সিরাজুর রহমান##
আমাদের এই চিরচেনা অতি রহস্যময় আকাশগঙ্গা ছায়াপথে আনুমানিক ৪০০ বিলিয়নের অধিক নক্ষত্র রয়েছে। যার মধ্যে কিছু সংখ্যক নক্ষত্র আবার একেবারে বিক্ষিপ্তভাবে ও অত্যন্ত দ্রুত গতিতে মহাবিশ্বে ছুটে বেড়াচ্ছে। এই জাতীয় দুর্বৃত্ত নক্ষত্র (rogue) স্টারকে প্রাথমিকভাবে একটি ইন্টার গ্যালাক্টিক নক্ষত্র হিসাবে চিহ্নিত করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। এই জাতীয় নক্ষত্রগুলো একরকম হাইপার ভেলোসিটি স্টার সিস্টেমে রুপান্তর হয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে এবং স্বাধীনভাবে অসীম মহাশূন্যে, এক ছায়াপথ থেকে আরেক ছায়াপথে কিংবা নিজস্ব ছায়াপথের ভেতরেই ভ্রমণ করতে থাকে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা উচ্চ প্রযুক্তির টেলিস্কোপ দ্বারা নিবিড়ভাবে গবেষণা করে দেখেছেন যে, এই দুর্বৃত্ত নক্ষত্র (রোগ স্টার) নক্ষত্রগুলো ছায়াপথের কেন্দ্রীয় মহাকর্ষীয় টান থেকে যে কোন কারণেই হোক বিচ্যুত হয়ে নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে ইন্টার গ্যালাক্টিক মহাশূন্যে উদ্দেশ্যহীনভাবে ভ্রমণ করে যাচ্ছে। এই জাতীয় স্টার সিস্টেমের রহস্যময় বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত সঠিক তথ্য উপাত্ত উদ্ধার করতে পারেননি। তবে দুই দশক আগে থেকে কিছু সংখ্যক এই জাতীয় স্টার সিস্টেমের গতিবিধির উপর নিবিড়ভাবে নজর রাখছেন বিজ্ঞানীরা।
দুর্বৃত্ত নক্ষত্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের আগে জানতে হবে দুর্বৃত্ত নক্ষত্র (rogue) স্টার কী? আসলে দুর্বৃত্ত নক্ষত্র বা “রোগ” স্টার সিস্টেম হচ্ছে এক উচ্চগতির নক্ষত্র যা তাদের জন্মস্থান বা মাতৃ ছায়াপথের মহাকর্ষীয় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে মহাশূন্যে উদ্দেশ্যহীনভাবে ভ্রমণ করে যাচ্ছে। এই জাতীয় নক্ষত্রকে আরেক ভাষায় হাইপার ভেলোসিটি স্টার সিস্টেম কিংবা ইন্টার গ্যালাক্টিক স্টার বলা হয়। এই জাতীয় নক্ষত্র ছায়াপথের কেন্দ্রীয় কৃষ্ণগহ্বর বা অন্যান্য মহাজাগতিক ঘটনার প্রভাবে বিচ্যুত হয়। তাছাড়া এদের গতি অবিশ্বাস্যভাবে প্রতি সেকেন্ডে আনুমানিক ৮০ কিলোমিটার থেকে ১ হাজার ৭৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গভীরভাবে অধ্যয়ন করে দেখেছেন যে, ছায়াপথে থাকা বাইনারি স্টার সিস্টেমে থাকা দুটি নক্ষত্রের একটির মৃত্যু হলে অপর বাইনারি স্টারটি কেন্দ্রীয় মাধ্যাকর্ষণ শক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করে রোগ স্টারে বা দুর্বৃত্ত তারায় পরিণত হয়। আবার কোন নক্ষত্র ছায়াপথে থাকা সুপার ম্যাসিভ ব্লাক হোলের শক্তিশালী মধ্যাকর্ষণের টানে কাছে চলে আসলেও ব্লাকহোলের ভিতরে প্রবেশ না করে ছিটকে বার হয়ে তীব্র গতির