সিরাজুর রহমান#
চীনের কুয়াংসি চুয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের পাহাড়ি গ্রামগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল ছিল। শিশুরা খাড়া উঁচু পাহাড়ে ঝুলানো বাঁশ বা কাঠের তৈরি সিঁড়ি (স্থানীয়ভাবে “আকাশের সিঁড়ি” নামে পরিচিত) ব্যবহার করে স্কুলে যাতায়াত করত। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও একইভাবে বিদ্যালয়ে যেতে হতো। পাহাড়ের ঢালে নির্মিত খাঁড়া এই সিঁড়িগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।
বিশেষ করে শীতকালে বরফ জমলে পা পিছলে যাওয়ার কারণে অনেকেই আহত হতেন। এ রকমই একটি গ্রামীণ পাহাড়ি অঞ্চলে ১৯৮৮ সালে নুং থেং প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। এই বিদ্যালয়ের সকল শিশু এবং সম্মানিত শিক্ষকেরা এই ঝুঁকিপূর্ণ সিঁড়ি ব্যবহার করে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত স্কুলে পৌঁছাতো। একদিকে খাড়া পাহাড়, অন্যদিকে দুর্গম পর্বত, এমন পরিবেশে যাতায়াত ছিল জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
দূর্গম অঞ্চলের এ সকল বিদ্যালয়ে শিশুদের জন্য কোনো রান্নাঘর বা পর্যাপ্ত অবকাঠামো ছিল না। তারা নিজেরা চাল, সয়াবিন, এবং জ্বালানি কাঠ বহন করে নিয়ে যেত এবং আশেপাশের কোনো কৃষকের বাড়িতে রান্নার ব্যবস্থা করা হতো। ছি পাই নুং পাহাড়ি এলাকায় পরিদর্শনে গিয়ে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা একে “মরুভূমির পর মানুষের বসবাসের সবচেয়ে অনুপযুক্ত স্থান” বলে উল্লেখ করেন। তবে চীনের শি জিং পিং সরকার দেশের প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামীণ অঞ্চলের দারিদ্র্য বিমোচন এবং অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য গত ২০০৮ সাল থেকে ব্যাপক আকারের বিনিয়োগ শুরু করেছে। তারা বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকায় আধুনিক শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়নে কাজ শুরু করেছে। দেশটির স্থানীয় প্রশাসনের আওতায় সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলের পাহাড়ে পরিকল্পিতভাবে আধুনিক সড়ক তৈরি করা হয়েছে।
তাছাড়া সুবিধাবঞ্চিত বিদ্যালয়ের আধুনিকায়নের জন্য নতুন নতুন অবকাঠামো এবং ভবন নির্মাণ করে সারা দেশে টেকসই ও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছে চীনের সম্মানিত শি জিং পিং সরকার। উন্নত শিক্ষা উপকরণ দ্বারা সজ্জিত করার পাশাপাশি নুং থেং স্কুলে রান্নাঘর স্থাপন এবং পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নান নিং শহরের সাং লিন স্কুলের শিক্ষক সি লান সুং ৩০ বছর আগে নিজ হাতে নৌকা তৈরি করে শিশুদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করেছিলেন। পরবর্তীতে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে আধুনিক যানবাহন এবং জলমগ্ন স্থানে যান্ত্রিক নৌকার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে চীনের পাহাড়ি অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে সামাজিক মনোভাবেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
মূলত গত ২০২০ সালের পর থেকে চীনের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির ফলে পাহাড়ি অঞ্চলে ৮৯৩টি নতুন স্কুল নির্মিত হয়েছে এবং বর্তমানে ১০ কোটিরও বেশি শিশু বিদ্যালয়ে উন্নত ও পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে। তবে বর্তমানে চীনের কিছু প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় এখনো পর্যন্ত “আকাশের সিঁড়ি” বা বাঁশের মইয়ের ব্যবহার থাকলেও অধিকাংশ পাহাড়ি এলাকায় এখন আর এই ঝুঁকিপূর্ণ বাঁশের সিঁড়ির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
চীনের গ্রামীণ অঞ্চলে আগে মেয়েদের শিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা হতো। কিন্তু বর্তমানে পাহাড়ী অঞ্চলের মেয়েরাও উচ্চশিক্ষা অর্জনে বিশেষ সুযোগ পাচ্ছেন। উচ্চশিক্ষায় নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও গবেষণায় আজ চীনের দরিদ্র অঞ্চলের মেয়েরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিশেষত চীনের সরকারি উদ্যোগ ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সহযোগিতার মাধ্যমে দেশটির প্রত্যন্ত পাহাড়ী অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছে।##
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.