--- বিজ্ঞাপন ---

ভারতে সিনেমা জগত থেকে এনকাউন্টার ফিরলো বাস্তবে,পক্ষে-বিপক্ষে চলছে তোলপাড়

‘মেয়ের আত্মা শান্তি পেল’, বললেন ধর্ষিতার বাবা

0

ভারতে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে সংসদে আওয়াজ তুলেছিলেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী জয়া বচ্চন। তিনি বলেছিলেন, ধর্ষধকদের মেরে ফেলা হোক। তার বক্তৃতার রেশ কাটতে না কাটতে এনকাউন্টার করা হলো ৪ ধর্ষককে। ভারতে এনকাউন্টার দৃশ্যটি সাধারনত সিনেমাতে বেশি প্রাধান্য পেতো। গনতন্ত্র আছে বলে এনকাউন্টারের দিকে অনেকদিন নজর ছিল না পুলিশের। কিন্ত একের পর এক ধর্ষনকান্ডে যখন দেশের বারোটা বাজতে শুরু করেছে তখন এনকাউন্টার ফিরে এলো সিনেমা থেকে বাস্তবে। আর এই এনকাউন্টার নিয়ে তোলপাড় চলছে সারা ভারতে। কেউ বাহবা দিচ্ছে পুলিশকে, আবার কেউ কেউ মানবাধিকার এর প্রশ্ন তুলে এ কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তবে যে যা বলুক, এ কাজে খুশি হয়েছে যে পরিবারগুলোর নারী ধর্ষন আর হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে।

কি বলছে ভারতীয় গণমাধ্যম

এই সময় লিখেছে, হায়দারাবাদে নারী পশু চিকিৎসককে গণধর্ষণের পর আগুন জ্বালিয়ে দেহ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় দশদিনের মাথায় অভিযুক্ত চার জনকে এনকাউন্টারে খতম করল সাইবেরাবাদ পুলিশ। শুক্রবার ভোররাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চার অভিযুক্তকে। পুলিশ জানিয়েছে, তখনই পালানোর চেষ্টা করে অভিযুক্তরা। তখনই শুরু হয় এনকাউন্টার। পুলিশের গুলিয়ে মৃত্যু হয় চার অভিযুক্তেরই।

এনকাউন্টারে অভিযুক্তদের মৃত্যু আদৌ ঠিক নাকি ভুল সিদ্ধান্ত, এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত বিভিন্ন মহল। দেশের বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়েছে মিষ্টি বিতরণ। এই ঘটনায় খুশি হয়েছেন অনেকেই। আবার কেউ কেউ বিরোধিতার সুর চড়িয়েছে। গত ২৭ নভেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর। মাঝে কেটে গিয়েছে দশদিন। জেলেই দিন কাটছিল হায়দরবাদ গণধর্ষণ কাণ্ডের চার অভিযুক্তের। তরুণী চিকিৎসককে গণধর্ষণে অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে সরব হয়েছিল গোটা দেশ।এর পর শুক্রবার সকালে ঘটনার পুনর্নির্মাণের সময় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে চার অভিযুক্ত। বাধ্য হয়ে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এনকাউন্টারে খতম হয় তারা। মেয়ের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের মৃত্যুর খবরে খুশি নির্যাতিতার পরিবার। হায়দরাবাদ-সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে খুশির আবহ। হায়দরবাদ পুলিশকে স্যালুট জানাচ্ছেন অনেকেই।তবে এই এনকাউন্টারের তীব্র বিরোধিতা করছেন কেউ কেউ। মানবাধিকারের প্রশ্ন তুলেছেন মানেকা গান্ধী। তিনি জানিয়েছেন, যা হয়েছে তা দেশের জন্য অত্যন্ত ভয়ংকর। যেমনই পরিস্থিতি আসুক না কেন নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়া যায় না। আদালতের মাধ্যমে ওদের বিচার হওয়ার প্রয়োজন ছিল। তিনি একা নন জাতীয় মহিলা কমিশনের তরফে এনকাউন্টারে কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে সংশয় মাথাচাড়া দিয়েছে। চেয়ারপার্সন রেখা শর্মা জানিয়েছেন, অভিযুক্তদের সকলেই ফাঁসি দেওয়া উচিত ছিল। একজন মানুষ হিসাবে খুশি। তবে আইনি পথে শাস্তি হলে বোধহয় আর ভালো হত।
হায়দরাবাদ এনকাউন্টারের ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত শুরু করল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। সংবাদমাধ্যমে হায়দরাবাদ এনকাউন্টারে চার অভিযুক্তের মৃত্যুর খবর দেখে সুয়ো মোটো অভিযোগ নেওয়ার হয়েছে। নিজস্ব তদন্তকারী দল ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে NHRC। এ দিকে, হেফাজতে বন্দি মৃত্যুর ঘটনায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক তেলেঙ্গানা সরকারের কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে।

