সিরাজুর রহমান#
গত ৩রা ডিসেম্বর মঙ্গলবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সৌদি আরবে এক রাষ্ট্রীয় সফরকালে বলেন যে, তেল সমৃদ্ধ উপসাগরীয় রাজতন্ত্রের এই দেশটির কাছে ৪.৫ প্রজন্মের অত্যাধুনিক রাফাল যুদ্ধবিমান বিক্রির চুক্তিতে ফ্রান্স ও সৌদি আরব অনেকটা কাছাকাছি অবস্থান করছে। মূলত সৌদি আরবে রাষ্ট্রীয় সফরের দ্বিতীয় দিনে তিনি সাংবাদিকদের কাছে সৌদি আরবের রাফাল যুদ্ধবিমান ক্রয়ের প্রবল আগ্রহের বিষয়টি বিশ্ব মিডিয়ার সামনে স্পষ্ট করেন।
সৌদি আরবের বিমান বাহিনীতে বর্তমানে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং উচ্চ প্রযুক্তির ইউরোফাইটার তাইফুন যুদ্ধবিমান রয়েছে মোট ৭১টি। তার পাশাপাশি আমেরিকার তৈরি এফ-১৫সি/এসএ স্টাইক ঈগল ২১০টি, এফ-১৫ডি ঈগল ২১টি এবং যুক্তরাজ্যের তৈরি ৮১টি এবং প্যানাভিয়া টর্নেডো যুদ্ধবিমান অপারেশনাল রয়েছে। সে হিসেবে সৌদি আরবের বিমান বাহিনীতে বর্তমানে মোট ৩৮৩টি হাইলি অ্যাডভান্স ফাস্ট অ্যাটাক এয়ার কমব্যাট ক্যাপাবিলিটি এয়ারক্রাফট অপারেশনাল রয়েছে।
এদিকে গত ২০২৩ সালের ২২শে অক্টোবরে প্রকাশিত ফোবর্স ম্যাগাজিনের দেয়া তথ্যমতে, সৌদি আরব অদূর ভবিষ্যতে হয়ত কমপক্ষে ৫৪টি বা তার অধিক সংখ্যক ফ্রান্সের তৈরি রাফালে (এফ-৪) সিরিজের অ্যাডভান্স যুদ্ধবিমান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও রাফাল যুদ্ধবিমান ক্রয়ের চূড়ান্ত চুক্তি এখনো পর্যন্ত সম্পন্ন করা হয়নি। তাছাড়া চুক্তিমূল্য নির্ধারণ করা না হলেও আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য অনুযায়ী ৫৪টি রাফালে যুদ্ধবিমানের মূল্য (লজিস্টিক সাপোর্ট, ট্রেনিং এন্ড ওয়েপন্স প্যাকেজসহ) আনুমানিক প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার হতে পারে।
বর্তমানে বিশ্বের সেরা, টেকসই এবং অত্যন্ত কার্যকর যুদ্ধবিমান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে ফ্রান্সের ড্যাসাল্ট এভিয়েশন কর্পোরেশনের তৈরি টুইন ইঞ্জিনের রাফাল যুদ্ধবিমান। ফ্রান্সের বিমান বাহিনীর পাশাপাশি মিশর, কাতার, ভারত, গ্রিস, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ক্রোয়েশিয়া এবং সার্বিয়া সহ মোট প্রায় ১০টি দেশের কাছে রাফাল যুদ্ধবিমান সরবরাহ কিংবা রপ্তানির বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পন্ন করেছে ফ্রান্স। বিশেষ করে গত ২০২১ সালে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ১৯ বিলিয়ন ডলার চুক্তিমূল্যে ফ্রান্সের কাছ থেকে ৮০টি রাফাল যুদ্ধবিমান এবং ১২টি মিলিটারি হেলিকপ্টার ক্রয়ের চূড়ান্ত চুক্তি করে।