হাইপার ভেলোসিটি স্টার বা রোগ স্টারে পরিণত হতে পারে। তাছাড়া রোগ স্টারে পরিণত হতে হয়ত আরো বেশকিছু অজানা কারণ থাকতে পারে। যা নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, দুর্বৃত্ত নক্ষত্রের উৎপত্তি বেশকিছু মহাজাগতিক কারণে হতে পারে। তার মধ্যে বাইনারি সিস্টেমের ধ্বংস অর্থাৎ যদি একটি বাইনারি স্টার সিস্টেমের একটি নক্ষত্র সুপারনোভা হিসাবে বিস্ফোরিত হয়, তবে অপর নক্ষত্রটি প্রবল মহাকর্ষীয় শক্তির টান থেকে মুক্ত হয়ে দুর্বৃত্ত নক্ষত্রে পরিণত হতে পারে। তাছাড়া ছায়াপথের কেন্দ্রে থাকা শক্তিশালী সুপার ম্যাসিভ ব্লাক হোলের কাছে কোন নক্ষত্র আসলে, তা মহাকর্ষীয় শক্তির টানে ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে চরম পর্যায়ের গতি অর্জন করতে পারে। তাছাড়া অন্যান্য কারণের মধ্যে গ্যালাক্টিক সংঘর্ষ বা নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে মহাকর্ষীয় টানের প্রভাবে এটি নক্ষত্র রোগ স্টারে পরিণত হতে পারে।
আমাদের চিরচেনা আকাশগঙ্গা ছায়াপথে ছুটে বেড়ানো এমনি এক দুর্বৃত্ত নক্ষত্র (বাইনারি স্টেলার সিস্টেম) হচ্ছে স্কোলজ স্টার (Scholz’s star) বা ডাব্লিউআইএসই-০৭২০-০৮৪৬ লাল বামন নক্ষত্র। গবেষকেরা যাকে একটি রোগ বা দুর্বৃত্ত নক্ষত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যেটি কিনা আমাদের সূর্য থেকে প্রায় ২২ আলোকবর্ষ বা ৬.৮ (কিলো পারসেক) দূরত্বে মনোসেরোস নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থান করছে। এই নক্ষত্রের ভর আমাদের সূর্যের প্রায়০.১৫ গুণ এবং এর গতি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৮৩ কিলোমিটার।
এই রোগ স্টার সিস্টেমটি বিগত ২০১৩ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাল্ফ-ডিয়েটার স্কোলজ প্রথম আবিষ্কার করেন। তার নাম অনুসারে এই লাল বামন নক্ষত্রের নামকরণ করা হয় স্কোলজ রোগ স্টার। বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী এই বামন নক্ষত্রটি (Scholz’s Star) আজ থেকে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার বছর আগে আমাদের সোলার সিস্টেমের শেষ প্রান্তে থাকা ওর্ট ক্লাউডের প্রায় ০.৮২ আলোকবর্ষ বা ৫৫,০০০ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট (এইউ) দূরত্ব দিয়ে অতিক্রম করে চলে যায়। যদিও এতে আমাদের সোলার সিস্টেমের বড় ধরনের কোন ক্ষতি হয়নি বলে মনে করেন তারা।
স্কোলজ স্টার (Scholz’s star) বা ডাব্লিউআইএসই-০৭২০-০৮৪৬ লাল বামন নক্ষত্রের আয়ুষ্কাল সাধারণত ৩ বিলিয়ন বছর থেকে ১০ বিলিয়ন বছর পর্যন্ত হতে পারে। এই রেড ডুয়ার্ফ দুর্বৃত্ত স্টার সিস্টেমের ভর খুবই কম বলে মনে হলেও এটি আমাদের সোলার সিস্টেমের ওর্ট ক্লাউডে প্রবেশ করলে তীব্র গতির ও নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জন্য শুরু হয়ে যেতে পারে ভয়ংকর বিপর্যয়। এত প্রভাবে ওর্ট ক্লাউডে থাকা বড় বড় আইস কমেট মূল সোলার সিস্টেমে সরাসরি প্রবেশ করে গ্রহ উপগ্রহের সাথে সংঘর্ষ ঘটে যেতে পারে। যদিও এ ধরনের সম্ভাবনা আগামী কয়েক মিলিয়ন বছরের মধ্যে এক রকম নেই বললেই চলে।