সূত্রের খবর, মন্ত্রকের তরফে বলা হয়েছে, হেফাজতে বন্দিকে মেরে ফেলা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী রাজ্য সরকারকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সূত্রের দাবি, ‘যেহেতু সংসদে অধিবেশন চলছে, মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হতে পারে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে সব তথ্য জোগার করে তৈরি থাকতে হবে।’
এ দিকে, এনকাউন্টারের সময় নিয়ে দু রকম তথ্য উঠে এসেছে তেলেঙ্গানা পুলিশের কথায়। সাইবেরাবাদ পুলিশ প্রাথমিকভাবে বলেছিল যে ভোর ৩.৩০-এ এনকাউন্টার হয়েছে। পরে সরকারি বিবৃতি দেওয়ার সময় শামশাবাদের ডেপুটি কমিশনার এন প্রকাশ রেড্ডি জানান, ‘সকাল ৬.৩০টা নাগাদ অপরাধের পুনর্নির্মাণের জন্য অভিযুক্তদের নিয়ে অপরাধস্থলে যায় আমাদের লোকেরা। তখনই তাঁদের থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে অভিযুক্তরা। পালটা গুলি ছোড়ে পুলিশও।’পুলিশ জানিয়েছে, পশু চিকিত্সককে ধর্ষণ ও খুনে অভিযুক্ত মহম্মদ আরিফ, নবীন, শিবা ও চেন্নাকেসাভুলুর এনকাউন্টারে মৃত্যু হয়েছে। পুলিশের দাবি, ভোর রাতে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করার জন্য অভিযুক্তদের অপরাধস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তখনই পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে হেফাজত থেকে পালানোর চেষ্টা করে চার অভিযুক্ত। তখনই ৪৪ নং জাতীয় সড়কের উপর শুরু হয় এনকাউন্টার। এনকাউন্টারে মৃত্যু হয় চার অভিযুক্তের।

