--- বিজ্ঞাপন ---

মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে খেলছে আমেরিকা-রাশিয়া, আরেকটি যুদ্ধের সামনে বিশ্ব

0

কাজী আবুল মনসুর##
হঠাৎ করে এত সাইরেনের আওয়াজ অনেক দিন শুনেন নি ইসরাইলের সাধারন মানুষ। চর্তুদিক থেকে আওয়াজ এলো ইসরাইল আক্রমন করেছে ইরান। দলবদ্ধভাবে যে যেভাবে পারে আশ্রয় নিচ্ছে বাঙ্কারে। ইসরাইলের ঘরে ঘরে এখন বাঙ্কার নির্মানের প্রস্ততি চলছে। কাতারে কাতারে সম্মিলিতভাবে যাতে বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে পারে সে ব্যবস্থা করে রাখছে ইসরাইলের মানুষ। সবার চোখে চোখে মুখে সব সময় বিরাজ করছে আতঙ্কের ছাপ। ইরান যেদিন প্রায় দু’শ মতো মিশাইল বা ক্ষেপনাস্ত্র মারলো সেদিন ছিল ইসরাইলের মানুষের কাছে এক আতঙ্ক আর ভয়ের সময়। রাতের আধারে আকাশ চিরে ধেয়ে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র। অনেক দিন এমন দৃশ্য দেখেন নি ইসরাইলিরা। মাঝে মাঝে বিস্ফোরণের শব্দে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে মাটি। ইসরায়েলের বড় অংশ জুড়ে একই চিত্র। ইহুদি রাষ্ট্রে যখন চলছিল আতঙ্কের পরিবেশ, তখন ইরানের তেহরান, আরাক ও কোম শহরে শরু হয় আনন্দ উল্লাস। গত ১লা অক্টোবর মঙ্গলবার রাতে ইরানের ক্ষেপনাস্ত্র হামলার এ ছবি ক্ষনিকের মধ্যে শিরোনাম হয় বিশে^র গণমাধ্যমগুলোর। যা দেখে শিউরে উঠে খোদ বিশ্বের অনেক পরাশক্তিধর রাষ্ট্র।

প্রশ্ন উঠে,তাহলে কি আরেকটি মহাযুদ্ধের সামনে কি পৃথিবী। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া। অনেকের মধ্যে শঙ্কা জাগে ধেির ধীরে কি মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। একদিকে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে আমেরিকা। একই সাথে ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া সহ আমেরিকার একঝাঁক বন্ধুরাষ্ট্র হামলার নিন্দায় সরব হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ইরানকে অভয় দিয়ে রাশিয়া বলছে আমরা তোমাদের পাশে আছি। একদিকে ইসরায়েল, আমেরিকা, ফ্রান্স, সৌদি আরব। লেবানন, হুথি, হামাস, ইরান এবং হিজবুল্লাহ। এরই মধ্যে ইসরাইল লেবাননের সাথে স্থলযুদ্ধ শুরু করেছে। লড়াইটা এতদিন ছিল ইসরায়েল বনাম ইরানের হামাস ও হিজবুল্লার সাথে। এখন ইসরায়েলের সাথে লেবানন ও ইরান দুটো দেশই জড়িয়ে গেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে একদিন এ যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। ইরানের টার্গেট ছিল তেল আভিভ। তাই তেল আভিভকে লক্ষ্য করে প্রায় ২০০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে জানান দেয় ইরান। যদিও ইসরাইলের দাবি তাদের বিখ্যাত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ‘আয়রন ডোম’ সক্রিয় ছিল। অথচ ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড অবশ্য পাল্টা জানিয়েছে, ‘আয়রন ডোম’কে বোকা বানিয়ে ৯০ শতাংশ ক্ষেপণাস্ত্রই নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হেনেছে।

