সিরাজুর রহমান#
বর্তমানে এক আমেরিকার পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং শক্তিশালী অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে চীন। তবে চীনের এহেন সুবিশাল অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা কিন্তু রাতারাতি গড়ে উঠেনি। বরং এ পর্যায়ে আসতে চীনের মাও সেতুং কমিউনিস্ট সরকার ও তার দেশে সাধারণ জনগণকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একেবারে ভঙ্গুর অর্থনীতিকে ঢেলে সাজাতে চীনের সরকার শুরু থেকেই অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক দীর্ঘ মেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন করে গেছে।
আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একেবারে ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই রেড জায়ান্ট চীন শিক্ষা ব্যবস্থায় নিয়ে আসে এক আমূল পরিবর্তন। যা কিনা সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থাকে কিছুটা পাশ কাটিকে শিক্ষার প্রতিটি স্তরেই গড়ে তোলা হয় প্রযুক্তি ও শিল্প বান্ধব কিংবা বাস্তব জীবন ভিত্তিক কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা। যা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আজ থেকে প্রায় ৫ দশক আগেই এক নতুন ধারার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জোয়ার ও শিল্প বিপ্লবের সৃষ্টি করে দেশটি। চীন খুব দ্রুত কৃষি নির্ভর অর্থনীতি ব্যবস্থার পাশাপাশি এক অভাবনীয় শ্রমঘন এবং প্রযুক্তি নির্ভর শিল্প বিপ্লব ঘটয়ে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে চীনের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে বিদ্রুপ কিংবা উপহাস করে লেখা ছাপা হতো পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবশালী নিউজ মিডিয়াগুলোতে। আর বর্তমানে কিনা গোটা ইউরোপের অর্থনীতিকে এক করলেও চীনের অর্থনীতির আকারের সমান হওয়ার কোন সুযোগই নেই। এখন অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিচারে কেবল চীনের আগে রয়েছে একমাত্র দেশ আমেরিকা। প্রভাবশালী ফোবর্স ম্যাগাজিনের দেয়া তথ্যমতে, চলতি ২০২৫ সালের হিসেব অনুযায়ী আমেরিকার নমিনাল জিডিপির আকার ৩০.৩৪ ট্রিলিয়ন ডলার এবং চীনের নমিনাল জিডিপির আকার ১৯.৫৩ ট্রিলিয়ন ডলার।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা মুখে চীনের সার্বিক অর্থনীতি কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পরলেও বিগত এক দশক থেকে সারা বিশ্বে একক দেশ হিসেবে শীর্ষ স্থানীয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তুলেছে দেশটি। উইকিপিডিয়া এবং চীনের ফরেন এক্সচেঞ্জের স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি ২০২৫ সালের ৭ই মার্চের হিসেব অনুযায়ী চীনের ফরেক্স এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ ছিল ৩.২২৭ ট্রিলিয়ন ডলার এবং তা গত ২০২৪ সালের ১লা নভেম্বরে ছিল ৩,৩৮০.৪ বিলিয়ন ডলার। যা থেকে কার্যত চীনের সার্বিক অর্থনৈতিক সক্ষমতার একটি শক্তিশালী চিত্র ফুটে উঠে।
আমেরিকার সাথে চলমান অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক দ্বন্দ্বের কারণে চীনের বৈদেশিক বাণিজ্য গত ২০২৩ সালে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা কিন্তু গত ২০২৪ সালের শেষের দিকে এসে অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। দেশটির রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ কাস্টমস কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত ২০২৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত চীনের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের (আমদানি-রপ্তানি) পরিমাণ ছিল ৫.৯৮ ট্রিলিয়ন ডলার। যা কিনা গত ২০২৩ সালে ছিল ৫.৮৭ ট্রিলিয়ন ডলার এবং ২০২২ সালে তা ছিল ৬.০৫ ট্রিলিয়ন ডলার।
