-- বিজ্ঞাপন ---

অসহায় ফিলিস্তিন,আর কত লাশ হলে বিশ্ব বিবেক জাগবে?”

কাজী আবুল মনসুর#

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের কারণে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসের বেশি সময় ধরে চলমান হামলায় এ পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার শিশু ও ৮ হাজার নারী রয়েছেন। আহত হয়েছেন ৭৫ হাজারেরও বেশি মানুষ, এবং বাস্তুহীন হয়েছেন প্রায় ১৮ লাখ মানুষ।

মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই ঘনবসতিপূর্ণ উপত্যকায় এখন বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য, বিদ্যুৎ ও ওষুধ—সবকিছুই সংকটাপন্ন। অধিকাংশ হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত বা সম্পূর্ণ বন্ধ। গর্ভবতী নারী, শিশু ও আহতদের চিকিৎসা দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ইসরায়েলি বাহিনী প্রায় প্রতিদিনই আকাশপথ ও স্থলপথে গাজায় বোমা বর্ষণ করছে। স্কুল, হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র এমনকি জাতিসংঘের পরিচালিত স্থাপনাও এ হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ একাধিক সংস্থা ইসরায়েলের এই আক্রমণকে ‘সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ’ বলে চিহ্নিত করেছে।

গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আহতদের একটি বড় অংশ শিশুসন্তান এবং ৭০ শতাংশ চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না। এছাড়া ইসরায়েল কর্তৃক গাজার ওপর চাপানো অবরোধের কারণে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তাও সেখানে পৌঁছাতে পারছে না।

জাতিসংঘের মহাসচিব একাধিকবার তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু ইসরায়েল তা মানছে না। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু পশ্চিমা দেশ এই অভিযানকে ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ বলে সমর্থন দিয়ে আসছে। বিশ্বের বহু দেশে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হলেও এখনো কার্যকর আন্তর্জাতিক চাপ দেখা যাচ্ছে না।

বিশ্বের অন্যতম বড় এই মানবিক সংকটের সামনে দাঁড়িয়ে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—“আর কত লাশ হলে বিবেক জাগবে?

৬,২২০ বর্গকিলোমিটারের ছোট্ট একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। বছরের পর বছর ধরে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে তারা রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়। পাশেই রয়েছে ২২ হাজার বর্গকিলোমিটারের আরেক ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল। ভুখন্ড দখল বেদখল জনিত সমস্যা নতুন কিছু নয়। ইসরাইল কোনভাবেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে মেনে নিতে পারছে না। বছরের পর বছর ধরে চলছে ইসরাইলের থাবা। ফিলিস্তিনদের গাজাঁ পরিপূর্ণভাবে ইসরাইলের নিয়ন্ত্রনে নেবার জন্য গত ৫০ বছরে ডজন খানেক বড় ধরনের লড়াই হয়েছে। ইসরাইলের শক্তি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো। আরব রাষ্ট্রগুলো পাশে ছিল ফিলিস্তিনিদের। কিন্ত ২০১৪ সালের পর থেকে পাল্টাতে থাকে অনেক কিছু। ‘হামাস’ কে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে ইসরাইল-আমেরিকাসহ আরব রাষ্ট্রগুলোও! ফলে হামাসকে ধংস করতে হবে যে কোন মূল্যে। তাই  বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সমর্থন নিয়ে গাজাঁ ধংসের কাজে নেমে পড়ে ইসরাইল। প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল ‘অপারেশন প্রটেক্টিভ এজ’। এবার হয়ত চুড়ান্ত বিজয় হবে ইসরাইলের। আসলে কি হামাস ধংসই তাদের লক্ষ্য। নাকি গাজাঁ দখল? এ প্রশ্ন এখন ঘুরে ফিরে আসছে। নির্বিচারে বোমা হামলা করে গাজাঁকে ফিলিস্তিনবাসী শূন্য করার মিশন শুরু হয়ে গেছে। হামাস ধংসের নামে গাজাঁর নিয়ন্ত্রন নেয়াই ইসরাইলের এখন প্রধান লক্ষ্য।

