-- বিজ্ঞাপন ---

পরমাণু বোমার নকশা  চুরি করে পাকিস্তানের  হিরো বনে যান  ড. কাদের খান

0

মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম#

ভারতের জবাবে পাকিস্তানও  ১৯৯৮ সালে  নিজেদের পরমাণু শক্তিমত্তার পরিচয় দিতে পরমাণু বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটাবে ঘোষণা দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে এই  বিস্ফোরণ না ঘটাতে চাপ দেয় এমনকি শতাধিক এফ-১৬ জঙ্গী বিমানসহ  বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও আর্থিক অনুদানের টোপ দেয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এতে রাজী হয়নি। শেষ পর্যন্ত ভারতের পরীক্ষার দু সপ্তাহের পরই পাকিস্তান বেলুচিস্তানের চাগাই পর্বতে  ১৯৯৮ সালের ২৮ মে একসঙ্গে ৫টি ও পরে ৩০ মে আরও ১টি সহ মোট ৬ টি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভারতের জবাব দেয়। পাকিস্তানের এ পরমাণু বোমা বানানোর পিতা বলা হয় ড. আবদুল কাদের খানকে।

 

ড. আবদুল কাদের খানের (এ কিউ খান)পরমাণু বোমা বানানোর পরিকল্পনা জেমস বন্ড ০০৭ সিরিজকেও হার মানায়। আমেরিকার প্রখ্যাত বিজ্ঞানী রবার্ট এস. নরিস পাকিস্তানের পরমাণু বিজ্ঞানী ড. আবদুল কাদের খানের উপর এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। ড. খান কিভাবে ইউরোপ থেকে পরমাণু বোমা তৈরীর নকশা চুরি করে পালিয়ে আসেন পুরো ঘটনার উল্লেখ রয়েছে তার লেখায়। এখানে খানিকটা উদ্ধৃত করা গেল। ভারতের ভূপালে জন্ম  ড. আবদুল কাদের খান (জন্ম ১ এপ্রিল, ১৯৩৬) এর পিতামাতা দেশ বিভাগের পর ১৯৫২ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে আসেন।

 

পাকিস্তান থেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি জার্মানীর বার্লিন ও নেদারল্যান্ডস থেকে গ্র্যাজুয়েশন ও মাস্টার্স নেন মেটালার্জিতে ।  এবং পরে বেলজিয়াম থেকে ঐ বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী নেন। ইউরোপে পড়াশোনার সময় তিনি ১৯৬৪ সালে নেদারল্যান্ডের নাগরিক হেন্ডরিনা রিটারিংকে বিয়ে করেন। স্ত্রী ঐ দেশের নাগরিক হওয়ার সুবাদে ড. কাদের খান ১৯৭২ সালে ইউরোপের সবচাইতে স্পর্শকাতর তিন জাতির যৌথ পরিচালনায় ( জার্মান, ডাচ ও বৃটিশ)  আণবিক বোমা তৈরীর উপাদান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কারখানা ‘ইউরেনকো’এবং পরে নেদারল্যান্ডের আলমেলোতে প্রবেশের সুযোগ পান। তার কাজ ছিল জার্মান ভাষায় লেখা  আনবিক বোমা তৈরীর সেন্ট্রিফিউজগুলোর ডক্যুমেন্ট ডাচ ভাষায় অনুবাদ করা। এরই মধ্যে ১৯৭৪ সালের মে মাসে ভারত সেদেশের রাজস্থান রাজ্যের পোখরানে প্রথম আণবিক বোমার পরীক্ষা চালায়। তখনই ড. খানের মাথায় নিজ দেশ পাকিস্তানের জন্য বোমা তৈরীর পরিকল্পনা মাথায় ঢোকে।

 

তিনি ঐ বছরের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে তার পরিকল্পনার কথা চিঠিতে জানান। ভুট্টো সাথে সাথে তাকে উৎসাহ দেন এবং তিনমাসের মধ্যে ডিসেম্বর মাসে ড. খানের সাথে গোপন বৈঠক করেন। এভাবে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ১৯৭৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর  আনবিক বোমা তৈরীর মূল নকশা, সরঞ্জাম সাপ্লাইয়ারদের তালিকা চুরি করে স্ত্রী ও দু কন্যাকে  সাথে নিয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে আসেন। পরে নেদারল্যান্ডস সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ড. আবদুল কাদের খানকে গ্রেফতার করার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। ইতিমধ্যেই ড. খান পাকিস্তান সরকারের পূর্ণ সহযোগিতায় খান রিচার্স লেবরেটরি প্রতিষ্ঠা করে আণবিক বোমা বানানোর কাজে হাত দেন এবং সফলতার সাথে তা  বানান। পরে তিনি পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচীতেও সফলতা দেখান হাতাফ, গৌরী, আবদালী, শাহীন প্রভৃতি নামের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরী করা হয় তার পরিকল্পনায়। এভাবে বিদেশে তিনি চোর হিসেবে চিহ্নিত হলেও দেশে তিনি আণবিক বোমা তৈরীর পিতা ও বীরের সম্মান পান।

 

