-- বিজ্ঞাপন ---

যুদ্ধের মুখে এবার নিজ দেশের জাতীয় সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে যাচ্ছে ইউক্রেন!

সিরাজুর রহমান#

বর্তমানে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন যে কোন সময়ের তুলনায় ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আর এই অত্যন্ত প্রাণঘাতী অসম যুদ্ধের অন্তিম মুহূর্তে ইউক্রেনকে সহায়তার বিপরীতে দেশটিতে মজুত থাকা আনুমানিক ৫০০ বিলিয়ন ডলারের খনিজ সম্পদ এবং সকল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপর নিয়ন্ত্রণ দাবি করেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। ইউক্রেনের প্রশাসন খুব সম্ভবত ইতোমধ্যেই আমেরিকার সাথে নিজ দেশের শত বিলিয়ন ডলারের খনিজ সম্পদের মালিকানা ভাগাভাগি করে নিয়েছে কিংবা তা হয়ত এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

ফিনান্সিয়াল টাইমস নিউজের দেয়া তথ্যমতে, গতকাল ২১শে মার্চ শুক্রবার আমেরিকার প্রশাসন ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের উপর ভাগ বসানোর চুক্তির শর্তাবলি পুনর্বিবেচনা করতে চাইছে। যাতে করে ইউক্রেনের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রণও নিতে পারে তারা। এদিকে ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনকে যৌথ বিনিয়োগ তহবিল গঠন এবং এর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ সংক্রান্ত বিষয়ে মার্কিন প্রস্তাব মেনে নিতে প্রবলভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। যাতে ইউক্রেনের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো অন্যান্য সম্পদের নিয়ন্ত্রণ তারা খুব সহজে নিতে পারে।

ইউক্রেনের বর্তমান এই করুণ অবস্থার জন্য রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনকে দায়ী করা হলেও বাস্তবে ১৯৯১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে দেশটির প্রশাসনের ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবং চরম মাত্রায় রাশিয়া বিরোধিতাকে বেশি দায়ী করা হয়। বিশেষ করে দেশটি স্বাধীনতা লাভের পর নিজস্ব প্রতিরক্ষা ও সামরিক সক্ষমতা সর্বোচ্চভাবে নিশ্চিত না করার ভয়ংকর মাশুল আজ প্রতি সেকেন্ডে দিয়ে যাচ্ছে দেশটির সাধারণ জনগণ। বিশেষ করে নিজেকে একেবারে শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করতে গিয়ে আজ থেকে কয়েক দশক আগেই ইউক্রেন তার সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে রেখেছে।

এখানে বুঝতে হবে যে, আমেরিকাসহ গোট পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে এখন অস্ত্র দিচ্ছে ইউক্রেনকে শুধু রক্ষা করার জন্য নয়। বরং রাশিয়ার সামরিক শক্তিকে যতটা সম্ভব দুর্বল করে দিতেই এক দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্সি ওয়ার চালিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা ও তার ন্যাটো জোট। এখানে ইউক্রেনের লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ মারা গেলেও তাতে তাদের কিছুই যায় আসে না। আবার অন্যদিকে আমেরিকার মূল লক্ষ্য হচ্ছে যে কোন কৌশলে ইউক্রেনের প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের মূল্যবান খনিজ সম্পদের দখল নেয়া। এ জন্য তারা ইতোমধ্যেই প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের অধিক সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে গেছে।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে রাশিয়া এবং ইউক্রেনসহ মোট ১৫টি দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। আর ১৯৯১ সালের দিকে স্বাধীনতা লাভের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তিধর দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ইউক্রেন। বিশেষ করে দেশটির হাতে অবিশ্বাস্যভাবে প্রায় ১ হাজার ৯০০টি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড মজুত ছিল। যদিও এই নিউক্লিয়ার অস্ত্র প্রযুক্তিগতভাবে ব্যবহারের উপযোগী করে রাখাটা ইউক্রেনের একেবারে সাধ্যের বাহিরে ছিল। তার পাশাপাশি এসব অস্ত্রের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো কোন সক্ষমতা হয়ত ইউক্রেনের ছিল না।

এর পাশাপাশি ইউক্রেনের অস্ত্র ভাণ্ডারে ১৭৬টি ইন্টারকন্টিন্যান্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম), ৪৪টি হেভি স্ট্র্যাটিজিক বোম্বার এয়ারক্রাফট এবং প্রায় তিন হাজারের অধিক শর্ট অ্যান্ড মিডিয়াম রেঞ্জের ব্যালেস্টিক অ্যান্ড ক্রুজ মিসাইলের বিশাল মজুত ছিল। তাছাড়া প্রচলিত অস্ত্র হিসেবে প্রায় ৬,৫০০টি বিভিন্ন সিরিজের মেইন ব্যাটল ট্যাংক এবং হাজার হাজার আর্টিলারি সিস্টেম এবং এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম থেকে যায় ইউক্রেনের মালিকানায়। বিশেষ করে ভারি অস্ত্রের পাশাপাশি প্রায় ৫৭৫টি কেএইচ-৫৫ এয়ার লঞ্চড বেসড ক্রুজ মিসাইল ছিল ইউক্রেনের কাছে।