তবে গত ২০১৯ সালের দিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অসীম মহাকাশে বিচরণ করে এমন সবচেয়ে দ্রুত গতির সুপার হাইপার ভেলোসিটি বা চরম মাত্রায় দুর্বৃত্ত নক্ষত্র খুঁজে পান। তারা এই দুর্বৃত্ত নক্ষত্রের নাম দেন দেন এস৫-এইচভিএস১। তারা এটিকে পর্যবেক্ষণ করে দেখেন যে, এর গতি কিনা অবিশ্বাস্যভাবে প্রতি সেকেন্ডে আনুমানিক ১ হাজার ৭৫০ কিলোমিটার। যা খুব সম্ভবত আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রে থাকা স্যাজিটারিয়াস-এ সুপার ম্যাসিভ ব্লাক হোলের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে ছিটকে বেড়িয়ে এসে এই অবিশ্বাস্য গতি অর্জন করেছে। যার বেগ কিনা আবার মিল্কিওয়ের মুক্তি বেগের চেয়েও অনেক বেশি।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, অসম্ভব দ্রুত গতির এই এস৫-এইচভিএস১ রোগ স্টার বা হাইপার ভেলোসিটি স্টার সিস্টেম হতে পারে হয়ত আমাদের চিরচেনা আকাশ গঙ্গা ছায়াপথে ধাবমান সবচেয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে চলা কোন ইন্টার গ্যালাক্টিক ট্রাভেলার অবজেক্ট। তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী, পৃথিবীর কয়েক মিলিয়ন বছরের ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত আনুমানিক প্রায় সাত শতাধিক রোগ বা দুর্বৃত্ত নক্ষত্র আমাদের সোলার সিস্টেমের খুবই কাছাকাছি ১ আলোকবর্ষ দূরত্বের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে। আবার কিছু সংখ্যক রোগ স্টার ১ আলোকবর্ষেরও কম দূরত্বে থেকে আমাদের সোলার সিস্টেমকে অতিক্রম করেছে।
রোগ স্টার বা দুর্বৃত্ত নক্ষত্রগুলি অসীম মহাবিশ্বের এক জটিল গতিশীলতার স্বাক্ষর বহন করে। এদের অধিকাংশই পৃথিবীর জন্য সরাসরি ঝুঁকিহীন হলেও, এদের পর্যবেক্ষণ মহাকর্ষীয় বলবিদ্যা, ছায়াপথের বিবর্তন ও নক্ষত্রের জীবনচক্র সম্পর্কে গভীর ধারণা প্রদান করে। ভবিষ্যতে আরও উচ্চগতির নক্ষত্রের আবিষ্কার মহাবিশ্বের অজানা রহস্য উন্মোচন করতে সহায়তা করবে। সহায়ক হবে। এরা বিক্ষিপ্তভাবে এক ছায়াপথ থেকে বের হয়ে নতুন কোন ছায়াপথে নিজের মতো করে প্রবেশ করে কিংবা নিজের ছায়াপথেই দ্রুত গতির শক্তি অর্জন করে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে থাকে। ##তথ্যসূত্র: বিবিসি, ইউনিভার্স স্পেস টেক, ইউকিপিডিয়া, নাসা, স্পেস ডটকম, ও ইউনিভার্স টুডে।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.