কাজী আবুল মনসুর#
দেখে মনে হবে দুবাই এর মিরাকেল গার্ডেন। বাস্তবে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের ‘ডিসি পার্ক’। ফুলের বিশাল বাগান। এমন বাহারি প্রজাতির ফুল একসাথে কমই দেখা যায়। নানা ফুলের নানা রঙ। ১৩৬ প্রজাতির ফুল দিয়ে সাজানো এই ডিসি পার্ক এ আসলে যে কারও মন জুড়িয়ে যাবে। ডিসি পার্কের কিছু অংশ সাজানো হয়েছে দুবাইয়ের বিখ্যাত মিরাকল গার্ডেনের আদলে। গিটার, নৌকা, এবং অন্যান্য স্থাপনা ফুল দিঢে ঢেকে দর্শনার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে। ডিসি পার্কের ফুলের এ রাজ্যে কি নেই, ডালিয়া,হাসনাহেনা,অপরাজিতা চন্দ্রমল্লিকা, ম্যাগনোলিয়া, শিউলি, চেরি, জারবেরা, উইলো, উইস্টেরিয়া, কনকাম্বরী, হাইব্রিড জবা আরো কত কি।
সম্প্রতি মাস ব্যাপি আয়োজনের উদ্বোধন হয়ে গেল। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ এ উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান ও চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন। ছিলেন চট্টগ্রামের ডিসি ফরিদা খানমসহ বিভিন্ন ব্যাক্তিবর্গ।
তৃতীয়বারের মতো ফুল উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে এবার। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের ফৌজদারহাট এলাকার বন্দর টোল রোডের সামনে বিস্তীর্ণ সরকারি জমির উপর করা হয়েছে এই ডিসি পার্ক। বর্তমানে পার্কটিতে এখন সৌরভ ছড়াচ্ছে ১৩৬ প্রজাতির দুই লাখের অধিক বাহারি ফুল। শনিবার (৪ জানুয়ারি) থেকে শুরু হওয়া মাসব্যাপী এ ফুল উৎসব চলবে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পার্ক দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকবে। টিকিটের মূল্য রাখা হয়েছে জনপ্রতি ৫০ টাকা।
মাসব্যাপি এবারের উৎসবে থাকছে মাল্টি কালচারাল ফেস্টিভ্যাল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গ্রামীণ মেলা ও পিঠাপুলি উৎসব। বিভিন্ন চিত্রশিল্পীদের প্রায় ২০০টি চিত্রকর্ম এখানে স্থান পেয়েছে। উৎসবে আসা দর্শনার্থীদের জন্য বিশেষ আয়োজনে নিজেদের ছবির ক্যারিকেচার আঁকার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। থাকছে উপজাতি নৃত্যসহ জেলা ও উপজেলার শিল্পীদের পরিবেশনায় নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পূর্বে অনেকটা পরিত্যক্ত এ সরকারি জমিটি ছিল বিভিন্ন দখলদারদের দখলে। কেউ কেউ ঘর তুলে ভাড়া দিত, প্রতিদিন বসতো মাদকের আসর। কেউ কেউ রেস্তোরা বানিয়ে দিব্যি ব্যবসা চালাতো, আবার কেউ কেউ পুকুর বা জলাশয় দখল করে মাছ চাষ করতো। প্রায় ১৯৪ একর বিশাল এ জায়গা নিয়ে বিভিন্ন সময় লেখালেখি হলেও প্রশাসন কোন প্রকার পদক্ষেপ নেয় নি। বরং অভিযোগ ছিল, স্থানীয় প্রশাসনকে হাত করেই চলতো নানা ব্যবসা।
বিগত চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বিশাল এ জায়গাটি উদ্ধারে এগিয়ে আসেন। গত ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সরকারি এই জমি দখলমুক্ত করার একমাস পরই তিনি এ জায়গা ঘিরে ফুলের বাগান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। অনেকটা দুবাই এর মিরাকেল গার্ডেনের আদলে তৈরি করা হয় ডিসি পার্ক।
শুধু ফুলের বাগানে এটি সীমাবদ্ধ না। ফুডকোর্ট, পর্যটকদের বসার স্থান, সেলফি কর্নার, অনুষ্ঠানস্থল, ভাসমান ফুল বাগান, হাটা চলার উন্মুক্ত স্থান, অস্থায়ী খেলার মাঠ, স্থায়ী ফুলের বাগান, শিশুদের খেলার মাঠ, ভিআইপি জোন, কন্ট্রোল রুম, রেস্টুরেন্ট, সানসেট ভিউ পয়েন্ট, টিউলিপ গার্ডেনসহ নানা আয়োজন রাখা হয়েছে।