এর মধ্যে ইসরাইল লেবাননের উপর আক্রমণ চালানো শুরু করেছে। বিশেষ করে হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে তৎপর ইসরাইল। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সংঘাত তীব্রতর হয়। ইসরাইলি বাহিনী দক্ষিণ লেবাননে স্থল আক্রমণ শুরু করে এবং হিজবুল্লাহর সামরিক ঘাঁটিগুলোর বিরুদ্ধে একাধিক বিমান হামলা চালায়। এই আক্রমণের লক্ষ্য ছিল হিজবুল্লাহর অবকাঠামো ধ্বংস করা। বিশেষ করে টানেল ও ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চিং সাইটগুলো, যা ইসরাইলের জন্য হুমকি তৈরি করেছিল। ইসরাইল হিজবুল্লাহর উচ্চপদস্থ নেতাদের একের এক হত্যা করে চলেছে। এর প্রতিশোধ নিতে হিজবুল্লাহও উঠেপড়ে লেগেছে। হিজবুল্লাহর আক্রমনও আরও তীব্র হয়েছে। বিশেষ করে, ২০২৪ সালের অক্টোবরের শুরুতে ইসরাইলি আক্রমণে হিজবুল্লাহর বেশ কয়েকজন নেতার মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। উভয় পক্ষই ক্রমাগত পাল্টা হামলার মাধ্যমে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। ইসরাইল বর্তমানে দক্ষিণ লেবাননে আরও বড় আকারের স্থল অভিযানের প্রস্ততি নিচ্ছে। ইসরাইল ও লেবাননের মধ্যে সংঘাত নতুন না। বছরের পর বছর ধরে ইসরাইল টার্গেট করে লেবাননকে ধ্বংসস্তুপে পরিনত করছে। নানা ক‚টনৈতিক উদ্যোগও ইসরাইলকে লেবানন আগ্রাসন থেকে থামাতে পারে নি।

সূত্র মতে, ইসরাইল ও লেবাননের চলমান সংঘাত বন্ধের জন্য অনেকবার কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক শক্তি, যেমন জাতিসংঘ, সংঘাত প্রশমিত করার লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সম্প্রতি, একটি যুদ্ধবিরতির জন্য ২১ দিনের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, যাতে কূটনৈতিক সমাধানের সুযোগ তৈরি হয়। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্র হিজবুল্লাহ এবং ইসরাইলের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর জন্য চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। কারণ পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের সম্ভাবনা গুরুতর আঞ্চলিক সঙ্কট তৈরি করতে পারে।

মূলত ইসরাইল ও লেবাননের মধ্যে কূটনৈতিক সমাধান সম্ভব হলেও এটি অত্যন্ত জটিল। কারণ এই সংঘাতের মূল চালিকাশক্তি হল ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে শত্রæতা। একই সাথে আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো যুদ্ধ থামাতে এবং যুদ্ধবিরতির জন্য চেষ্টা করছে। কিন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে গভীর আস্থার অভাব এবং দীর্ঘদিনের বিরোধ এই সমাধানকে কঠিন করে তুলছে। তবে, চাপ এবং মধ্যস্থতা যদি যথেষ্ট কার্যকর হয়, তাহলে সাময়িক যুদ্ধবিরতি বা স্থায়ী সমাধানের সম্ভাবনা হতে পারে। ইসরাইল ও লেবাননের মধ্যে সরাসরি শান্তি আলোচনা নিয়ে এখনো নির্দিষ্ট কোনো তারিখ ঘোষণা হয়নি। তবে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তি যেমন জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও আলোচনার উদ্যোগ নিচ্ছে। বর্তমানের সংঘাত পরিস্থিতির কারণে তাৎক্ষণিক আলোচনার সম্ভাবনা আপাতত সীমিত, তবে দফায় দফায় মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা চলছে। যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শান্তি আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তবে এটির সফলতা নির্ভর করবে উভয় পক্ষের সদিচ্ছা এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চাপের ওপর। তবে ইসরাইল-লেবানন সংঘাত বন্ধে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অস্ত্রবিরতি প্রতিষ্ঠা এবং কূটনৈতিক সমাধানের জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বিশেষভাবে ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করছে, কারণ এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে আলোচনার পথে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা চলছে, যদিও এখনো বড় কোনো অগ্রগতি হয়নি ।

