-- বিজ্ঞাপন ---

২১৪ জন পণবন্দিকে হত্যা করা হয়েছে, দাবি বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির!!

বিশেষ প্রতিনিধি#

২১৪ জন পণবন্দিকে হত্যা করা হয়েছে! শনিবার বিবৃতি দিয়ে এমনটাই দাবি করল বালোচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)। এই সংগঠনের সদস্যেরাই বালোচিস্তানে জাফর এক্সপ্রেস অপহরণের দায় স্বীকার করেছিলেন। পাকিস্তান সেনার তরফে জানানো হয়েছিল, বুধবার রাতে জাফর এক্সপ্রেস অভিযান সমাপ্ত হয়েছে। সকল পণবন্দিকে উদ্ধার করা হয়েছে। নিহত হয়েছেন ৩৩ জন বালোচ বিদ্রোহী। কিন্তু শনিবার বিএলএ-র বিবৃতিতে পাক সেনার সেই দাবি নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। তারা জানিয়েছে, তারা যে ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল পাক সরকারকে, তা শুক্রবার শেষ হয়েছে। পাক সরকার তাদের দাবি মেনে নেয়নি। ফলে ২১৪ জন পণবন্দিকেই হত্যা করা হয়েছে। এই পণবন্দিরা মূলত পাকিস্তান সেনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে দাবি।

এদিকে পাকিস্তানে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলা হয়, পাকিস্তানের বিশেষ বাহিনী সফলভাবে হাইজ্যাক হওয়া ট্রেনটি মুক্ত করেছে। ৩৬ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা এই অভিযানে ৩৫৪ জন যাত্রীকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তবে, ২৬ জন জিম্মি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১৮ জন সামরিক ও ফ্রন্টিয়ার কোরের সদস্য, তিনজন রেলওয়ে কর্মী এবং পাঁচজন বেসামরিক নাগরিক রয়েছেন। এছাড়া, পাঁচজন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যও শহীদ হয়েছেন। উদ্ধার হওয়া ৩৭ জন আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

গোয়েন্দা ব্যর্থতার অভিযোগ অস্বীকার

লেফটেন্যান্ট জেনারেল শরীফ গোয়েন্দা ব্যর্থতার অভিযোগ নাকচ করে বলেন, নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রতিনিয়ত হাজারো হুমকি প্রতিহত করে, কিন্তু সব সফলতা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তিনি জানান, হামলার আগে সংগৃহীত গোয়েন্দা তথ্যই অভিযান সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সিবি অঞ্চলের জন্য সাধারণ সতর্কতা ছিল, তবে এটি নির্দিষ্ট কোনো হামলার ইঙ্গিত দেয়নি। তবে, সেই তথ্যের ভিত্তিতে পরিকল্পিত অভিযান চালিয়ে সফলভাবে সন্ত্রাসীদের পরাজিত করা সম্ভব হয়েছে।

উদ্ধার অভিযান ধাপে ধাপে

জিম্মিদের তিনটি ধাপে মুক্ত করা হয়:

১. প্রথম ধাপ – সন্ত্রাসীরা বেলুচ জাতিগোষ্ঠীর যাত্রীদের জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে বাছাই করে ছেড়ে দেয়, যা আইএসপিআরের মহাপরিচালক “কৌশলী বিভ্রান্তিমূলক চাল” বলে বর্ণনা করেন।

দ্বিতীয় ধাপ – ফ্রন্টিয়ার কোরের স্নাইপাররা সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানোর সুযোগ তৈরি করলে কিছু যাত্রী পালিয়ে যান। তবে, সন্ত্রাসীরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালালে কয়েকজন নিহত হন।

তৃতীয় ধাপ – চূড়ান্ত পর্বে স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ (এসএসজি) একটি অভিযান চালিয়ে বাকি সব সন্ত্রাসীদের নির্মূল করে এবং অবশিষ্ট যাত্রীদের নিরাপদে উদ্ধার করে। এই অভিযানে কোনো জিম্মি নিহত হয়নি।

অভিযানে মোট ৩৩ জন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে, তবে কিছু সন্ত্রাসী পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। নিরাপত্তা বাহিনী বর্তমানে এলাকাটি সন্ত্রাসীমুক্ত করতে অনুসন্ধান ও পরিশোধন অভিযান চালাচ্ছে।

আফগানিস্তান ও ভারতের সম্পৃক্ততার অভিযোগ

লেফটেন্যান্ট জেনারেল শরীফ অভিযোগ করেন যে, সন্ত্রাসীরা আফগানিস্তানে তাদের হ্যান্ডলারদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিল। অভিযানের সময়, ভারতীয় গণমাধ্যম সন্ত্রাসীদের মহিমান্বিত করতে একটি তথ্য যুদ্ধ চালিয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, “বেলুচিস্তানের এই সন্ত্রাসী হামলা ও এর আগের ঘটনাগুলোতে আপনার পূর্ববর্তী প্রতিবেশী রাষ্ট্রই মূল পরিকল্পনাকারী।” তিনি পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেন এবং ২০১৪ সালে গৃহীত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান – NAP)-এর গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, “সমস্ত রাজনৈতিক দল ও অংশীজনরা একত্রিত হয়ে এই কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল। পূর্ববর্তী সরকার এটিকে পর্যালোচনা ও সংশোধন করেছিল, যার ফলে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে নতুন করে প্রতিশ্রুতি এসেছে।”

