সিরাজুর রহমান#
পৃথিবীর বুকে বিচরণ করা অতি প্রাচীন এবং প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর নাম আসলে আমরা সাধারণত বিশাল আকারের এবং অতি ভয়ংকর ডাইনোসর প্রজাতির প্রাণীকে মনে করে থাকি। তবে বিজ্ঞানীদের নিবিড় গবেষণা এবং দীর্ঘ মেয়াদি স্টাডির মাধ্যমে জানা যায় যে, ডাইনোসর প্রজাতির প্রাণীর উৎপত্তি ও ধারাবাহিক বিকাশ আজ থেকে আনুমানিক ২৩ কোটি থেকে ২৫ কোটি বছর আগে শুরু হয়েছিল। এই জাতীয় প্রাণীরা প্রায় ১৬ কোটি বছর পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে একটানা রাজত্ব করে গেছে।
বিবিসি-র দেয়া তথ্যমতে, বিজ্ঞানীদের অতি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায় যে, উল্কাপাত কিংবা গ্রহাণুর আঘাতে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে যে থিওরি প্রচলিত রয়েছে, তার কমপক্ষে প্রায় ৫০ মিলিয়ন বছর আগে থেকেই ডাইনোসরের বিলুপ্তির চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাঁদের গবেষণা মতে, আজ থেকে ৬.৬ কোটি বছর আগে এক বিশাল গ্রহাণুর আঘাতে খুব সম্ভবত পৃথিবী থেকে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ডাইনোসরসহ টিকে থাকা প্রায় ৭৫% থেকে ৮০% পর্যন্ত প্রাণী ও উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে যায়।
গ্রহাণুর আঘাতে ফলে সৃষ্ট অতি ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগে অধিকাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে গেলেও পরবর্তীতে টিকে থাকা মাত্র ১০% থেকে নতুন করে বিকশিত হয় বিভিন্ন ধরনের হাজারো প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ। যার মধ্যে স্তন্যপায়ী প্রাণীও কিন্তু অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে বর্তমানে এমন একটি প্রাণী পৃথিবীর বুকে টিকে রয়েছে যারা কিনা ডাইনোসরের বহু আগে থেকেই পৃথিবীর সাগর ও মহাসাগরের গভীরে নিজেদের অভিযোজনের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
মূলত জেলিফিশ (Jellyfish) সমুদ্রের এমন একটি বিশেষ ধরনের অমেরুদণ্ডী প্রাণী, যাকে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন যুগের প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করেন। যার পূর্ব পুরুষ স্টিনোফোর (Ctenophora) প্রজাতি (কম্ব জেলি) আজ থেকে আনুমানিক ৬৫ কোটি থেকে ৭০ কোটি বছর আগে সাগর ও মহাসাগরের বুকে বিচরণ করত। তাছাড়া জেলিফিশ (Jellyfish) হচ্ছে সাগরের বুকে টিকে থাকা এক বিশেষ ধরনের প্রাণী, যা দেখতে বেশ নমনীয়, আচ্ছন্ন এবং অদ্ভুত প্রকৃতির হয়ে থাকে। এই জাতীয় প্রাণী আসলে তাদের মলাস্কা বা কোষবিশিষ্ট শরীরের জন্য অধিক পরিচিত পেয়েছে।
অন্যদিকে বিজ্ঞানীরা কিন্তু তেলাপোকা জাতীয় প্রাণীকে কার্বোনিফারস সময়কালের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচনা করেন। এই জাতীয় প্রাণীর পূর্ব পুরুষের উৎপত্তি হয় আনুমানিক প্রায় ৩২০ মিলিয়ন বা ৩২ কোটি বছর পূর্বে। এটি বিজ্ঞানীদের একটি আনুমানিক ও গবেষণামূলক ধারণা, বিধায় বাস্তবে এই সময়কাল অনেকটাই কম বা বেশি হতে পারে। সে হিসেবে ডাইনোসরের উৎপত্তির অনেক আগে থেকেই পৃথিবীর বুকে নিজের জায়গা করে নেয় আমাদের অতি পরিচিত তেলাপোকার প্রাচীন পূর্ব পুরুষেরা।
