জাপানে কাজের মানুষের বড়ই অভাব। আমাদের দেশের মতো গৃহকর্মী জাপানে কল্পনাও করা যায় না। তাই জাপানের ধনীরা এখন ঘরে ঘরে ব্যবহার করছে রোবট। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে জাপানীদের ঘরে রোবটের সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাড়াবে এ নিয়ে খোদ জাপানেই চলছে আলোচনা। সমালোচনাও থেমে নেই। কারণ মানুষকে অলস বানিয়ে দিতে পারে রোবট। রোবট তৈরির প্রযুক্তি বর্তমানে এমন এক পর্যায়ে এসে পৌছেছে যে, রোবট দিয়ে ঘর পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে বাড়ির সব ধরনের কাজ করানো হচ্ছে।
পৃথিবীর জনসংখ্যা এগিয়ে যাচ্ছে হাজার কোটির দিকে। এ নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। বিকাশমুখী অনেক দেশেই জনসংখ্যা বাড়ছে। জাপানে ঘটছে পুরোপুরি এর উল্টোটা। সেখানে বাচ্চা নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে নতুন প্রজন্ম। ১৯৫০সালে জাপানের একটি পরিবারে দুই থেকে তিনটি করে বাচ্চা দেখা গেছে। কিন্তু এখন একটি বাচ্চাই যথেষ্ট মনে করা হচ্ছে। এবং কোন কোন ক্ষেত্রে জাপানিরা বাচ্চার ঝামেলাতেই যেতে চাইছেন না। যদি নতুন প্রজন্মের সংখ্যা এত কম হয় তাহলে যারা বৃদ্ধ, তাদের যত্ন কে নেবে? এইসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দেখাশোনাই বা কে করবে? কীভাবে রক্ষা করা হবে তাদের প্রয়োজনগুলো? এ নিয়ে জাপানে হরদম চা’র কাপে ঝড় চলে। এসব প্রশ্নের মুখে এগিয়ে এসেছে বেশ কিছু গাড়ি তৈরির কারখানা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান এবং ইলেকট্রনিক্সের কোম্পানি। তারা তৈরি করছে রোবট। যেমন প্যানাসনিক কোম্পানি এমন একটি বিছানা তৈরি করেছে যা হুইল চেয়ার হিসেবেও ব্যবহার করা সম্ভব। এমন একটি রোবটও তারা তৈরি করেছে যে রোবটটি বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার চুলে শ্যাম্পু করতে এবং চুল ধুয়ে দিতে সাহায্য করবে। কোম্পানির পরিচালক ইয়ুকিও হোন্ডা বলেন, ‘‘আমাদের লক্ষ্য হল সমাজের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সাহায্য করা। শারীরিকভাবে যারা আর আগের মত পরিশ্রম করতে পারেন না, তাদের প্রতিদিনের জীবনকে আরো সহজ করে তোলা।’’
টয়োটা মোটর কোম্পানি তৈরি করছে একের পর এক রোবট তৈরি করছে।এর মধ্যে এমন এক ধরনের রোবট আছে যা সঙ্গী হবে নিঃসঙ্গ মানুষের। তারা ঘর পরিষ্কার করবে, প্রয়োজনীয় ওষুধটি কাছে এনে দেবে, হাঁটা-চলার সময় একটি হাত ধরে রাখবে। এ ধরনের সেবা দেবে রোবট। জাপানের মানুষরা দীর্ঘায়ু লাভ করে থাকে। পুরুষরা সাধারণত ৮০ থেকে ৯০বছর পর্যন্ত বাঁচে এবং মহিলারা ৮৫। একশো বছর বয়সের মানুষ জাপানে কম নয়। জাপানের বর্তমান জনসংখ্যা বারো কোটির কিছু বেশি। এর মধ্যে ২৩ শতাংশের বয়স ৬৫’র ওপরে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০৫৫ সালের মধ্যে জাপানের জনসংখ্যা নেমে আসবে নয় কোটির নিচে।
জাপানের সংবাদমাধ্যমগুলো খবর দিয়েছে, দেশটির বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের এখন সাহায্য করছে রোবট। বর্তমানে বেশ কিছু সংস্থা বিশেষ ধরনের রোবট তৈরি করছে যারা ঘর পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে চুলে শ্যাম্পু পর্যন্ত করে দিতে সক্ষম।
জাপানে ৭৯ বছর বয়সী বৃদ্ধা একিনো। বাস করেন রাজধানী টোকিও থেকে বেশ দুরের একটি গ্রামে। বাড়িতে তার স্বামী নেই, নেই কোন সন্তানও। স্বামী-আত্মীয় স্বজন সবাই মারা গেছেন। তাই বলে এই বৃদ্ধার গোটা জীবন কিন্তু একাকী কাটেনি। সেই বৃদ্ধার একমাত্র সঙ্গী হল প্রিমো পুয়েল। এই প্রিমো আসলে কোনও মানুষ নয়। এক ধরনের রোবট, যার সাথে একিনো কথা বলেন, খেলা করেন।
এমনি আর একটি ঘটনা। হিরোজকি কাইকোর রোবটের নাম নভো। তার একমাত্র সাথী এই রোবট। তিনি বলেন, আমি নভোকে আমার পড়ার টেবিলের পাশে রাখি। তাকে আমি আধঘন্টা পরপর শব্দ করতে বলি সে আমাকে সময় জানায়। মাঝে মাঝে সে আমাকে বিভিন্নভাবে হেঁটে চলে দেখায়। এতে করে আমার নিঃসঙ্গতার মাঝে আনন্দ খুঁজে পাই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০৫০ সালে জাপানে একিনো ও হিরোজকির মতো ৬৫ উর্ধ্ববয়স্কের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ হবে।
অতিরিক্ত বাচ্ছা না নিয়ে মানুষ যে রোবট চায়, রোবটকে দিয়ে কাজ করাতে চায়, সেটারও প্রমাণ হয়ে গেলো ২০০৮ সালে। ২০০২ সালে বাজারে ছাড়া হয়েছিলো রুম্বা নামের এক ভ্যাকুয়াম ক্লিনার রোবট। মাত্র ৬ বছরেই এই ক্লিনার রোবট বিক্রি হয়েছে আড়াই মিলিয়নেরও বেশি। জাপানের অনেক ছাত্র-ছাত্রীরা এখন পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে রোবট তৈরিকে বেছে নিয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর জন্য প্রনোদনা দিয়ে যাচ্ছে। ঘরের কাজের রোবট, খেলাধুলার রোবট তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে জাপানীরা। সবচেয়ে বড় খবর হলো, জাপানীরা এখন এমন রোবট তৈরি করে ফেলেছে যা প্রতিবন্ধীদের সাহায্য করছে বিভিন্ন কাজে। ভবিষ্যতে রোবট নিয়ে তারা কতদুর যাবে এটাই এখন দেখার বিষয়।##২৬.১১.১৯