এদিকে চীনের জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ কাস্টমসের দেয়া তথ্যমতে, চলতি ২০২৪ সালের ১২ মাসে সারা বিশ্বে মোট পণ্য ও সেবা রপ্তানি করে ২৫.৪৫ ট্রিলিয়ন ইউয়ান বা ৩.৪৭ ট্রিলিয়ন ডলার এবং একই সময়ে সারা বিশ্ব থেকে পণ্য ও সেবা আমদানি করে প্রায় ২.৫১ ট্রিলিয়ন ডলার। তাছাড়া গত ২০২৩ সালে ১২ মাসে দেশটি মোট পণ্য ও সেবা রপ্তানি করে ৩.৩৮ ট্রিলিয়ন ডলার এবং একই সময়ে সারা বিশ্ব থেকে ২.৫৬ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য ও সেবা আমদানি করে। যা কিনা তার আগের ২০২২ সাল অপেক্ষা রপ্তানি ৪.৬% এবং আমদানি ৫.৫% কম ছিল।
আইএমএফ এর প্রেডিকশন অনুযায়ী গত ২০২৪ সালে আমেরিকার নমিনাল জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২.৮% এবং চীনের প্রবৃদ্ধির হার ৪.৮% দেখানো হয়েছে। ফোবর্স ম্যাগাজিন এবং উইকিপিডিয়ার দেয়া তথ্যমতে, চলতি ২০২৫ সালে চীনের নমিনাল জিডিপির বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৪.৫% এবং এক্ষেত্রে আমেরিকার ২.২% হারে হতে পারে। তবে রয়টার্স নিউজের দেয়া তথ্যমতে, চলতি ২০২৫ সালে চীনের ২৫-২৯ বছর বয়সীদের বেকারত্বের হার ৬.৯% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭.৩% হয়েছে এবং একইভাবে ৩০-৫৯ বছর বয়সীদের বেকারত্বের হার ৪.০% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪.৩% এ পৌঁছেছে।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ব্লগের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, চীন গত ২০২৪ সালের বারো মাসে মোট প্রায় ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স আয় করে। যদিও একই সময়ে রেমিট্যান্স আয়ের দিক দিয়ে শীর্ষে ছিল ভারত। গত ২০২৪ সালে ভারতের রেমিট্যান্স আয়ের পরিমাণ ছিল ১২৯.১ বিলিয়ন ডলার। এরপর রয়েছে মেক্সিকো (৬৮.২ বিলিয়ন ডলার), চীন (৪৮ বিলিয়ন ডলার), ফিলিপাইন (৪০.২ বিলিয়ন ডলার) এবং পাকিস্তান (৩৩.২ বিলিয়ন ডলার)। তবে গত ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের হিসেব অনুযায়ী চীনের বৈদেশিক উতস থেকে নেয়া মোট ঋণ ও দেনার স্থিতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২,৫১৬.৯ বিলিয়ন ডলার।
পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো মনে করে যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগ নীতি অতি দরিদ্র এবং স্বল্প আয়ের দেশগুলোর জন্য বড় ধরনের অর্থনৈতিক সমস্যার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে চীন দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের দেশগুলোকে দীর্ঘ মেয়াদে একরকম অদৃশ্য বৈদেশিক ঋণের ফাঁদে আটকে ফেলেছে। বিশেষ করে বিগত এক যুগ থেকে চীন সার বিশ্বে এক বৃহত্তম ঋণ সরবরাহকারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আর্থিক গবেষণা সংস্থা এইড ডাটার (AidData) দেয় তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক চীন ২০০০–২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ১৫০টির বেশি দেশে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে আর্থিক সংকটে থাকা (যেমন: শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, জাম্বিয়া, ইথিওপিয়া) দেশগুলিকে দেওয়া হয়েছে প্রায় ৮০% বৈদেশিক ঋণ ।##
তথ্যসূত্র:- ইউএস গভর্নমেন্ট অ্যাকাউন্টিবিলিটি অফিস, গ্লোবাল টাইমস, আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংক, এইড ডাটা (AidData), চায়না কাস্টমস, রয়টার্স ও ইউকিপিডিয়া।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.