আমেরিকার দ্য ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো নিউজের দেয়া তথ্যমতে, আজ থেকে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী সৃষ্টি হলেও ৪.৩ বিলিয়ন বছর আগে থেকে পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর বুকে জটিল প্রাণের উৎপত্তি ও বিকাশের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি হতে শুরু করে। তাছাড়া আনুমানিক ৪০০ কোটি বছর আগে থেকে জলীয় কণা সমৃদ্ধ কোটি কোটি গ্রহাণু ও উল্কাপিণ্ড পতনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সুবিশাল জলরাশি গড়ে উঠে পৃথিবীর বুকে।
আর সেখান থেকেই হয়ত জটিল প্রাণের উৎপত্তি ও বিকাশ শুরু হয় হয়ত আনুমানিক ৩৫০ কোটি থেকে ৩৭০ কোটি বছর বা তারও আগে থেকে। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ব্যাপী গবেষণা করে দেখেছে যে, আমাদের এই বাসযোগ্য পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম দিকে প্রাণের জটিল বিকাশ ও উৎপত্তি কিন্তু পৃথিবীর মহাসাগরকে কেন্দ্র করেই বিকোশিত হয়েছে। আর এ নিয়ে কিন্তু অধিকাংশ বিজ্ঞানী একমত পোষণ করেন।
যদিও প্রাথমিকভাবে পৃথিবীর সাগর বা মহাসাগরের বুকে প্রাণের বিকাশ হয়েছিল হয়ত একেবারে অতি ক্ষুদ্র এককোষী ব্যাকটেরিয়া বা তারও ছোট আকারের অন্যকিছু থেকে। তবে বিজ্ঞানীরা অবশ্য এখনো পর্যন্ত ৩৫০ কোটি থেকে ৩৭০ কোটি বছর আগের জটিল প্রাণের সবচেয়ে পুরোনো ফসিল বা জীবাশ্মের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। অথচ যেখানে কিনা পৃথিবীর বুকে অতি উন্নত ডাইনোসর জাতীয় প্রাণীর উৎপত্তি শুরু হয় মাত্র প্রায় ২৩ কোটি থেকে ২৫ কোটি বছর আগে।
যেহেতু পৃথিবীর প্রাথমিক সৃষ্টির পর্যায়ে একেবারেই অজানা পৃষ্ঠের অবস্থার মধ্যে দিয়েই জীবনের উদ্ভব হয়েছিল। তাই এ নিয়ে প্রশ্নের এক অনুমান ব্যতীত বিজ্ঞানীদের পক্ষে সঠিক উত্তর দেওয়া এখনো পর্যন্ত একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। তবে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে বেশ কিছু মৌলিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম মিলার-উরে পরীক্ষাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যে পরীক্ষা দেখিয়েছে যে, প্রায় ৪ বিলিয়ন বছর আগে কীভাবে জীবনের বিল্ডিং ব্লকগুলি একটি আদিম প্রাণের গঠন করতে পারে।
পৃথিবীর বুকে জটিল প্রাণের উৎপত্তি ও ধারাবাহিক বিকাশ আধুনিক বিজ্ঞানের এক অন্যতম রহস্য হিসেবে থেকে গেছে। এই রহস্য উদ্ঘাটনে বিজ্ঞানীরা শতাব্দী ব্যাপী ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া জটিল প্রাণের স্পন্দন কি শুধু এই পৃথিবীতে রয়েছে নাকি সুবিশাল আকাশগঙ্গা কিংবা অন্য কোনো ছায়াপথে লুকিয়ে রয়েছে তা আজও এক অজানা এবং রোমাঞ্চকর রহস্য হিসেবে থেকে গেছে। যার সঠিক উত্তর পেতে আমাদের হয়ত আরো অর্ধ শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।
প্রায় ১ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরত্বের সমান ব্যাসের আকাশগঙ্গা ছায়াপথে আমরা একা আছি কিনা তার উত্তর খুঁজে বের করার জন্য আমাদের পৃথিবীর ভূ-রাসায়নিক অবস্থার প্রথম প্রাণের সৃষ্টির প্রক্রিয়া ও গঠনগুলি কেমন ছিল তা নিয়ে সবার আগে স্টাডি করতে হবে। জীবন সৃষ্টিতে পানি, রসায়ন এবং তাপমাত্রার চক্র রাসায়নিক বিক্রিয়াকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা বিশদভাবে জানার চেষ্টা করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, উইকিপিডিয়া, নাসা, নিউ সায়েন্টিস্ট, দ্য ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো নিউজ।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.