আসলে ইসরাইল এবং লেবাননের মধ্যে যুদ্ধের ইতিহাস জটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী। এ ইতিহাস মূলত ইসরাইল-আরব সংঘাত, ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংকট, এবং হিজবুল্লাহর উত্থানের সাথে সম্পর্কিত। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর, আরব দেশগুলো এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। লেবাননও এই যুদ্ধে অংশ নেয়। ইসরাইলের প্রতিষ্ঠার ফলে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থী লেবাননে আশ্রয় নেয়, যা পরে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ১৯৮২ সালে ইসরাইল দক্ষিণ লেবাননে আক্রমণ করে, যার উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) কে পরাজিত করা। পিএলও দক্ষিণ লেবাননকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটি ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছিল। ইসরাইল বৈরুত পর্যন্ত এগিয়ে যায় এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে সহিংসতা ঘটে। সাবরা এবং শাতিলা গণহত্যা অন্যতম। ইসরাইলি বাহিনী ১৯৮৫ সালে দক্ষিণ লেবাননের অংশবিশেষে তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে বাকি অঞ্চল থেকে প্রত্যাহার করে। ইসরাইলের দক্ষিণ লেবানন দখল হিজবুল্লাহর উত্থানের একটি প্রধান কারণ। হিজবুল্লাহ ইরান-সমর্থিত শিয়া গোষ্ঠী, যারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতরোধ আন্দোলন হিসেবে গড়ে ওঠে। ১৯৮৫ সালের পর থেকে হিজবুল্লাহ ইসরাইলি বাহিনী এবং এর সহযোগী দক্ষিণ লেবাননের মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহ ইসরাইলি সেনাদের অপহরণের পর ইসরাইল লেবাননে ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে। এটি প্রায় ৩৪ দিন ধরে চলে এবং এতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে। ইসরাইল ও হিজবুল্লাহ উভয় পক্ষই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির হয়। যুদ্ধ শেষে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে একটি অস্ত্রবিরতি হয়, কিন্তু পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। হিজবুল্লাহ, একটি ইরান-সমর্থিত সংগঠন। এটি এখন লেবাননে ইসরাইলের জন্য সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিজবুল্লাহ ইসরাইলের বিরুদ্ধে অনেক সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে। ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইসরাইল মনে করে যে, হিজবুল্লাহর অস্ত্রভান্ডার এবং ইরানের সমর্থন এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা এবং ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করেছে। তাই,ইসরাইল যে কোনভাবে হিজবুল্লাহকে নির্মূল কবরে। ফলে একের পর নেতা হত্যা, সামরিক স্থাপনা এবং অস্ত্রাগারকে টার্গেট করে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে এরই মধ্যে ইসরাইলের বিপদে বরাবরের মতো পাশে দাঁড়িয়েছে আমেরিকা। মার্কিন সেনাদের ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নির্দেশ দিয়েছেন তেল আভিভ রক্ষা করার জন্য। ইরানের প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে করার কথাও বলেছেন। সক্রিয় করা হয়েছে মার্কিন নৌসেনার ডেস্ট্রয়ারকে। ইসরাইল ও আমেরিকা ইরানের মিসাইল হানার পিছনে রাশিয়ার প্রত্যক্ষ হাত রয়েছে বলে উল্লেখ করে। ইসরাইল আক্রান্ত হওয়ার পর পরই মন্ত্রিসভার জরুরী বৈঠক ডাকেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। বৈঠক শেষে হুমকিন ধরনটা ছিল এ রকম, ‘ইরান বড় ভুল করল। এর ফল ভোগ করতে হবে।’ এর পরই পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইরানি সংসদের স্পিকার। বলেছেন, ‘এরপর এমন এক ফরম্যাটে আক্রমণ হবে, যা ইজরায়েল ভাবতেও পারবে না।’ অন্যদিকে ইরানের পাশে দাঁড়িয়ে আমেরিকাকে একহাত নিয়েছে রাশিয়াও। রাশিয়ার পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা টেলিগ্রামে লিখেছেন, ‘পশ্চিম এশিয়ায় বাইডেন প্রশাসনের নীতি ব্যর্থ। মার্কিন বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের অপদার্থতার কারণে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।’ দু’পরশক্তির দু’দিকে অবস্থান বিশ^কে কোনদিকে নিয়ে এটাই এখন বড় প্রশ্ন।##

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.