ইহুদী-মুসলিম দ্বন্দ্ব বহু বছরের পুরানো। কি করে এক জায়গায় দু’জাতি এলো তা নিয়ে রহস্যের বেড়াজাল তো রয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, ইসরাইল উড়ে এসে জুড়ে বসে গেল। তাদের পেছনের শক্তিরাই আরব বিশ্বে এমন একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ঢুকিয়ে দিলো।

১৯৪৭ এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একদিন আরব বিশ্বের এ অঞ্চলের মানুষগুলো শুনতে পেলো, যুগ যুগ ধরে বাস করা ফিলিস্তিন জাতি উচ্ছেদ হবে। কারন জাতিসংঘের ব্যবস্থা মতে, ভাগাভাগি হয়ে গেছে মাটি। তেলাআবিব থেকে হাইফা নেবে ইহুদিরা। এখানে ছিল বৃটিশদের আর ফিলিস্তিনিদের রাজত্ব। অপরদিকে ওয়েষ্টব্যাংক, গাজাঁ, গালিলি হবে ফিলিস্তিনিদের। মাঝখানে জেরুজালেম থাকবে আর্ন্তজাতিক শাসকদের হাতে। ১৯৪৮ সালের ১৪মে বৃটিশরা পাততাড়ি গুটায়। ঘোষিত হয় নতুন দেশ ‘ইসরাইল’। আর ইসরাইলের জম্মের সাথে সাথে জ্বলে উঠে লড়াই। হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ে অস্ত্র। শুরু হয়ে মাতৃভুমি রক্ষার সংগ্রাম। কিন্ত যুদ্ধে আর জেতা হয় না।

ইসরাইল দখল করতে শুরু করে একের পর এক ভুখন্ড। আরব বিশ্বও থেমে থাকে না। জর্ডান, মিশর, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, সৌদিআরব, ফিলিস্তিন সবাই এক সাথে ভুমি দখলের প্রতিযোগিতায় নামে। যারা ফিলিস্তিনিদের লোক বলে পরিচিত সেই জর্ডান নিয়ে গেল ওয়েষ্ট ব্যাংক, মিশর নিয়ে নিল গাজাঁ।’ এভাবে চলছিল ইতিহাস। ৪৮ এ আরব-ইসরাইল লড়াই এর পর বিভিন্ন দেশের কোণে কোণে গড়ে উঠছিল ফিলিস্তিনিদের বসতি। নীরবে গড়ে উঠে বিভিন্ন শিবির। সে সব শিবির থেকেই আক্রমন শানিত হতে থাকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে।

১৯৬৪ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসের এর নেতৃত্বে তৈরি হয় আরব লীগ। আর এই আরব লীগের ছাতার তলায় জন্ম নেয় ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)’। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল হানা দেয় মিশরের উপর। কিন্ত জর্ডান-মিশর মিলেও ইসরাইলকে পরাজিত করতে পারেনি। মূলত জর্ডান-মিশরের পরাজয়ের পর ফিলিস্তিনিরা নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে শুরু করে।

১৯৬৯ সালে পিএলও নিজেদের অল্পসংখ্যক গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে আরব লীগের ছাতা থেকে বেরিয়ে আসে। ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে সংগঠিত হতে থাকে পিএলও। ইয়াসির আরাফাতের উত্তানকে স্বাভাবিকভাবে নেয় নি অনেক আরব দেশ। ১৯৭০ সালে ফিলিস্তিনি গেরিলাদের অতর্কিত আক্রমন চালায় জর্ডান। ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর ক্রেকডাউন’ নামে জর্ডানের আক্রমনে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি প্রাণ হারায়। জর্ডানের এ কাজে খুশি হয় ইসরাইল। ফিলিস্তিনিরা এতদিন মনে করেছিল, ইসরাইল বুঝি তাদের একমাত্র শক্র। কিন্ত জর্ডানও তাদের ছাড় দেবার পাত্র নয়। জর্ডানের পর ইসরাইল আর বসে থাকে না।

১৯৮২ সালে লেবানন আক্রমন বুঝিয়ে দিল তারা ওত পেতে আছে সব সময়। ইসরাইলের পেছনে আমেরিকানদের সমর্থন প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসে। এ সময় আরাফাতকে ধরার জন্য ইসরাইল যখন মরিয়া, তখন আলজেরিয়ায় বসে ১৯৮৮ সালে ‘ফিলিস্তিন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং জেরুজালেম তার রাজধানী’ বলে ঘোষণা দেয় পিএলও। ১৯৮৯ সালে আরাফাতকেই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা দেয়া হয়। সেই থেকে ফিলিস্তিনিদের যাত্রা শুরু। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনিদের পাশে এসে দাড়ালো।

