উচ্চশিক্ষা ও উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষায় প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী পাড়ি জমাতে চান ইউরোপের অন্যতম উন্নত দেশ জার্মানিতে। বিনা টিউশন ফি, তুলনামূলক কম সেমিস্টার খরচ, খণ্ডকালীন চাকরির সুযোগ, এবং মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা—সব মিলিয়ে দেশটি হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ। কিন্তু সেই স্বপ্নের পথে এখন প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দীর্ঘ অপেক্ষার সময় বা ‘ওয়েটিং পিরিয়ড’।
ঢাকায় অবস্থিত জার্মান দূতাবাসের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষার্থী জার্মানির স্টুডেন্ট ভিসার অপেক্ষমাণ তালিকায় রয়েছেন। কিছু শিক্ষার্থী এমনকি আড়াই বছর অপেক্ষার পরও পাননি অ্যাপয়েন্টমেন্ট সিরিয়াল। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, নতুন কেউ আবেদন করলে ৪০ বছর পর্যন্ত অপেক্ষার শঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা অনেকের কাছে একপ্রকার অবিশ্বাস্যই বটে।
এদিকে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ব্লক অ্যামাউন্টের পরিমাণ বেড়ে ১১ হাজার ৯০৪ ইউরো হয়েছে (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৫ লাখ ৯৭ হাজার টাকা)। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে নির্ধারিত অ্যামাউন্ট ছিল ১১ হাজার ২০৮ ইউরো (প্রায় ১৫ লাখ টাকা)।
দূতাবাসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছিল, জার্মানিতে পৌঁছে জীবনযাপনের খরচ বহন করার সক্ষমতা প্রমাণ করার জন্য স্টুডেন্ট ভিসা আবেদনকারীদের একটি ব্লকড ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকা এবং সেখানে উল্লেখিত পরিমাণ অর্থ ‘ব্লকড’ থাকা আবশ্যক।
এ ছাড়াও, শেনজেন ভিসা আবেদনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের এখন থেকে ভিসা ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ভিএফএসকে অগ্রিম প্রসেসিং ফি দিতে হবে। আবেদন করে অনুপস্থিত থাকার প্রবণতা ঠেকাতে এই উদ্যোগ নিয়েছে দূতাবাস।
সূত্র মতে, জার্মানির ১৬টি প্রদেশের মধ্যে ১৪টিতে শিক্ষার্থীদের কোনো টিউশন ফি দিতে হয় না। প্রতি ছয় মাস অন্তর ২০০ থেকে ৪০০ ইউরো সেমিস্টার ফি দিতে হয়, যার মধ্যে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে রাজ্যে অবস্থিত, সেখানকার সকল গণপরিবহনের ভাড়াও অন্তর্ভুক্ত থাকে। রয়েছে খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ। এসব কারণে জার্মানি শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে। কিন্তু বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সহজে মিলছে না সিরিয়াল। যার কারণে অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে ভর্তিচ্ছু ৮০ হাজার শিক্ষার্থীর জার্মানি যাওয়ার স্বপ্ন।
ঢাকায় অবস্থিত জার্মান দূতাবাসের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে এক হাজার ৭২৩ জনের ভিসা দিয়েছে জার্মানি। যা করোনার আগের বছরগুলোর তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থী অফার লেটার ও ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পরও যেতে পারছেন না। ভর্তিচ্ছুরা চাচ্ছেন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত জার্মান সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে এর সমাধানে আসা।
অফার লেটার হাতে, কিন্তু যাত্রা অনিশ্চিত
জার্মানিতে ভর্তির সুযোগ পেলেও ভিসা জটিলতায় আটকে পড়েছেন হাজারো শিক্ষার্থী। আব্দুর রাজ্জাক নামের একজন শিক্ষার্থী জানান, “২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি, কিন্তু এখনো যেতে পারিনি। আদৌ পারবো কি না, তাও নিশ্চিত না।” আরেক ভর্তিচ্ছু জুবায়ের হাসান বলেন, “১৬-১৭ মাস অপেক্ষার কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু এখন আড়াই বছর পেরিয়ে গেছে, এখনও সিরিয়াল আসেনি। অথচ সেমিস্টার ফি বাবদ প্রায় ১ লাখ টাকা গচ্চা দিতে হয়েছে।”
দূতাবাস জানে না অপেক্ষার শেষ কোথায়
জার্মান দূতাবাস তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেইজে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, “অতিরিক্ত আবেদন পড়ায় নির্দিষ্ট কোনো ওয়েটিং টাইম জানানো সম্ভব নয়”। তারা আবেদনকারীদের ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানাচ্ছে।
দূতাবাস সূত্র বলছে, করোনা পরবর্তী সময়ে অপেক্ষার সময় ছিল ১২-১৫ মাস, যা ধীরে ধীরে বেড়ে এখন অজানা এক অনিশ্চয়তায় রূপ নিয়েছে। দূতাবাসের বার্ষিক ভিসা প্রক্রিয়াকরণ সক্ষমতা প্রায় দুই হাজার, যা বিপরীতে থাকা হাজার হাজার শিক্ষার্থীর চাহিদা পূরণে পুরোপুরি অপ্রতুল।
সরকারি পদক্ষেপ, কিন্তু সমাধান দূরে
ভর্তিচ্ছুরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তারা একাধিকবার যোগাযোগ করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা জার্মান দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রুত সমাধান চেয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার মাটিতে খুব একটা অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার জানিয়েছেন, ভিসা আবেদন প্রক্রিয়ার একটি বড় অংশ বহিরাগত প্রতিষ্ঠান ভিএফএস ঢাকার মাধ্যমে আউটসোর্স করা হয়েছে, যা কিছুটা চাপ কমিয়েছে। এছাড়া জার্মানির অভ্যন্তরীণ বাসস্থান আইনে কিছু পরিবর্তনের ফলে আবেদন প্রক্রিয়া দ্রুততর হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
পাকিস্তানের পথ অনুসরণে সম্ভাব্য সমাধান
ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একই সমস্যায় পড়েছিল পাকিস্তানের শিক্ষার্থীরা। তবে তারা ২০২২ সালের পর ‘কনস্যুলার সার্ভিস পোর্টাল’ চালু করে সমস্যার সমাধান করেছে। এর মাধ্যমে সরাসরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ব্যবস্থা তুলে দিয়ে অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়া সম্ভব হয়েছে। ভারতে একইভাবে ভিসা আবেদন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশেও এমন কোনো ডিজিটাল পদ্ধতি চালুর দাবি জানাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা, যাতে করে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয়।
উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে যারা জার্মানির দিকে তাকিয়ে, তাদের জন্য এই দীর্ঘ ওয়েটিং পিরিয়ড এক প্রকার মানসিক ও অর্থনৈতিক দুঃস্বপ্নে রূপ নিচ্ছে। শিক্ষার্থীরা সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন, যেন জার্মান সরকারের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ ও ডিজিটাল প্রক্রিয়া চালুর ব্যবস্থা করা হয়, যাতে দ্রুত ও ন্যায্যভাবে ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়।## সূত্রঃমানবজমীন
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.