বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন##
কোকা-কোলার কোম্পানিটি জানিয়েছে, উচ্চ মাত্রার ক্লোরেট নামক রাসায়নিক শনাক্ত করার পর যুক্তরাজ্যে বেশ কয়েকটি কোকা-কোলা পণ্য বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। কোকা-কোলা কোম্পানি সম্প্রতি যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ থেকে তাদের কিছু পণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার করেছে। নিয়মিত পরীক্ষায় এই পণ্যগুলোতে উচ্চ মাত্রার ক্লোরেট নামক রাসায়নিক শনাক্ত হওয়ার পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ক্লোরেট সাধারণত পানি পরিশোধন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত হয়, তবে উচ্চ মাত্রায় এটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, বিশেষ করে শিশুদের থাইরয়েডের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রত্যাহারকৃত পণ্যগুলোর মধ্যে কোকা-কোলা, ফ্যান্টা, স্প্রাইট, মিনিট মেইড এবং ট্রপিকো ব্র্যান্ডের পানীয় রয়েছে। এই পণ্যগুলো ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, লুক্সেমবার্গ এবং নেদারল্যান্ডসে বিতরণ করা হয়েছিল। কোম্পানিটি জানিয়েছে যে, বেশিরভাগ প্রভাবিত পণ্য ইতোমধ্যে বাজার থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং ভোক্তাদের জন্য ঝুঁকি খুবই কম।
যুক্তরাজ্যের খাদ্য মান সংস্থা (Food Standards Agency) বিষয়টি তদন্ত করছে এবং ভোক্তাদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে। যদি কেউ এই পণ্যগুলো ক্রয় করে থাকেন, তাহলে তা ব্যবহার না করে সংশ্লিষ্ট দোকানে ফেরত দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
কোকা-কোলার সমস্যা অনেক পুরনো এবং বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন কারণে বিতর্কের মুখে পড়েছে। তবে এটি এখনও বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় পানীয় ব্র্যান্ড। যুক্তরাজ্যে ২০১৮ সালে সুগার ট্যাক্স (Soft Drinks Industry Levy) চালু হয়, যার ফলে কোকা-কোলা ও অন্যান্য কোমল পানীয় কোম্পানিকে কর দিতে হয়। এর ফলে কোকা-কোলা ব্রিটেনে তাদের কিছু পানীয়ের রেসিপি পরিবর্তন করে, তবে ব্রিটেন থেকে পুরোপুরি সরে যায়নি। ব্রিটেনে কোকা-কোলার বিরুদ্ধে প্লাস্টিক দূষণ ও পুনর্ব্যবহারের অভাব নিয়ে প্রতিবাদ হয়েছে। কোম্পানিটি প্লাস্টিক ব্যবহারের মাত্রা কমানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও সমালোচনা অব্যাহত আছে। ব্রিটেনে কিছু গ্রুপ কোকা-কোলার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, তবে এটি এখনও ব্যবসা করছে।
কোকা-কোলার উৎপত্তি (১৮৮৬) থেকে আজ পর্যন্ত নানা বিতর্ক জিইয়ে রয়েছে। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার জর্জিয়ার আটলান্টায় জন স্টিথ পেম্বারটন কোকা-কোলা আবিষ্কার করেন। শুরুতে এটি একটি ঔষধি পানীয় হিসেবে বাজারজাত করা হয়, যাতে কোকা পাতা ও কোলা বাদামের নির্যাস ছিল। ১৯২০-১৯৩০ সালের মধ্যে কোকা-কোলা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হতে শুরু করে, বিশেষ করে আমেরিকা ও ইউরোপে। ১৯৪০-এর দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্য কোকা-কোলার সরবরাহ বাড়ানো হয়, যা যুদ্ধকালীন বাজার সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখে। ১৯৭০-১৯৮০ সালের দিকে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে প্রথম সমালোচনা শুরু হয়, বিশেষ করে সুগার ও কৃত্রিম উপাদানের প্রভাব নিয়ে। ১৯৯০-এর দশকে কোকা-কোলা বিভিন্ন দেশে শ্রমিক নিপীড়নের অভিযোগে সমালোচনার সম্মুখীন হয়।
১৯৭০-এর দশকে গবেষণায় দেখা যায়, কোকা-কোলার উচ্চ চিনি ও অ্যাসিড দাঁত ও হাড়ের ক্ষতি করে। ১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে স্থূলতা ও ডায়াবেটিসের হার বাড়তে শুরু করলে কোকা-কোলার মতো সুগারযুক্ত পানীয়কে দায়ী করা হয়। ১৯৯০-এর দশকে কলম্বিয়ায় কোকা-কোলা কোম্পানির সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা খুন হন, যা বড় আকারে বিতর্কের সৃষ্টি করে। ২০০০-এর দশকে ভারতে কোকা-কোলা কারখানার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত পানি ব্যবহার ও কৃষিজমি ধ্বংসের অভিযোগ ওঠে।
২০০৩ সালে ভারতে কোকা-কোলার পানীয়তে কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। বিভিন্ন দেশে পরিবেশ দূষণ ও প্লাস্টিক বর্জ্যের জন্য কোকা-কোলার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘর্ষ নিয়ে মুসলিম বিশ্বে কোকা-কোলার বিরুদ্ধে বয়কট আন্দোলন চলে।
কোকা-কোলার বাজার উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোতে এখনো শক্তিশালী রয়েছে। ইউরোপের কিছু দেশে কিছু নির্দিষ্ট ব্যাচের পণ্য প্রত্যাহার করা হলেও, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ ধরনের কোনো ব্যাপক প্রত্যাহারের খবর নেই।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কোকা-কোলার জনপ্রিয়তার কয়েকটি কারনের মধ্যে রয়েছে, এটি সাশ্রয়ী মূল্য ও সহজলভ্যতা – শহর থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত সহজেই পাওয়া যায়। ব্র্যান্ডিং ও বিপণন এ আগ্রাসী বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা চালিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা।বিকল্পের অভাবের কারনে অনেক দেশে স্থানীয় কোমল পানীয় কোম্পানিগুলো এতটা প্রতিযোগিতা করতে পারে না। তাছাড়া চিনি ও ক্যাফেইনের আসক্তি – চিনি ও ক্যাফেইনের কারণে অনেকেই কোকা-কোলা পান করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন।
উন্নত দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল দেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে দুর্বল হওয়ার কারণে, অনেক ক্ষেত্রেই পণ্য প্রত্যাহার বা মান নিয়ন্ত্রণের খবর সামনে আসে না বা সেগুলোর উপর ততটা কড়া নজরদারি হয় না।##
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.