-- বিজ্ঞাপন ---

দেশের বোঝা এখন বঙ্গবন্ধু টানেল

আগামী বছর থেকে শোধ করতে হবে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা লোনের কিস্তি

0

বিশেষ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম ব্যুরো##
দেশের জন্য বড় ধরনের বোঝা গেলো কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে তৈরি হয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেল। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের স্বপ্ন দেখানো এই টানেলটি নির্মানে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। চীন সরকারের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে বানানো এ টানেলের ঋনের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে আগামী বছর থেকেই। উচ্চবিলাসী এ প্রকল্পে প্রতি দিন আয় হচ্ছে ১০ লাখ টাকার মতো, আর ব্যয় প্রায় ৩৮ লাখ টাকা। এটি চালু থাকলেও বিপুল লস, বন্ধ করেও দেয়া যাবে না। কারন চীনকে কিস্তি দিতেই হবে। গত ২৯ অক্টোবর থেকে এ বছরের ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত বিপুল পরিমান ব্যয় হয়েছে। ব্যয়ের আড়ালে আয়ের চিহ্নও মিলছে না। প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার গাড়ী চলার কথা থাকলেও চলছে না ৩ হাজার গাড়ীও।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এক শ্রেনীর আমলা ও রাজনীতিবিদ মিলে গ্রহণ করে উচ্চবিলাসী এ পরিকল্পনা। এ সময় অনেক বিশেষজ্ঞ প্রকল্পটি বাংলাদেশের জন্য বোঝা হিসেবে দেখা দেবে বললেও সরকার কথা শুনেনি। দেশ টানেল জগতে প্রবেশ করছে বিশ^কে দেখাতে গিয়ে চীনের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয় সরকার। টানেল নির্মানের জন্য চীন আগ্রহ দেখালে গত ২০১৬ সালের শুরুতে শুরু হয় তোড়জোর। চীন থেকে পর্যবেক্ষক দল পরিদর্শন করে চট্টগ্রামের কর্ণফুলি এলাকাটি।  এ বছরের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। সিদ্ধান্ত হয় চীন ও বাংলাদেশ সরকার যৌথভাবে টানেল নির্মান করবে। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চলে নানা স্টাডি। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী টানেল নির্মানের কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেস হাসিনা। চীনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন টানেল নির্মানকারী প্রতিষ্ঠান ‘চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন’ লিমিটেড কাজ শুরু করে। টানা সাড়ে ৪ বছর ৮ মাস করার পর টানেল নির্মান শেষ করে। গত ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিপুল টাকা ব্যয়ে উদ্বোধন করা হয় প্রকল্পটির। সব মিলে শেষপর্যন্তÍ ব্যয় দাড়ায় প্রায় ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার টানেল নির্মানের জন্য যখন কর্ণফুলির কথা চিন্তা করে তখনই বিশেষজ্ঞরা এটি দেশের জন্য এ মুহূর্তে ইতিবাচক হবে না বলে উল্লেখ করেন। কিন্ত কারও কথায় কর্ণপাত না করেই সরকার বিশাল এ কর্মযজ্ঞ হাতে নেয়। সরকারকে এ সময় কতিপয় সরকারী আমলা ও বন্দরের কতিপয় কর্মকর্তা এ বলে আশ^াস দেয়, বিদেশীরা টানেলকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ইচ্ছে প্রকাশ করেছে। চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমান বন্দর থেকে সরাসরি টানেল ভেতর দিয়ে যাওয়া পর্যটন নগরী কক্সবাজার। পর্যটন শিল্পের জন্য ইতিবাচক বিনিয়োগও হাতছানি দিচ্ছে। বিশেষ করে এ সময় চট্টগ্রাম বন্দর কতৃপক্ষের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বঙ্গবন্ধু টানেল ঘিরে অন্তত ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছে বন্দর। বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের সিংহভাগ পরিবহণ করে ডেনমার্কের মার্কস লাইন। ডেনমার্ক ভিত্তিক এ দীর্ঘদিন ব্যবসা করলেও নিজস্ব কোন বিনিয়োগ ছিল না। বর্তমানে টানেল ঘিরে মার্কস লাইনের ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে নতুন কনটেইনার ইয়ার্ড নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে লাগানো বলে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র নদীর তলদেশের এই টানেল। এ সময় বন্দর আরও জানায়, এরই মধ্যে বিদেশি ৭টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে এবং নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। এছাড়া প্রস্তাবিত বে- টার্মিনালে ডি পি ওয়ার্ল্ড এবং রেড সি ছাড়াও সিঙ্গাপুর পোর্ট অথরিটি, ভারতের আদানি গ্রুপ ও নেদারল্যান্ডসের এপি টার্মিনাল বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