পাকিস্তানের পরমাণু বোমা বানানোর জনক ড. আবদুল কাদের খানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো  পরমাণু বোমা বানানোর তথ্য নকশা ইত্যাদি ইরান, উত্তর কোরিয়া ও লিবিয়ায় পাচার চক্রের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ করছিল। তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ২০০৪ সালে তাকে গৃহবন্দী করেন। তিনি টেলিভিশনে  ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী উত্তর কোরিয়া, ইরান ও লিবিয়ায় পরমাণু বোমা তৈরীর গোপণ তথ্য বিক্রী করেছিলেন মর্মে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যও দেন।  এরপর পারভেজ মোশাররফ তাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমা ঘোষণা করে নজরবন্দী করেন। পাকিস্তানের পরমাণু বোমা  তৈরীর জনক ড.আবদুল কাদের খানের টেলিভিশনে প্রকাশ্যে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য এবং পরদিনই তাকে ক্ষমা ঘোষণার ব্যপারটিও ছিল নাটকীয়। পশ্চিমারা একে সাজানো নাটক বলে আখ্যা দেন। পরমাণু তথ্য পাচারের অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলি ড. কাদের খানকে  তাদেও দেশে এবং আন্তর্জাতিক আদালতে সমর্পনের জন্য ক্রমাগত চাপের মুখে পারভেজ মোশাররফ নিজেই তাকে সাজানো বিচার করেছেন বলে পশ্চিমা দেশগুলো অভিযোগ করেন।

 

তৎকালীন পারভেজ মোশাররফের ভুমিকা এতই নাটকীয় ছিল যে, এমনকি  বিদেশী কোন তদন্ত সংস্থাকে পর্যন্ত  ড. কাদের খানকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেননি তিনি।  জানা গেছে, ঐ সময় ড. কাদের খান প্রোস্টেট ক্যান্সারে ভুগছিলেন। পাঁচ বছর নজরবন্দী থাকার পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারীর প্রথম দিকে তিনি মুক্তি পান। তখন পাকিস্তানের হাইকোর্ট  ড. কাদের  খানের আটকাদেশ মামলার রায়ে বলে যে, ড. কাদের খান  কোন পরমাণু তথ্য ইরান, উত্তর কোরিয়া ও লিবিয়ায় পাচার করেননি । এবং আদালতের আদেশে তার আটকাদেশ প্রত্যাহার করে বলা হয় তিনি এখন মুক্ত নাগরিক। ম্যাক কেলম্যান তার লেখা ‘এ কিউ খান’ বইতে বলেছেন, পরমাণু বোমার তথ্য পাচার নেটওয়ার্কের সাথে তৎকালীন সামরিক প্রধান পারভেজ মোশাররফ ও সেনা সদস্যরা জড়িত ছিলেন এজন্য ড. খানকে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য প্রদানে বাধ্য করা হয়। পশ্চিমা দেশগুলির সাথে  সুসম্পর্ক থাকার কারণে তারাও মোশাররফকে এব্যাপারে বেশী চাপ সৃষ্টি করেনি। পারভেজ মোশাররফ সরকার বিদায় হওয়ার পর তিনি মুখ খোলেন এবং বলেন তার কাছ থেকে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছিল।  এবং তাঁকে বলির পাঠা হতে বাধ্য করেছিল তৎকালীন মোশাররফের সামরিক  সরকার।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু বিজ্ঞানীদের প্রভাবশালী সংগঠন ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টদের বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা হলেন হ্যান্স এম. ক্রিস্টেনসেন,  রবার্ট এস. নরিস  ও জুলিয়া ডায়মন্ড। গত বছর ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ফেডারেশনের বুলেটিনে পাকিস্তানের পরমাণু বোমা বানানোর হার আশংকাজনক বৃদ্ধির কারণ উল্লেখ করে  শিরোনাম ‘ পাকিস্তানি নিউক্লিয়ার ফোর্সেস, ২০১৮’ প্রতিবেদন তুলে ধরেন। এতে তারা আশংকার সাথে উল্লেখ করেন যে, বর্তমানে পাকিস্তানের হাতে ১৪০-১৫০ টি পারমানবিক ওয়ারহেড রয়েছে যা পাকিস্তানের স্বল্প পাল্লার ‘নসর’সহ, মাঝারি ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুত করে রেখেছে মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বিজ্ঞানীরা ঐ প্রতিবেদনে বলেন, যে হারে পাকিস্তান পরমাণু বোমা বানিয়ে চলেছে  ২০২৫ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ২২০-২৫০টি পরমাণু বোমার ওয়ারহেডের অধিকারী  হবে পাকিস্তান। পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচীর এতদূর এগোনো র  মূল গোড়া পত্তন করেছিলেন  সেদেশের পরমাণু  বোমা বানানোর জনক ড. আবদুল কাদের খান।

 

এদিকে সম্প্রতি ফেসবুকে ড. আবদুল কাদের খানের মৃত্যু হয়েছে গুজব রটে। পাকিস্তানের পত্র -পত্রিকায় ড. কাদের খান তাঁর ভিডিও বক্তব্য সম্বলিত ক্লিপ পাঠিয়ে বলেছেন, তিনি এখনও আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছেন এবং আরও বছর  কয়েক বাঁচতে চান । পাকিস্তানের শত্রুরাই ফেসবুকে তার মৃত্যুর গুজব  ছড়িয়েছে বলে তিনি আক্ষেপ করেন।#

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.