--- বিজ্ঞাপন ---

বাংলাদেশের সমুদ্র বাণিজ্য কেন বিদেশীদের হাতে?

0

কাজী আবুল মনসুর :

বাংলাদেশের সমুদ্র বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে বিদেশি জাহাজ মালিকরা। যুগ যুগ ধরে তারা এ কাজটি করে যাচ্ছে সুকৌশলে। দেশের জাহাজ মালিকদের সুরক্ষার জন্য কাগজে-কলমে আইন থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ফলে দেশীয় জাহাজের সংখ্যা বাড়ছে না। বিদেশিদের নানা কৌশলের কাছে হার মেনে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। সমুদ্রপথে. এখন বিদেশি মালিকানাধীন জাহাজের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে একচেটিয়া পরিবহন বাণিজ্য। আমদানি-রফতানিতে কনটেইনার বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণের সুবাধে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর জাহাজভাড়া বাবদ বিদেশিরা নিয়ে যাচ্ছে কমপক্ষে ৩০ হাজার কোটি টাকা। কোনো প্রকার বিনিয়োগ ছাড়াই দীর্ঘদিন বিদেশি জাহাজ মালিকরা বাংলাদেশে এ ব্যবসা করছেন। তাদের দেওয়া আয়কর নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। কারণ ঠিক কী অঙ্কের টাকা তারা এদেশে আয় করছে এবং কী অঙ্কের টাকা বিদেশে জাহাজভাড়া হিসেবে পাঠিয়ে দিচ্ছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই।

বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর ইয়াহ্ইয়া সৈয়দ বিএসসির সভায় সম্প্রতি তথ্য প্রকাশ করে জানান, দেশে আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহনে সমুদ্রগামী জাহাজের খরচ কমপক্ষে ৪ বিলিয়ন ডলার। যার অন্তত ৯৫ শতাংশ বিদেশি জাহাজ মালিকরা নিয়ে যাচ্ছেন। বিএসসির বহরে ৪০ থেকে ৫০টি জাহাজ থাকা বাঞ্ছনীয় হলেও অর্থাভাবে গত ২৭ বছরে কোনো জাহাজ সংযোজিত হয়নি। চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বাংলাদেশি জাহাজ নেই বলে তারা একচেটিয়া রাজত্ব করছে। আগে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) অনেকগুলো জাহাজ ছিল। তার সঙ্গে দেশীয় মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি জাহাজও সক্রিয় ছিল। কিন্তু ক্রমান্বয়ে প্রতিযোগিতায় বিদেশিদের সঙ্গে তারা পাল্লা দিয়ে চলতে পারেনি। বিএসসিকে শক্তিশালী করলে এ খাত আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারে বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা জানান, একই ট্রেডে দুটি সংগঠন হতে পারে না। অথচ আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশে তা হচ্ছে। বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমেই যেখানে সবার কাজ করা উচিত, সেখানে বিদেশিরা একটি সংগঠন দাঁড় করে দিয়েছে। সাবেক বিএনপি সরকারের আমলে ওই সংগঠনের অনুমতি দেওয়া হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে মামলার পর মামলা হলেও তারা বহাল তবিয়তে চলছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশের সমুদ্রগামী জাহাজ পরিবহন শিল্পকে রক্ষার জন্য ১৯৮২ সালে প্রণীত হয় ফ্লাগ ভেসেল প্রটেকশন অর্ডিন্যান্স। এ অর্ডিন্যান্সে বলা হয়েছে, আমদানি ও রফতানি মালামাল বহনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ অগ্রাধিকার পাবে। মূলত দেশের স্বার্থে বিদেশি জাহাজ কোম্পানির একচেটিয়াত্ব ভেঙে দেশি জাহাজ শিল্প গড়ে তোলার জন্য এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আইনে বলা আছে, বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ কোনো নির্দিষ্ট সময়ে কোনো একটি রুটের মাল পরিবহনের জন্য বন্দরে উপস্থিত না থাকলে শুধু সে পরিস্থিতিতে বিদেশি জাহাজ ডিজি শিপিংয়ের কাছ থেকে ওয়েভার বা অনাপত্তিপত্র নিয়ে মাল তুলতে পারবে। এ ধরনের আইন শুধু বাংলাদেশে নয়, উন্নত ও উন্নয়নশীল বহু দেশেই রয়েছে। জাতিসংঘের আঙ্কটাড রুলসে বলা হয়েছে, সমুদ্রগামী পণ্য পরিবহন ব্যবসা ৪০-৪০-২০ নীতিতে ভাগাভাগি হবে। অর্থাৎ ৪০ শতাংশ পাবে রফতানিকারক দেশ, ৪০ শতাংশ পাবে আমদানিকারক দেশ, অবশিষ্ট ২০ শতাংশ নেবে মুক্তবাজার প্রতিযোগিতায় যার সামর্থ্য বেশি সে। এর ভিত্তিতেই আঙ্কটাডে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ‘ফ্লাগ প্রটেকশন অর্ডিন্যান্স’ জারি করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশি জাহাজ অন্তত ৪০ শতাংশ পণ্য পরিবহন করবে। সামর্থ্য অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে এটা বেড়ে যাবে। এ আইনটি এখন কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। অথচ সম্প্রতি বর্তমান সরকারের আমলে ৪০ শতাংশকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। কিন্তু খুব একটা ফল পাচ্ছেন না দেশীয় মালিকরা। একটাই কারণ দেশের জাহাজ বলতে গেলে তেমন নেই। এ সেক্টরকে সুকৌশলে পঙ্গু করে ফেলা হচ্ছে। দেশের জাহাজ বাড়লে বাইরে চলে যাওয়া বিপুল টাকা দেশেই থাকত।