সংশোধিত জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় ১৪টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, যা সন্ত্রাসের মূল কারণ ও প্রতিরোধ কৌশলকে অন্তর্ভুক্ত করে। তিনি বলেন, “যদি আমরা এই ১৪টি নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ করি, তাহলে সন্ত্রাস সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব।”

সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান ও সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান

আইএসপিআরের প্রধান জানান, ২০২৪ সালে নিরাপত্তা বাহিনী মোট ৫৯,৭৭৫টি গোয়েন্দাভিত্তিক অভিযান চালিয়েছে, যার মধ্যে বড় ও ছোট উভয় ধরনের অভিযান অন্তর্ভুক্ত ছিল।

২০২৫ সালের শুরু থেকেই ১১,৬৫৪টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে। ২০২৪ ও ২০২৫ সালে মোট ১,২৫০ জন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে এবং ৫৬৩ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য শহীদ হয়েছেন।

বেলুচিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া

বেলুচিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী সরফরাজ বুগতি এই ট্রেন হাইজ্যাক ঘটনাকে সরাসরি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, “এটি কোনো অর্থনৈতিক সংকট বা রাজনৈতিক ইস্যু নয়। এটি একটি পরিকল্পিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, যা পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করার পাশাপাশি দেশকে ভাঙার ষড়যন্ত্র।” তিনি দাবি করেন, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র’ (RAW) আফগানিস্তানের মাধ্যমে পাকিস্তানবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তিনি আরও বলেন, নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (TTP) ও বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (BLA) ভিন্ন মতাদর্শ অনুসরণ করলেও, তাদের পেছনের হোতারা – ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা – একত্রিতভাবে প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনা করছে।

আনন্দবাজারের রিপোর্ট এ উল্লেখ করা হয়, পাকিস্তান সরকারকে ‘একগুঁয়ে’ বলেছে বিএলএ। তাদের দাবি ছিল, বালোচিস্তান থেকে তাদের যে সদস্যদের গ্রেফতার করে পাকিস্তান সেনা বন্দি করে রেখেছে, তাঁদের মুক্তি দিতে হবে। পরিবর্তে পণবন্দিদেরও তারা মুক্তি দেবে। কিন্তু পাক সরকার এ বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি বলে অভিযোগ। বিএলএ-র বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘বরাবরের মতো একগুঁয়েমি এবং সেনার আগ্রাসন দেখিয়েছে পাকিস্তান সরকার। আমাদের সঙ্গে সমঝোতার সম্ভাবনা তারা এড়িয়ে গিয়েছে। বাস্তবকে অস্বীকার করেছে। এই একগুঁয়েমির ফলে ২১৪ জন পণবন্দিকে হত্যা করা হল।’’ বিএলএ-র দাবি প্রসঙ্গে এখনও পাক সরকারের বক্তব্য জানা যায়নি।

কেন এ সমস্যা

বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার পর থেকেই বেলুচ জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে আসছে। বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো, যেমন বেলুচ লিবারেশন আর্মি (BLA), বেলুচ রিপাবলিকান আর্মি (BRA) ও অন্যান্য সংগঠন, পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। বেলুচিস্তান প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, বিশেষ করে গ্যাস, খনিজ, ও তেল রয়েছে। তবে, এই সম্পদ থেকে তারা ন্যায্য ভাগ পায় না বলে অভিযোগ রয়েছে। গ্যাস উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় হলেও বেলুচিস্তানের জনগণ গ্যাস সুবিধা পায় না, এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক থেকেও প্রদেশটি পিছিয়ে রয়েছে। সরকার দীর্ঘদিন ধরে কঠোর সামরিক অভিযান চালিয়ে বেলুচ বিদ্রোহীদের দমন করার চেষ্টা করছে। এতে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (CPEC) প্রকল্প বেলুচিস্তানের গদর বন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। বেলুচ জনগণের অভিযোগ,এই প্রকল্প থেকে তারা কোনো সুবিধা পাচ্ছে না, বরং বহিরাগতদের দ্বারা শোষিত হচ্ছে। স্থানীয়দের উচ্ছেদ করা হচ্ছে এবং প্রকল্পের নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। বেলুচিস্তানে একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয়। বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর পাশাপাশি সেখানে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (TTP) ও ইসলামিক স্টেটের (IS) মতো উগ্রপন্থী সংগঠনগুলোরও উপস্থিতি রয়েছে। এ কারণে প্রদেশটিতে নিয়মিত বোমা হামলা, টার্গেট কিলিং ও সামরিক অভিযানের ঘটনা ঘটে।
বেলুচ জনগণের দাবি, তারা জাতিগত বৈষম্যের শিকার এবং পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থায় তাদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নেই। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে গুম, গুপ্তহত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।#সূত্রঃ আনন্দবাজার/ডন

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.