অথচ গত ১৯৯৯ সালের দিকে রাশিয়ার থেকে আনা গ্যাসের মূল্য বাবদ বকেয়া পরিশোধের বিপরীতে ইউক্রেনের ভান্ডারে থাকা সকল কেএইচ-৫৫ ক্রুজ মিসাইল তুলে দেয় রাশিয়ার হাতে। আর গত ২০২২ সাল থেকেই ইউক্রেনের ফেরত দেয়া সেই মিসাইল দিয়েই ইউক্রেনকে আবার ধ্বংস করে যাচ্ছে রাশিয়া। গত ২০২৩ সালের দিকে ইউক্রেনের পূর্ব অঞ্চলে রাশিয়ার কেএইচ-৫৫ ক্রুজ মিসাইলের ধ্বংসাবশেষের সিরিয়াল নং চিহ্নিত করে এমন বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। তার মানে এসব ক্ষেপণাস্ত্রের আগের মালিক ছিল কিনা ইউক্রেন নিজেই।

আর  ইউক্রেন কিনা উন্নয়নের নামে পর্যায়ক্রমে অধিকাংশ অস্ত্র তুলে দেয় সেই দানব রাশিয়ার হাতেই। আবার নিজেও কিন্তু অতি উৎসাহী হয়ে ধ্বংস করে দেয় দেশের অতি মূল্যবান প্রতিরক্ষা সামগ্রী ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম। তাছাড়া দশকের পর দশক ইউক্রেনের খোলা আকাশের নিচে অত্যন্ত মূল্যবান প্রায় ব্রান্ড নিউ মেইন ব্যাটল ট্যাংক এবং আর্টিলারি সিস্টেম মরিচা পড়ে ও জং ধরে নষ্ট হয়ে যায়। অথচ ভবিষ্যতে আবারও আগ্রাসনের শিকার হতে পারে এমন চিন্তা না করেই এগুলোকে যথাযথভাবে সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা আগে থেকে গ্রহণ করেনি দেশটি।

এদিকে ইউক্রেন তাদের ট্যাংক বহরে মজুত থাকা ৩২০টি টি-৮০ মেইন ব্যাটল ট্যাংক পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করে এবং এর পাশাপাশি একটি অসমাপ্ত নির্মাণাধীন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার চীনের কাছে কাগজে কলমে মাত্র ২৫ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে দেয়। যদিও গুজব রটে যে, এই এয়ারক্রাফট হস্তান্তরে গোপনে আরো প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ লেনদেন করা হয়। তাছাড়া আরো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র এবং এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বিভিন্ন দেশের কাছে গোপনে বিক্রি কিংবা হস্তান্তর করে দেয় তারা।

জাতিসংঘের অনুমতিক্রমে ১৯৯৬ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক সহায়তা এবং নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিনিময়ে রাশিয়ার কাছে সমস্ত পারমাণবিক ওয়ারহেড ফিরিয়ে দেয় ইউক্রেন। তাছাড়া ১৯৯১ সালের কৌশলগত অস্ত্র হ্রাস চুক্তি (START) এর অধীনে ২০০১ সালে ইউক্রেনের শেষ কৌশলগত পারমাণবিক সরবরাহ যানটি ধ্বংস করা হয়। এর বিনিময়ে ইউক্রেন লাভ করে রাশিয়ার কথিত নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের নামে কয়েক বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ। অথচ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে হাতে থাকা অতি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র রাশিয়ার হাতে পর্যায়ক্রমে তুলে দিতে এক বারও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেনি ইউক্রেনের সরকার।

যদিও শেষমেশ ইউক্রেনের টনক নড়ে ২০১৩-১৪ সালের দিকে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল ও সামরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে। এর মধ্যে ইউক্রেনের যা ক্ষতি হওয়ার তা আগেই হয়ে গেছে। বর্তমানে ইউক্রেনে চলছে রাশিয়ার ভয়াবহ সামরিক আগ্রাসন। অন্যদিকে আমেরিকা বসে আছে যুদ্ধ থামলে ইউক্রেনের সব খনিজ সম্পদের মালিকানা হাতিয়ে নিতে। দেশটি অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধের হাত থেকে রেহাই পেলেও বাস্তবে আমেরিকার অর্থনৈতিক আগ্রাসন এবং দেশটির খনিজ সম্পদের দখলের এক অজানা আগ্রাসনের হাত থেকে রেহাই পাবে বলে মনে হয় না।

পরিশেষে বলা যায় যে, একটি দেশ তার সামরিক ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও চরম অনীহা করা কিংবা অবজ্ঞা করাটা যে ভবিষ্যতে কতটা ভয়ংকর হতে পারে তার চাক্ষুষ প্রমাণ হচ্ছে এই ইউক্রেন। সকল দেশের সাথে সখ্যতা বজায় রেখে পূর্ব থেকেই ইউক্রেন তার প্রাপ্ত প্রচলিত সামরিক সক্ষমতা সাধ্যমতো ধরে রাখলে বা বজায় থাকলে আজ রাশিয়া কিন্তু কোন দিনই ইউক্রেনের উপর সামরিক আগ্রাসন চালানোর সাহস পেত বলে মনে হয় না। যা হোক ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে অন্যান্য সকল দেশের শেখার ও জানার অনেক কিছু রয়েছে। ##তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, পার্স-টুডে, ফিনান্সিয়াল টাইমস।

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.