বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন#
ব্রিটেনের লেবার পার্টির মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিককে শেষপর্যন্ত পদত্যাগ করতে হলো। টিউলিপকে নিয়ে বেশ কয়েকদিন সরগরম ছিল বৃটিশ রাজনীতি। প্রবাসী বাঙ্গালীরাও নজর রাখছেন, কোন পথে যাচ্ছে পুরো ইস্যুটি। তবে টিউলিপ সিদ্দিক বেশ সাহসের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে তিনি নিজেই তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা ‘বিনা পয়সার ফ্ল্যাট’ গ্রহণের অভিযোগ তদন্তের দাবি তুলেছেন। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা লরি ম্যাগনাসকে চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে স্বাধীন তদন্তের প্রস্তাব দিয়েছেন।
টিউলিপ সিদ্দিক একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ, যিনি লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য (এমপি)। তিনি যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির একজন প্রভাবশালী নেতা এবং বর্তমানে ব্রিটেনের মন্ত্রী পর্যায়ের দায়িত্ব পালন করছেন। টিউলিপ বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন রেহানা সিদ্দিকের কন্যা। সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে, লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকায় আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বিনামূল্যে একটি অ্যাপার্টমেন্ট পেয়েছেন টিউলিপ। এই ঘটনায় ব্রিটেনের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে জড়িয়ে গেছেন টিউলিপের বোনের নামও।
অভিযোগের বিস্তারিত
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিনান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, টিউলিপ ২০০৪ সালে আব্দুল মোতালিফ নামের একজন প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ফ্ল্যাটটি পান। ওই সময় টিউলিপ মন্ত্রী বা পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন না। নথি অনুসারে, ২০০১ সালে ফ্ল্যাটটি ১ লাখ ৯৫ হাজার পাউন্ডে কেনা হয়। তবে, বর্তমানে ওই ভবনের আরেকটি ফ্ল্যাট ৬ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে বিক্রি হয়েছে বলে জানা গেছে। মোতালিফের পরিচিতরা জানান, টিউলিপের মা রেহানা ব্যবসায় মন্দার সময় মোতালিফকে আর্থিক সহায়তা করেছিলেন। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি নিজের সম্পত্তি টিউলিপকে উপহার দেন।
টিউলিপের প্রতিক্রিয়া
টিউলিপ সিদ্দিক অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, “আমি ব্রিটেনের একজন সংসদ সদস্য এবং লেবার পার্টির মন্ত্রী। আমার কোনো অন্যায় হয়নি। তারপরও আমি চাই এই বিষয়টি স্বচ্ছ তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণিত হোক।” তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা লরি ম্যাগনাসকে চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে স্বাধীন তদন্তের প্রস্তাব দিয়েছেন। তাঁর দাবি, “আমি জানি, আমি কোনো ভুল করিনি। তবু আমি চাই সত্য প্রকাশ্যে আসুক।”
লেবার পার্টি ও টিউলিপের অবস্থান
ব্রিটেনের আর্থিক দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্বে থাকা টিউলিপের বিরুদ্ধে ওঠা এই অভিযোগ লেবার পার্টির জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। টিউলিপের ইস্তফার দাবি তুলেছেন টরি পার্টির সদস্যরা। তবে লেবার পার্টির নেতারা জানিয়েছেন, টিউলিপ চিন সফরের একটি সরকারি সফর বাতিল করেছেন এবং তদন্তে সহযোগিতার জন্য ব্রিটেনেই অবস্থান করছেন।
পরিস্থিতির রাজনৈতিক প্রভাব
এই বিতর্ক ঘিরে ব্রিটেনে টিউলিপের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং লেবার পার্টির অবস্থান নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। অপরদিকে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সম্পর্ক নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। টিউলিপ সিদ্দিক টানা চার বার ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে নির্বাচিত হয়েছেন এবং বর্তমানে তিনি সিটি মিনিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই নেত্রীর এমন বিতর্ক তার ভাবমূর্তিকে প্রভাবিত করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
লন্ডনে বিনামূল্যে ফ্ল্যাট পাওয়া নিয়ে বিতর্কের মুখে থাকা লেবার পার্টির মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে পদত্যাগের চাপ বাড়ছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘দ্য মেইল অন সানডে’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিউলিপ সিদ্দিক লন্ডনে দুই বেডরুমের একটি ফ্ল্যাট উপহার পেয়েছেন, যা তিনি আগে অস্বীকার করেছিলেন। এ নিয়ে কনজারভেটিভ পার্টির এমপিরা তার পদত্যাগের দাবি তুলেছেন ।লেবার পার্টির নেতারা জানিয়েছেন, টিউলিপ সিদ্দিক চলতি সপ্তাহে চীন সফরে যাওয়ার কথা থাকলেও তিনি সেই সফর বাতিল করেছেন এবং তদন্তে সহযোগিতা করার জন্য ব্রিটেনে অবস্থান করছেন। এ পরিস্থিতিতে লেবার পার্টির অভ্যন্তরে টিউলিপ সিদ্দিকের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা চলছে। লেবার নেতা স্যার কিয়ার স্টারমারের নৈতিক মানদণ্ড বিষয়ক উপদেষ্টা স্যার লরি ম্যাগনাসের কাছে এ বিষয়ে তদন্ত চালানোর দাবি জানানো হয়েছে।