এখানে এমন অনেক ধরনের ফুল আনা হয়েছে যেগুলো সাধারন মানুষ দেখেন নি। নানা দেশি প্রজাতির ফুল থেকে শুরু করে বিদেশী ফুলও এখানে রাখা হয়েছে। নানা ফুলের মধ্যে রয়েছে শিউলি, হাসনাহেনা, অপরাজিতা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, ম্যাগনোলিয়া, কনকাম্বরী, হাইব্রিড জবা, চিলি জবা, হিজল, কৃষ্ণচূড়া, বকুল, পলাশ, শিমুল, করবী, ধানলিলি, নীল পারুল, নীলকণ্ঠ, রেইনলিলি, গন্ধরাজ, কাঠমল্লিকা, বাসন্তী, কামিনী, বেলী, দোলনচাঁপা, মাধবীলতা, চেরি, জারবেরা, উইলো, উইস্টেরিয়া, লিলিয়াম, জিনিয়া, ইনকাসহ নানা দেশি –বিদেশি লাখো ফুল। ফুলের পাশে দর্শকরা যাতে ফুল চিনতে পারে তার জন্য ফুলের পরিচিতি শোভা পাচ্ছে। রাখা হয়েছে টিউলিপও। ফুল দিয়ে মিরাকল গার্ডেন স্টাইলে বানানো হয়েছে বিশালাকৃতির ময়ুরসহ নানা জিনিষ।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক (ডিসি) ফরিদা খানম বলেন, শহরে সাধারণ মানুষের ঘুড়ে বেড়ানোর জায়গার অভাব রয়েছে। ডিসি পার্ক ১৯৪ একর জায়গার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। এতবড় খোলা জায়গা সেখানে নেই। তাই, জেলা প্রশাসন সুস্থ বিনোদনের উদ্দেশ্যে এবং প্রকৃতির সঙ্গে আগামী প্রজন্মকে পরিচিত করাতে এ ফুল উৎসবের আয়োজন করেছে।তিনি বলেন, প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ১৩৬ প্রজাতির দেশি-বিদেশি প্রায় লক্ষাধিক ফুল দিয়ে এ ফুল উৎসবকে সাজানো হয়েছে। সুস্থ পরিবেশে মানুষ যাতে বিনোদনকে উপভোগ করতে পারে সেজন্য আমরা ডিসি পার্ককে নির্বাচিত করেছি। প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে কোলাহল মুক্ত পরিবেশে মানুষ যাতে কিছুটা একান্তে সময় কাটাতে পারে তাই এ ফুল উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নে জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, এবারের ফুল উৎসবে বেশ কিছু নতুনত্ব রয়েছে। ভাসমান ফুল বাগান থেকে শুরু করে ১২টি দোকানে গ্রামীনমেলা বসবে যা আগে ছিল না। গতবছর কালচারাল প্রোগ্রাম ১৫ দিন হলেও এবার সেটা বাড়িয়ে ৩০ দিন করা হয়েছে। বিশেষ আর্কষণ হিসেবে মাসব্যাপি আয়োজিত এ ফুল উৎসবের বিভিন্ন আয়োজনের মধ্যে থাকবে মাসব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মাল্টিকালচারাল ফেস্টিভ্যাল, মাসব্যাপী গ্রামীণ মেলা, বই উৎসব, ঘুড়ি উৎসব, ফুলের সাজে একদিন, পিঠা উৎসব, লেজার লাইট শো, ভিআর গেইম, মুভি শো, ভায়োলিন শো, পুতুল নাচসহ নানা রকমের আয়োজন।
পাশাপাশি শিশুদের জন্য আলাদা কিড্স জোন তৈরি করা হয়েছে এবং কেউ ফুল কিনতে চাইলে তার জন্য দু’টা নার্সারিও স্থাপন করা হবে। তারুণ্যের সমাবেশকে কেন্দ্র করে এ ফুল উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। স্থানীয় গায়কদের পাশাপাশি সারাদেশের শিল্পীরা এখানে অংশগ্রহণ করবে। ডিসি আরও বলেন, চট্টগ্রাম শহর থেকে পযর্টকদের আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে শাটল বাস সার্ভিসের চালু করা হয়েছে। এটি টাইগার পাস থেকে পতেঙ্গা হয়ে ডিসি পার্কে দর্শণার্থীদের নিয়ে আসবে আবার একই রুট হয়ে গাড়ি টাইগার পাস ফিরে যাবে। এছাড়াও এখানে দর্শণার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত টয়লেট ও পানির সুব্যবস্থা করা হয়েছে। চট্টগ্রামবাসীসহ সারাদেশের মানুষকে আহবান জানাচ্ছি এখানে এসে মাসব্যাপী এ ফুল উৎসবকে উপভোগ করার জন্য।##
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.