একজন পাইলট দ্বারা চালিত টুইন ইঞ্জিনের রাফাল যুদ্ধবিমানের ম্যাক্সিমাম গতি প্রতি ঘণ্টায় ১,৯১২ কিলোমিটার বা ম্যাক ১.৮। এর ম্যাক্সিমাম টেক অফ ওয়েট ২৪,৫০০ কেজি এবং সর্বোচ্চ অস্ত্র বহন ক্ষমতা ৯.৫টন। এর কমব্যাট রেঞ্জ ১,৮৫০ কিলোমিটার হলেও এর ফেরি রেঞ্জ ৩,৭০০ কিলোমিটার (তিনটি ড্রপ ট্যাংকসহ)। এর সার্ভিস সিলিং ৫১,৯৫২ ফিট এবং রেট অফ ক্লাইম্ব প্রতি সেকেন্ডে ৩০৪.৮ মিটার। শক্তি উৎপাদনের জন্যে শক্তিশালী ২টি (Snecma M88-4e) আফটার টার্বোফ্যান জেট ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে।
রাফাল মাল্টিরোল যুদ্ধবিমানের ম্যাক্সিমাম পে-লোড ক্যাপাসিটি ৯.৫ টন। তাছাড়া বর্ধিত রেঞ্জের এয়ার কমব্যাট মিশন পরিচালনা করার জন্য এই সিরিজের যুদ্ধবিমানে অতিরিক্ত ৬.৭ টন ওজনের তিনটি ৫২৪ গ্যালন (২ হাজার লিটার) জ্বালানি ট্যাংকও বহন করে। এই জ্বালানি ট্যাংক আবার অন্যান্য এরিয়াল সিস্টেমে রিফুয়েলিং এ ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া এটি কিন্তু নেভাল স্ট্রাইক মিশনে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
এভিয়নিক্স সিস্টেম হিসেবে অত্যাধুনিক থ্যালেস আরবিই২-এএ (এইএসএ) রাডার, থ্যালেস এসপিইসিটিআরএ ইলেক্ট্রনিক্স ওয়ারফার সিস্টেম এবং থ্যালেস এসএজিইএম-ওএফএস Optronique Secteur Frontal infra-red search and track (IRST) সিস্টেম ইনস্টল করা হয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি হিসেবে থ্যালেস ড্যামোক্লেস টার্গেটিং পড, থ্যালেস আরইওস (এয়ারবোর্ন রেকস অবজারভেশন সিস্টেম) রিকর্নিসেন্স পড, থ্যালেস TALIOS মাল্টি-ফাংশন টার্গেটিং পড, ৫টি ড্রপ ট্যাংক এবং বাডি-বাডি রিফুয়েলিং পড ইনস্টল করা হয়েছে।
এই যুদ্ধবিমানের ফিক্সড ওয়েপন্স ডিফেন্স সিস্টেম হিসেবে একটি ৩০ এমএম (১.২ ইঞ্চি) জিআইএটি-৩০/এম৭৯১ (১২৫ রাউন্ড) অটোক্যানন সংযুক্ত করা হয়েছে। তাছাড়া আরো ১৩টি হার্ডপয়েন্টে মিকা ও স্ক্যাল্প ক্রুজ মিসাইলের পাশাপাশি মেটওর এয়ার টু এয়ার (বিভিআর) মিসাইল এবং গ্রাউন্ড অ্যাটাক হ্যাম্মার এয়ার টু গ্রাউন্ড মিসাইল বহন করে। তাছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে জিইউবি-১২/২৪ লেজার-গাইডেড বোম্বস, এএস-৩০এল, মার্ক-৮২ জিইউবি-৪৯ জিপিএস গাইডেড বোম্বস ব্যবহার করে। তাছাড়া মেরিটাইম স্ট্রাইক মিশনের জন্য রাফালে-এম যুদ্ধবিমান এয়ার লঞ্চড বেসড এক্সোসেট এএম-৩৯ ব্লক-২ অ্যান্টি-শিপ মিসাইল বহন করতে পারে।
এদিকে বর্তমানে যুদ্ধবিমানের রাডার ক্রস সেশন (আরসিএস)-কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর তাই (আরসিএস) সক্ষমতার বিচারে, আমেরিকার চতুর্থ প্রজন্মের এফ-১৬ সিরিজের যুদ্ধবিমানের আরসিএস হতে পারে ৩ থেকে ৫ স্কোয়ার মিটার। যেখানে ইউরোফাইটার টাইফুনের আরসিএস ০.৫ স্কোয়ার মিটার এবং রাফাল যুদ্ধবিমানের আরসিএস ০.১ থেকে ১.০ স্কোয়ার মিটার হতে পারে। আবার মার্কিন বোয়িং কর্পোরেশনের ৪.৫ জেনারেশনের এফ/এ-১৮ সুপার হর্নেট যুদ্ধবিমানের আরসিএস হতে পারে ১ স্কোয়ার মিটার। ##তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, ফোবর্স এবং ইউকিপিডিয়া।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.