বিশেষ প্রতিনিধি, আমেরিকা থেকে#
লস অ্যাঞ্জেলেসের নাম শোনা মাত্রই চোখের সামনে ভেসে ওঠে হলিউড তারকা এবং নামীদামী ব্যক্তিত্বদের বিলাসবহুল আবাস। তবে বর্তমানে এই শহর ভয়াবহ এক দাবানলের কবলে পড়েছে। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া প্রদেশের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে মঙ্গলবার শুরু হওয়া এই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে লস অ্যাঞ্জেলেসের বসত এলাকায়। দাবানলের কারণ হিসেবে শুষ্ক আবহাওয়া এবং শক্তিশালী বাতাসকে দায়ী করা হচ্ছে। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় স্থানীয় প্রশাসন বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার কাজ করছে। এলাকা জুড়ে ফায়ার ব্রিগেড কর্মীরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, তবে আগুনের ব্যাপকতা এতটাই বেশি যে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে। এরই মধ্যে দাবানলের প্রভাব ক্যালির্ফোনিয়াতে পড়তে শুরু করেছে। জারি করা হয়েছে জরুরী অবস্থা।
দাবানলের এই তাণ্ডব ইতোমধ্যেই সাথারণ মানুষের পাশাপাশি বহু নামিদামি তারকাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছে। অর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি পরিবেশেও মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যালিফোর্নিয়ার শুষ্ক আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তন এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় বাসিন্দারা চরম আতঙ্কে রয়েছেন। লস অ্যাঞ্জেলেসে এমন ঘটনা বারবার ঘটছে, যা প্রশাসনকে আরও সতর্ক হওয়ার বার্তা দিচ্ছে।
লস অ্যাঞ্জেলেস এবং আশপাশের পাহাড়ি অঞ্চলে দাবানলের এই আগুনের সূত্রপাত হয় মঙ্গলবার বিকেলে। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার এই এলাকায় শুষ্ক আবহাওয়া এবং তীব্র বাতাস ছিল, যা দাবানলের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছিল। আগুনের প্রাথমিক কারণ সম্পর্কে জানা গেছে যে, এটি প্রথমে পাহাড়ি অঞ্চলের শুকনো ঝোপ-জঙ্গলে লাগে। অনেক সময় বজ্রপাত, বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে পড়া, বা কোনো দুর্ঘটনাজনিত কারণ থেকে এ ধরনের আগুন শুরু হয়। তবে ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানলের ঘটনা প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াও মানুষের অসতর্কতার জন্য ঘটতে পারে, যেমন— বনভূমিতে ফেলে রাখা জ্বলন্ত সিগারেট বা ক্যাম্পফায়ারের নিয়ন্ত্রণহীন আগুন।
একবার আগুন শুরু হলে, তীব্র বাতাস তা দ্রুত ছড়িয়ে দেয়। লস অ্যাঞ্জেলেসের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে এই আগুন নিচের বসত এলাকাগুলোতে নেমে আসে, যার ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। স্থানীয় প্রশাসন এখনো আগুনের প্রকৃত কারণ নির্ধারণের জন্য তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। লস অ্যাঞ্জেলেসের এই দাবানল শুধু সাধারণ মানুষের নয়, অনেক হলিউড তারকার আবাসনকেও হুমকির মুখে ফেলেছে। এই অঞ্চলে বিলাসবহুল বাড়ি এবং ভিলা রয়েছে এমন তারকাদের মধ্যে রয়েছেন লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও, জেনিফার অ্যানিস্টন, কিম কার্দাশিয়ান, এবং উইল স্মিথের মতো বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্বরা।
অনেক তারকা এবং তাদের পরিবার ইতোমধ্যেই তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য জরুরি ভিত্তিতে এলাকা ছাড়ছেন। যেহেতু তাদের অনেকের বাড়ি দাবানল-আক্রান্ত এলাকার কাছে, তাই তারা নিজেদের সম্পত্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। অনেকেই এর আগে দাবানলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বাড়ির বীমা বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগে থেকেই নিশ্চিত করেছেন। হলিউড তারকারা সাধারণত এই ধরনের দুর্যোগে সমাজের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তারা মানুষকে সচেতন করছেন এবং প্রশাসনের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছেন।
এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় তারকারা বিশেষ পরিকল্পনা করে থাকেন, যেমন— হেলিকপ্টার বা প্রাইভেট ট্রান্সপোর্টের মাধ্যমে দ্রুত এলাকা ছাড়ার ব্যবস্থা। তাদের চিন্তা শুধু ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নয়; তারা প্রকৃতি, পরিবেশ এবং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়েও উদ্বিগ্ন। এই দাবানল আবারো মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কারও প্রতি বৈষম্য করে না।
লস অ্যাঞ্জেলেসে চলমান দাবানল এখনও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। দমকল বাহিনী নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তবে তীব্র বাতাস এবং শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হচ্ছে। এই দাবানলে ইতোমধ্যে প্রায় ২৭,০০০ একর এলাকা পুড়ে গেছে, এবং হাজারো বাড়ি ও গাড়ি ধ্বংস হয়েছে। এ পর্যন্ত অন্তত পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, এবং প্রায় ১,৩৭,০০০ মানুষকে তাদের বাড়ি থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউজম পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সর্বোচ্চ সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দাবানলের কারণে লস অ্যাঞ্জেলেসের পাঁচটি কাউন্টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী দিনগুলোতে তাপমাত্রা ২০-২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকবে, এবং বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এমন পরিস্থিতিতে দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনতে আরও সময় লাগতে পারে।
লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানল ইতোমধ্যে আশপাশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকাকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে। আগুনের দ্রুত বিস্তার এবং বাতাসের কারণে নতুন এলাকাগুলোও ঝুঁকির মুখে রয়েছে।বেভারলি হিলস এবং হলিউডের পাহাড়ি এলাকা। এই অঞ্চলে বহু নামী হলিউড তারকার বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। বাতাসের কারণে আগুন দ্রুত এদিকে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রশাসন ইতোমধ্যেই বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে এবং সম্পত্তি সুরক্ষার জন্য অতিরিক্ত অগ্নিনির্বাপক দল মোতায়েন করা হয়েছে। গ্রিফিথ পার্ক এবং গ্রিফিথ অবজারভেটরি। লস অ্যাঞ্জেলেসের একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র এবং গবেষণার স্থান, যেটি ঘন সবুজ অঞ্চলে অবস্থিত। এটি আগুনের সান্নিধ্যে রয়েছে এবং প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ।এছাড়া মালিবু ক্যালিফোর্নিয়ার সবচেয়ে বিলাসবহুল উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই এলাকাটি আগুনের সম্ভাব্য পথের মধ্যে পড়ে এবং অতীতে এখানেও দাবানলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্যাসাডেনা এবং সান্তা মনিকা পাহাড়ি এলাকা। এই এলাকাগুলো শুষ্ক ঝোপ-জঙ্গলে পূর্ণ এবং দ্রুত দাবানলের শিকার হতে পারে। ইতোমধ্যেই দমকল বাহিনী এসব এলাকায় সক্রিয় রয়েছে। সান্তা ক্লারিটা এবং সিমি ভ্যালি একটি গুরুত্বপূর্ণ আবাসিক এবং বাণিজ্যিক অঞ্চল, যেখানে আগুন ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
লস অ্যাঞ্জেলেস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যদিও সরাসরি আগুনের ঝুঁকিতে নেই, তবে ঘন ধোঁয়া বিমান চলাচলে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। আগুনের প্রভাবে অঞ্চলটির পরিবহন ব্যবস্থাও বিঘ্নিত হতে পারে।
ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ফায়ার ব্রিগেড এবং হেলিকপ্টারের সাহায্যে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। এলাকাগুলোতে “রেড ফ্ল্যাগ ওয়ার্নিং” জারি করা হয়েছে, যা জনগণকে অতিরিক্ত সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়। দাবানলের বিস্তার এবং এর গতিপথ এখনো নির্ধারণ করা কঠিন, তবে পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হলে আরো গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হুমকির মুখে পড়তে পারে।##
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.