জাফর এক্সপ্রেস হাইজ্যাক: পাকিস্তানি বাহিনীর অভিযানে ১৫৫ জন উদ্ধার, ২৭ সন্ত্রাসী নিহত
বেলুচিস্তানে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত
বিশেষ প্রতিনিধি#
বেলুচিস্তানের বোলান জেলার মাশকাফ টানেলের কাছে মঙ্গলবার পাকিস্তানের জাফর এক্সপ্রেস ট্রেনটি সন্ত্রাসীদের দ্বারা হাইজ্যাক হওয়ার পর পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী বড় পরিসরের এক উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেছে। বুধবার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম নিশ্চিত করেছে যে এখন পর্যন্ত ১৫৫ জন যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে, ২৭ জন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে, এবং বেশ কয়েকজন সেনা সদস্যসহ যাত্রীও হতাহত হয়েছে।
ঘটনার বিশদ বিবরণ
হাইজ্যাকের ধরন ও সময়কাল
জাফর এক্সপ্রেসটি রাওয়ালপিন্ডি থেকে কোয়েটার উদ্দেশে যাচ্ছিল, যখন এটি মাশকাফ টানেলের কাছে পৌঁছায়, তখন একদল ভারী অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ট্রেনটি থামিয়ে ৪৫০ জনের বেশি যাত্রীকে জিম্মি করে। সন্ত্রাসীরা ট্রেনের যাত্রীদের ভয় দেখিয়ে কিছু নির্দিষ্ট যাত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং ট্রেনের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
কারা এই হামলার পেছনে?
নিষিদ্ধ ঘোষিত বিদ্রোহী গোষ্ঠী বেলুচ লিবারেশন আর্মি (BLA) এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে আসছে।
উদ্ধার অভিযান: কীভাবে পরিচালিত হলো?
হাইজ্যাকের খবর পাওয়ার পর, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, ফ্রন্টিয়ার কর্পস (FC), ও অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থাগুলো দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে অভিযান শুরু করে। প্রথমেই এলাকাটি ঘিরে ফেলে যাতে সন্ত্রাসীরা পালাতে না পারে। হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহার করে ট্রেনের অবস্থান ও সন্ত্রাসীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়। সন্ত্রাসীরা যাত্রীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, এই আশঙ্কায় নিরাপত্তা বাহিনী অত্যন্ত সতর্কতার সাথে অভিযান পরিচালনা করে। একপর্যায়ে, পাকিস্তানি বাহিনী ট্রেনের কয়েকটি কামরায় অভিযান চালিয়ে ১৫৫ জন যাত্রীকে নিরাপদে বের করে আনে। যাত্রীদের মধ্যে ৩৭ জন আহত ছিল, তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ ও সংঘর্ষ
সন্ত্রাসীরা আধুনিক স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ও বিস্ফোরক ব্যবহার করে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। গুলি বিনিময়ের মধ্যে ২৭ জন সন্ত্রাসী নিহত হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর ১০ জন সদস্য ও কয়েকজন যাত্রী হতাহত হয়। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, সন্ত্রাসীরা নারী, শিশু ও নিরীহ যাত্রীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে, যা অভিযান পরিচালনাকে কঠিন করে তুলেছে।
আত্মঘাতী হামলার হুমকি
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কয়েকজন সন্ত্রাসী আত্মঘাতী বিস্ফোরক বেল্ট পরে ছিল, এবং তারা জিম্মিদের খুব কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে হুমকি দিচ্ছিল। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম দাবি করেছে, এই সন্ত্রাসীরা আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে তাদের সহযোগীদের সাথে যোগাযোগ করছিল। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি তদন্ত করছে এবং সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও নিন্দা
ঘটনার পরপরই আন্তর্জাতিক মহল থেকে ব্যাপক নিন্দা জানানো হয়।
ইরান: ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাগায়ে হামসেহ এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন এবং পাকিস্তানের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন।
জাতিসংঘ: জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক বলেন, “আমরা যাত্রীদের অবিলম্বে মুক্তি দাবি করছি এবং পাকিস্তান সরকারকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে প্রস্তুত।”
যুক্তরাষ্ট্র: মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর হামলাকে “সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড” হিসেবে অভিহিত করে জিম্মিদের নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব দেয়।
মানবাধিকার সংস্থা: পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশন (HRCP) ঘটনাটিকে “গভীর উদ্বেগজনক” বলে অভিহিত করেছে এবং অবিলম্বে জিম্মিদের মুক্তির আহ্বান জানিয়েছে।
পাকিস্তান সরকারের প্রতিক্রিয়া
প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি এবং প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট জারদারি বলেন, “বেলুচিস্তানের জনগণ নিরীহ যাত্রীদের ওপর হামলাকারী এই বর্বর সন্ত্রাসীদের প্রত্যাখ্যান করেছে।” প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ বলেন, “এই জঘন্য হামলাকারীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা বেলুচিস্তান ও পুরো পাকিস্তানে সন্ত্রাস দমনে কঠোর ব্যবস্থা নেব।”
পরবর্তী পদক্ষেপ
বেলুচিস্তানে সামরিক বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ওই অঞ্চলের ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। যাত্রীদের পরিবারের তথ্য জানার জন্য রাওয়ালপিন্ডি ও কোয়েটা রেল স্টেশনে জরুরি হেল্প ডেস্ক খোলা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া
কেন ট্রেনকে টার্গেট করা হলো?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে যাওয়া BLA এখন নতুন কৌশল হিসেবে বেসামরিক নাগরিকদের টার্গেট করছে, যাতে তারা আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে।
পাকিস্তানের জন্য পরবর্তী চ্যালেঞ্জ কী?
সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন অভিযানের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। বেলুচিস্তানে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে নিরাপত্তা সংক্রান্ত আলোচনা ও সহযোগিতা বাড়াতে হবে।
জাফর এক্সপ্রেস ট্রেন হাইজ্যাকের ঘটনাটি পাকিস্তানের জন্য একটি বড় নিরাপত্তা সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। যদিও নিরাপত্তা বাহিনী সফল অভিযান চালিয়ে ১৫৫ জন যাত্রীকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে, তবুও সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া কৌশল ভবিষ্যতে আরও জটিলতা তৈরি করতে পারে। বর্তমানে অভিযান অব্যাহত রয়েছে, এবং পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে আরও সময় লাগতে পারে।## সূত্রঃ ডন, পাকিস্তান/ছবিঃএএফপি/আনন্দবাজার
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.