১৯৯৩ সালে আমেরিকা, ইসরাইল ও নরওয়ের সাথে পিএলও’র বৈঠকে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো ফিলিস্তিনিদের বড় একটি অংশ। ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে আরাফাতের ‘অসলো চুক্তি’ মেনে নেয়া তার জন্য কাল হয়ে দাড়ালো। ইসরাইলের কাছে এ রকম আত্মসমর্পন মেনে নিতে পারেনি গেরিলাদের বড় অংশ। ১৯৯৪ সালে জন্ম নিল ‘হরকাত আল মুকাওয়াম্মাহ আল ইসলামিয়া (হামাস)’। তারা শপথ নিল, ইসরাইলকে জঙ্গি পথেই ক্রমে ক্রমে মারা হবে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি আত্মঘাতি হওয়ার জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাসের কাছে নাম লেখাতে থাকলো।  আর ইসরাইলে ছড়িয়ে পড়তে থাকলো মানব বোমার ভীতি। হামাসের জন্মের পরও দীর্ঘদিন আরাফাতের কারনে বড় ধরনের যুদ্ধ ইসরাইল করেনি। আরাফাতের মৃত্যুও পর ‘হামাস’এর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। ভীতি বাড়ে ইসরাইলেও। ২০০৮, ২০০৯, ২০১২ সালে ইসরাইল গাজাঁ হামলা চালায়। ২০১৪ সালে এসে বড় ধরনের হামলা শুরু করে। সর্বশেষ ২০২৩ সালে হামাস দিল মরণ কামড়। বলা হচ্ছে, অনেক বছর ধরে গোপনে তারা ইসরাইলে বড় ধরনের হামলার প্রস্ততি নিচ্ছিল। কিন্ত ২৪ এসে হামাসসহ পুরো ফিলিস্তিনকে শেষ করতে মাঠে নামে ইসরাইল।

প্রায় ৮০ বছর ধরে ফিলিস্তনীদের মূখ্য প্রশ্ন ইসরাইল কেন গাজাঁর বিপুল ভুখন্ড দখল করে আছে। ওয়েস্ট ব্যাংক, গাজাঁ, পূর্ব জেরুজালেম, গোলান হাইটসে ইসরাইলের নুন্যতম অধিকার নেই। গাজাঁ দীর্ঘসময় ধরে ইসরাইলী সেনাবাহিনী দ্বারা অধিকৃত ছিল। স্বাধীন ফিলিস্তিন হবার পর তাদেও ভুখন্ড ছেড়ে দিতে হবে। কিন্ত ইসরাইল যে কোন মূল্যে গাজাঁ দখলে রাখতে মরিয়া। তারা চাইছে গাজাঁ ফিলিস্তিন শূন্য করে পুরোটা দখল করা। তাই গাজাঁয় ইসরাইলের মৃত্যুর হোলিখেলা চলছে। গাজাঁয় শুধু হামলা নয় নেই বিদ্যুত, জল শোধন কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইসরাইল। হাসপাতালে লোডশেডিং শুরু হয়ে গেছে। চরম বিপর্যয়ে অসহায় মানুষ পরিত্রানের উপায় খুজে পাচ্ছে না। ইসরাইল চরমভাবে হামলা চালাচ্ছে। ইসরাইল যে গাজায় যুদ্ধাপরাধ করে চলেছে তা বিশ্বের পরাশক্তিরা দেখেও দেখছে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শিবির ইসরাইলকে আড়াল করতে তৎপর। অনেকে মুখে ইসরাইলের নিন্দা করলেও প্রকৃতপক্ষে ইহুদীদের সম্প্রসারন নীতির সমর্থক তারা। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাথে বেশ কয়েক বছর ধরে ইসরাইলের দহরম-মহরম ছিল নজরে পড়ার মতো। এবার মনে হয়, ফিলিস্তিনি মানুষের রক্তের সাগরের উপর দিয়ে গাজা দখল করে নেবে ইসরাইল।##

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.