অভিযোগ উঠেছে, বিদেশিদের সঙ্গে যোগসাজশে দেশবিরোধী স্বার্থান্বেষী চক্র কৌশলে ধ্বংস করে ফেলেছে দেশের সমুদ্রগামী জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনকে (বিএসসি)। একসময় এ প্রতিষ্ঠানের ৩৫টি জাহাজ ছিল। বিএসসিকে পঙ্গু করার পর বিদেশিরা বাংলাদেশের শিপিং সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। দেশের স্বার্থে করা পতাকা আইনটির প্রয়োগ অকার্যকর হয়ে যায়। বিদেশিরা দেশ থেকে প্রতি বছর নিয়ে যেতে থাকে কোটি কোটি ডলার। জাহাজ চলাচলে সরকারি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হলেও পাশাপাশি গড়ে উঠে দেশের বেসরকারি জাহাজ শিল্প। গঠিত হয় বাংলাদেশ ওশেন গোয়িং শিপিং অ্যাসোসিয়েশন (বোগসোয়া)। বেসরকারিভাবে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা বাড়তে থাকলে বিদেশি চক্রটি এ দেশীয় চক্রের হোতাদের নিয়ে ফ্লাগ প্রটেকশন আইনটি বাতিলের জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করে। বিদেশিরা ২০০৩ সালে এ অধ্যাদেশ সংশোধন করাতে সক্ষম হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে বিদেশিদের আর অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই বলে সংসদে সংশোধনী পাস হয়। এটি নিয়ে হাইকোর্টে মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত দেশীয় জাহাজ সেক্টর আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি।

জানা যায়, বাংলাদেশের সমুদ্র বাণিজ্যে একচেটিয়া আধিপত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে বিদেশি জাহাজ মালিকদের একটি গ্রুপ বর্তমানে সক্রিয় রয়েছে। শুরু থেকে এর পেছনে সক্রিয় বিদেশি শিপিং লাইনের এজেন্টগুলো হচ্ছে, হংকংয়ের ডব্লিওসিএল, ডেনমার্কের মার্কস লাইন, আমেরিকার আমেরিকান প্রেসিডেন্ট লাইন, জার্মানির হেপাগ লয়েড। বাংলাদেশে তারা ‘ইন্টারন্যাশনাল কনটেইনার অ্যাসেসিয়েশন (ইকসা) নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। দেশে ‘বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’ নামের একটি সংগঠন থাকার পর ট্রেড অর্গানাইজেশন নীতিমালায় অন্য কোনো সংগঠন হতে পারে না। কিন্তু প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় তারা নিজেদের একটি সংগঠন করে শিপিং বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়। সাবেক বিএনপি সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সহযোগিতায় বিদেশিদের সংগঠনটি তৎপরতা শুরু করে। সর্বশেষ বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলাদেশের শিপিং ব্যবসা শতভাগ বিদেশিদের কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য তৎকালিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। পরবর্তীতে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে দেখা করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিষয়টির ব্যাপারে তার সহযোগিতা চান। এক পর্যায়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বরাবরে ইউরোপিয়ান কমিশন, ফ্রান্স, কোরিয়ান, আমেরিকান, সুইডেন ও ডেনমার্কের অ্যাম্বেসেডররা লিখিত চিঠি দেন। তাতে তারা বাংলাদেশে বিদেশিদের ব্যবসার সহজভাবে পরিচালনার জন্য লাইসেন্স প্রদানের বিষয়টি উল্লেখ করেন। মূলত এরপর থেকে দেশে একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে বিদেশি শিপিং লাইনগুলো।

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতি বছর বাড়ছে কনটেইনারবাহী আমদানি-রফতানির পরিমাণ। প্রতি বছর গড়ে এর পরিমাণ বাড়ে প্রায় ২০ শতাংশ। এ সুযোগে বেড়েছে কনটেইনারবাহী জাহাজের পরিমাণও। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৩৫ থেকে ৪০টি কনটেইনার জাহাজ বর্তমানে আমদানি-রফতানি পণ্য বহনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর-কলম্বো-মালয়েশিয়া তিনটি রুটে কনটেইনার জাহাজে তাদের পণ্য আনা-নেওয়া করেন। আগে জাহাজের মধ্যে বাংলাদেশি পতাকাবাহী বেসরকারি এইচআরসি শিপিংয়ের মালিকানাধীন আটটি এবং সরকারি বিএসসির দুটি জাহাজ থাকলেও বিদেশিদের কাছে তারা টিকতে পারেনি।

জানা যায়, বর্তমানে সমুদ্রপথে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানির পরিমাণ বছরে প্রায় ২ লাখ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ পণ্য সামগ্রী পরিবহনের জন্য ১৫ শতাংশ জাহাজভাড়া বাবদ খরচ হয়। যার পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে পুরো টাকা জাহাজভাড়া হিসেবে চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। বাংলাদেশ থেকে বিপুল টাকা নিয়ে গেলেও তাদের প্রদত্ত আয়কর নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। অভিযোগ রয়েছে, তথ্য গোপন করে তারা আয়কর প্রদানের কাজটি করে থাকেন। এ খাতের প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় অনেকটা নির্বিঘ্নে তারা কোনো প্রকার বিনিয়োগ ছাড়াই বাংলাদেশে একচেটিয়া সমুদ্র বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনকে শক্তিশালী করলে দেশের টাকা দেশেই থাকত। কিন্তু সরকারের পর সরকার বদল হলেও এ ব্যাপারে কোনো সফলতা আসেনি। ক্রমশ মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে সরকারের মালিকানাধীন এ শিপিং সেক্টরটি।

 

 

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.