর। প্রায় ৪০ লাখ বর্গমিটারের এ ভবনে ৪০৩টি স্যুটের একটি বিলাস বহুল হোটেল রয়েছে। এটি নির্মানে ১২ হাজার শ্রমিক এক সাথে কাজ করেছেন।
দুবাইয়ের আর একটি সৃষ্টি হচ্ছে মিরাকেল গার্ডেন। ২০১৩ সালে ভ্যালেন্টাইনস ডে উপলক্ষে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুলের বাগান খ্যাত এ মিরাকেল গার্ডেনটির উদ্বোধন করা হয়। ৭২ হাজার বর্গমিটার আয়তনের এ বাগানে ৪৫ মিলিয়নেরও বেশি ফুল রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, অনেক নতুন ফুলের জম্মও এখানে। যা বিশে^ও কোথাও নেই। বাড়ি, গাড়ি থেকে শুরু করে হার্ট, বিমান, ইগলু, পিরামিড, পশু পাখিসহ অনেক কিছুর বিভিন্ন আকৃতি বানানো হয়েছে ফুল দিয়েই। বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ফুল লাগানো হয় এ বাগানে। তবে অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দর্শনার্থীরা বাগানটি দেখার সুযোগ মেলে। বাকি গরমের সময় এটি বন্ধ থাকে। এটার পাশাপাশি ২০১৫ সালে দুবাইতে বানানো হয়েছে প্রজাপতি পার্ক। এ পার্কে ২০ হাজারেরও বেশি প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে।

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.