এই বিতর্কের ফলে লেবার পার্টির ভাবমূর্তি এবং টিউলিপ সিদ্দিকের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তদন্তের ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যত। যদি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হয়, তাহলে তাকে লেবার পার্টির নৈতিক মানদণ্ডের কারণে পদত্যাগ করতে হতে পারে। লেবার পার্টি যেহেতু জনমত এবং পার্টির ভাবমূর্তির বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখে, যদি এ বিতর্ক দলের জনপ্রিয়তা বা পার্টির নীতিগত অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত করে, তাহলে পার্টি তাকে পদত্যাগের জন্য চাপ দিতে পারে। সব জল্পনার অবসান শেষে সরে যেতে হলো টিউলিপকে।
তবে টিউলিপ সিদ্দিক যেহেতু নিজে থেকে তদন্ত আহ্বান করেছেন এবং তার বিরুদ্ধে কোনো ভুল না করার দাবি জানিয়েছেন, তাই তার অবস্থান দৃঢ়ভাবে ধরে রাখার চেষ্টা করেন টিউলিপ। ব্রিটিশ রাজনীতিতে গণমাধ্যমের প্রভাব অনেক বেশি। যদি মিডিয়া ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিষয়টিকে বড় বিতর্ক হিসেবে তুলে ধরে, তাহলে টিউলিপের ওপর পদত্যাগের চাপ বাড়তে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, যদি তদন্তে তার নির্দোষ প্রমাণ হয়, তাহলে তাকে পদত্যাগ করতে হবে না। তবে বিতর্ক দীর্ঘস্থায়ী হলে লেবার পার্টি পরিস্থিতি সামলাতে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যার মধ্যে পদত্যাগ একটি সম্ভাবনা হতে পারে। ব্রিটিশ রাজনীতিতে স্বচ্ছতার ওপর অত্যন্ত জোর দেওয়া হয়। তাই টিউলিপ যদি তার দিক থেকে পরিস্থিতি স্বচ্ছভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন, তাহলে হয়তো তিনি পদ ধরে রাখতে পারবেন। কিন্তু তা আর হলো না।
রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত টিউলিপ সিদ্দিক
একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ, যিনি লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য (এমপি)। তিনি যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির একজন প্রভাবশালী নেতা এবং বর্তমানে ব্রিটেনের মন্ত্রী পর্যায়ের দায়িত্ব পালন করছেন। টিউলিপ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন রেহানা সিদ্দিকের কন্যা।
টিউলিপের জন্ম ১৯৮২ সালে লন্ডনে। তিনি কিংস কলেজ লন্ডন থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক এবং লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজ থেকে রাজনীতি, নীতি এবং সরকার ব্যবস্থাপনায় মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ব্রিটিশ রাজনীতিতে প্রবেশের আগে তিনি বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা এবং কমিউনিটি প্রজেক্টে কাজ করেছেন। টিউলিপ ২০১০ সালে লন্ডনের ক্যামডেন কাউন্সিলের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন।
২০১৭, ২০১৯ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনেও এই আসন থেকে এমপি হিসেবে পুনরায় নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালে, টিউলিপ ব্রিটিশ সরকারের সিটি মিনিস্টার হিসেবে নিয়োগ পান। এই পদে তিনি মূলত আর্থিক সেক্টর এবং দুর্নীতি দমনে কাজ করছেন।
ব্রিটিশ সংসদে বসবাসরত সংখ্যালঘু এবং অভিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় সোচ্চার। আন্তর্জাতিক বিষয়ে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি নিয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি শিশুদের শিক্ষার উন্নয়ন এবং নারীদের ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করছেন।
টিউলিপের রাজনৈতিক জীবন সাধারণত সফল হলেও তিনি কিছু বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছেন, যার মধ্যে সাম্প্রতিক ‘বিনা পয়সার ফ্ল্যাট’ বিতর্ক অন্যতম। তবে তিনি প্রতিবারই তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের জবাব দিয়েছেন এবং স্বচ্ছতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। টিউলিপের স্বামী ক্রিশ্চিয়ান পার্সি একজন ব্রিটিশ নাগরিক এবং তাদের দুটি সন্তান রয়েছে। তিনি বাংলাদেশি-ব্রিটিশ পরিচয়কে গর্বের সঙ্গে তুলে ধরেন এবং দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করেন। টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ রাজনীতিতে একজন সফল বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নেতা হিসেবে পরিচিত, যিনি তার কাজ এবং নৈতিক মান বজায় রেখে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।##
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.