আনন্দবাজারের প্রতিবেদন, ভোররাতের তেলঙ্গানা এনকাউন্টারের খবর ছড়িয়ে পড়তেই দেশ জুড়ে প্রশংসার বন্যা। তবে এ ভাবে আইন হাতে তুলে নেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত, সে প্রশ্নই উঠতে শুরু করেছে সাবাশির স্রোতের মধ্যেও। আইনরক্ষদের হাতে বিচারাধীন বন্দিদের হত্যাকেই শেষে কি বিচার ভেবে বসলেন দেশের জনতা! এ দিন পুলিশকে লক্ষ্য করে পুষ্পবৃষ্টি হয়েছে। তবে অনেকরই প্রশ্ন, গোটা ঘটনায় কি বিচারব্যবস্থার অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে না?
শুক্রবার ভোররাতে পুলিশি এনকাউন্টারে গণধর্ষণ ও খুনে অভিযুক্তদের নিহত হওয়ার ঘটনা এ দিন সাতসকালে শোনার পর নিজের স্বস্তি চেপে রাখতে পারেননি নির্যাতিতার বাবা। তাঁর মতে, এই ঘটনার পর মেয়ের আত্মা শান্তি পেল। তিনি বলেন, ‘‘দশ দিন হল আমার মেয়ে মারা গিয়েছে। পুলিশ এবং সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানাই। মেয়ের আত্মা এখন অবশ্যই শান্তি পেয়েছে।’’
২৭ নভেম্বর হায়দরাবাদের শামশাবাদে এক তরুণী চিকিৎসককে গণধর্ষণ করে খুন করে ওই চার অভিযুক্ত। এর পর ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে সাদনগরে পুড়িয়ে ফেলা হয় ওই তরুণীর দেহ। এ দিন গভীর রাতে ওই ঘটনার পুনর্নিমাণ করতে অভিযুক্তদের ঘটনাস্থলে নিয়ে যায় পুলিশ। পুলিশের দাবি, সে সময় তাঁদের অস্ত্র ছিনিয়ে পালানোর চেষ্টা করে অভিযুক্তেরা। আত্মরক্ষার্থে তাদের গুলি করে মারা হয়।
এনকাউন্টারের খবর শোনার পর নির্যাতিতার বাবার মতোই স্বস্তি পেয়েছেন নির্ভয়ার মা আশা দেবী। এ দিন তিনি জানিয়েছেন, এই ঘটনায় যেন তাঁর ক্ষতে মলমের প্রলেপ লেগেছে। ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে মেয়ে জ্যোতি সিংহকে গণধর্ষণ করে ছ’জন। সে মাসের শেষে হাসপাতালে মৃত্য হয় জ্যোতির। সাত বছর আগের সেই ক্ষতই বয়ে বেড়াচ্ছেন জ্যোতির মা আশা দেবী। তাঁর কথায়, ‘‘পুলিশ যে ওদের এ ভাবে শাস্তি দিয়েছে, তাতে আমি অত্যত আনন্দিত। পুলিশকর্মীরা খুব ভাল করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে যাতে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, সে দাবি জানাচ্ছি।’’
তবে নির্যাতিতার বাবা অথবা নির্ভয়ার মায়ের সঙ্গে সহমত নন অনেকেই। এই ঘটনার পর পুলিশের নিন্দা করে বিজেপি সাংসদ মেনকা গাঁধী বলেন,‘‘যা হয়েছে তা এই দেশের জন্য ভয়ানক।… চাইলেই যাকে খুশি এ ভাবে মারতে পারেন না আপনি। আইন হাতে তুলে নিতে পারেন না। আদালতে তো ওদের (অভিযুক্তদের) ফাঁসিই হত।’’
তবে মেনকা গাঁধীর দলেরই আর এক সাংসদ অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করেছেন। হুগলি লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘এতে মেয়েটির আত্মা শান্তি পেয়েছে। এত বড় ও জঘণ্য ঘটনার পর ওরা পালানোর চেষ্টা করেছে। তাতে এনকাউন্টারে নিহত হয়েছে। আমি পুলিশকে ধন্যবাদ জানাই।’’ যদিও লকেট চট্টোপাধ্যায় মতোই পুলিশি তৎপরতার প্রশংসা করলেও গোটা বিষয়টি যে তদন্তসাপেক্ষ সে কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রধান রেখা শর্মা। তাঁর কথায়, ‘‘পুলিশের ভাল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এটা তো তদন্তাধীন বিষয়। বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তি চেয়েছিলাম। তবে ঘটনার সময় যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ তা তারিফযোগ্য।’’
রেখা শর্মার মতোই সাবধানী মন্তব্য কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার গৌতমমোহন চক্রবর্তীর। তিনি বলেন, ‘‘অভিযুক্তরা যদি পালানোর চেষ্টা করে এবং পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি করে, তা হলে ঠিকই আছে। তবে এই মুহূর্তে ঘটনাটি যে ভাবে ঘটেছে, তেমন ভাবেই দেখা উচিত। কারণ এর পর তো গোটা ঘটনার ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্ত হবে।’’ এ দিনের ঘটনার পর তেলঙ্গানা পুলিশের প্রশংসা করেছেন বিজেপি নেত্রী উমা ভারতী। তাঁর মতে, ‘‘যে সমস্ত পুলিশকর্মী এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের সকলেই প্রশংসার যোগ্য। আমি নিশ্চিত অন্য রাজ্যের পুলিশও এমন কোনও উপায় বার করবেন, যাতে অপরাধীদের উচিত শিক্ষা মেলে।’’
বিরোধী দলের একাংশের মতে সায় নেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাঁর মতে, ‘‘এ ভাবে আইন হাতে তুলে নেওয়া যায় না। দ্রুত চার্জশিট দিয়ে অভিযুক্তদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।’’
সমাজের একাংশের সমালোচনার পাশাপাশি বিপুল প্রশংসাও পাচ্ছে এ দিনের ঘটনা। এ দিনের ঘটনার খবর প্রকাশ্যে আসার পর তেলঙ্গানা পুলিশের উপর পুষ্পবৃষ্টির করেছেন অনেকে। তবে একাংশের মতে, এই উল্লাসের পিছনে রয়েছে বিচারব্যবস্থার প্রতি এক প্রকার অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ। অপরাধের পর তা বিচারাধীন প্রক্রিয়াটি এতটাই দীর্ঘায়িত হয় যে বিচারব্যবস্থার প্রতিই আস্থা হারিয়ে ফেলেন অনেকে। এতে যেন বিচারব্যবস্থার অস্তিত্বই চ্যালেঞ্জে মুখে পড়েছে। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, ‘‘বিচারব্যবস্থার বাইরে গিয়ে খুনের ঘটনা কখনও মহিলাদের সুরক্ষা প্রশ্নের সমাধান হতে পারে না।’’ একই সুর শোনা গিয়েছে সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিনের কথায়। তিনি বলেন, ‘‘অপরাধীদের মেরে ফেলাটা সোজা। তবে মানুষকে এমন ভাবে শিক্ষিত করা উচিত যাতে তাঁরা কখনই অপরাধী হয়ে উঠবেন না, এটা একেবারেই সোজা নয়। আমরা সোজা পন্থাটাই পছন্দ করি।’’

লোকসভার সাংসদ তথা কংগ্রেস নেতা শশী তারুরের মতে গোটা ঘটনাটি আরও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘‘নীতিগত ভাবে একে সমর্থন করছি। তবে বিষয়টি আরও জানা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, অপরাধীরা সশস্ত্র থাকায় পুলিশ হয়তো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গুলি চালিয়েছে। ঘটনাটা আসলে কী ঘটেছিল তা যত ক্ষণ প্রকাশ্যে না আসছে, তত ক্ষণ আমাদের এ নিয়ে নিন্দা করা উচিত নয়। তবে বিচার ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে খুন সামাজিক আইন অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নয়।’’###৬.১২.১৯

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.