টানেল নির্মানের আগে এসব স্বপ্ন দেখানো হলেও বন্দরের বর্তমান প্রশাসন এসব ব্যাপারে কোন কথা বলছে না। এগুলো আদৌ সম্ভব, নাকি স্বপ্ন তা নিয়ে মুখ খুলছে না কেউ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন,‘ এগুলো আগের চেয়ারম্যানের দায়ভার। তিনি তার ইচ্ছে মতোন কাজ করেছেন। কথা বলেছেন। এখানে বন্দর কর্তৃপক্ষের কিছু করার নেই।’
বিষয়টি নিয়ে দেশের অর্থনীতিবিদ ড. মঈনুল ইসলাম বিবিসি’কে বলেছেন, ‘স্বল্পমেয়াদে এটার আয় দিয়ে এটি নির্মাণে যে খরচ হয়েছে সে খরচ তোলা যাবে না। সেদিক থেকে এটা শর্ট টার্মে এটা বোঝা হয়ে থাকবে বাংলাদেশের উপরে। আগামী ৫-৭ বছরে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ হবে না।যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, কারণ আগামী ৫-৭ বছরে এটা পর্যাপ্ত ব্যবহৃত হবে না। এতে যথেষ্ট পরিমাণ গাড়ি চলাচল করবে না। ফলে প্রথম দিকে এটি বাংলাদেশের উপরে একটি বোঝা হয়ে থাকবে। তিনি উল্লেখ করেন, ২০২৫ সাল থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা শুরু হয়ে যাবে। আর স্বল্প মেয়াদে যে লাভ হবে এই টানেল থেকে সেটি ঋণ পরিশোধের জন্য যথেষ্ট হবে না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সহসাই হবে না বলেও মনে করেন তিনি। এই পর্যায়ে এসে এখান থেকে বের হওয়ার কোন রাস্তা নাই। এটা আন্ডার ইউটিলাইজ (কম ব্যবহৃত) হবে কয়েক বছর, এটা মেনে নিতেই হবে।’ একই মন্তব্য করেন অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের যোগাযোগ ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, “সঠিক সমীক্ষা ছাড়া একটি অবাস্তব প্রকল্প ছিল কর্ণফুলী টানেল। এখন কি করে এই লোকসান কমানো যায় আমরা সেই পর্যালোচনা করছি”।
আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রকৌশলী এম এ সবুর বলেন, এ প্রকল্পটি আসলে অনেক পরে হওয়ার কথা। কারন মেরিন ড্রাইভওয়ে নির্মান করা হলে এটি গুরুত্বহীন। মেরিন ড্রাইভওয়ের মাধ্যমে দেশের সমুদ্র বন্দরের পাড় ঘেষে চট্টগ্রামের সাথে ঢাকা-কক্সবাজারের সংযোগ স্থাপন করতে হবে। প্রয়োজনীয় লিংক অবকাঠামো এখানে নির্মান করা হয় নি। এ অবস্থায় শুধুমাত্র টানেল দিয়ে নদীর ওপারে যাতায়াত ছাড়া আর কিছুই সম্ভব না। আর এ ধরনের একটি বড় প্রকল্প করতে হলে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগুলো আগে দাড় করাতে হবে।
সূত্র জানায়,কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম টানেল নিয়ে যে ধরনের আশা ও সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল তার কিছুই নেই। নদীর ওপারে জমির দাম বাড়া ছাড়া আর কোন অগ্রগতি নেই। গত এক বছর ধরে প্রতিদিন কয়েকগুণ লোকসান গুনতে হচ্ছে। গড়ে প্রতিদিন যে টাকা আয় হচ্ছে এই টানেল থেকে, তার চেয়ে প্রায় চারগুণ বেশিই খরচ হচ্ছে। যদিও সম্প্রতি লোকসানের কারণ খুঁজতে এরই মধ্যে সেতু সচিবসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা প্রকল্পটি পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শনের পর তারা গণমাধ্যমকে বলেছেন,‘ঋণের টাকায় নির্মিত হওয়ায় এই প্রকল্প থেকে থেকে আয় তো দূরের কথা, প্রতিদিনের ব্যয়ও তোলা সম্ভব না। ফলে টানেলটির ভবিষ্যৎ নিয়েই এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
কর্ণফুলি নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মানের পরিকল্পনার বিষয়টি প্রকাশের পর চট্টগ্রামের বিএনপি নেতারা এ সময় এটি নিয়ে অনেক হাস্যরস করেছেন। বক্তৃতা-বিবৃতিতে বিএনপি নেতারা একে পাগলের প্রলাপের সাথে তুলনা করেন। শেষপর্যন্ত তাদের কথা যে সত্যি পরিনত হবে এমনটা তখন কেউ ভাবেননি।##

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.