--- বিজ্ঞাপন ---

প্যান্ডোরা বক্স নিয়ে বিশ্বে চলছে তোলপাড়

0

হঠাৎ করে ফেসবুক, হোয়াটসআপ, ইনস্টাগ্রাম ডাউন। গতকাল রাতে সারা বিশ্বের মানুষ ছিলেন নানা উৎকন্ঠায়। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করার পরও যখন এগুলো ঠিক হচ্ছিল না তখন মানুষের চিন্তার জগতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিড় কিছু হলো কিনা। এ নিয়ে অবশ্য ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ব্যাখ্যা না দিলেও বিশ্বের প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের গোপন তথ্য নিয়ে প্রকাশিত প্যান্ডোরা বক্সের সাথে এর সম্পর্ক খুজঁছিল। বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টিকরা প্যান্ডোরা বক্স এর প্রতিবেদন নিয়ে এর মধ্যে হিসেব নিকেশ শুরু হয়েছে। কি আছে এই প্যান্ডোরা বক্সে তা নিয়ে কৌতুহলের অন্ত নেই।

উইকিপিডিয়ার তথ্য মেতে, প্যান্ডোরা পেপারস’ প্যান্ডোরা গ্রিক পুরাণ মতে প্রথম নারী। অলিম্পাসের দেবতারা যখন টাইটানদের কাছ থেকে স্বর্গ ছিনিয়ে নেয়, তার ও কিছু কাল পরে তারা পৃথিবীতে নতুন প্রাণী সৃষ্টি করার কথা ভাবে। এবং সে দায়িত্ব দেয়া হয় এপিমেথেউস ও প্রমিথিউস নামের দুই ভাইকে। এপিমেথেউস পৃথিবীতে নতুন প্রানীর সৃষ্টি করে এবং তাদের ভালো ভালো গুন দিয়ে দেয়া হয়। পরে প্রমিথিউস দেখে মানুষকে দেয়ার মত কোন বিশেষ গুনই আর বাকি নেই। সে তখন স্বর্গ থেকে আগুন চুরিকরে এনে মরনশীল মানুষের হাতে তুলে দেয় । আগুন চুরি করায় দেবরাজ জিউস প্রমিথিউস ও মানব জাতির উপরে রেগে গিয়ে তাদের শাস্তি দেয়ার জন্য, হেফেথাসকে দিয়ে একটি মাটির তৈরী নারী বানিয়ে নেন, এবং যার নাম দেয়া হয় প্যান্ডোরা। প্রত্যেক দেবতাই অবদান রেখেছে প্যান্ডোরা কে গড়ে তুলতে, সবাই কিছু না কিছু উপহার দিয়েছে প্যান্ডোরাকে। প্যান্ডোরাকে তৈরীকরার জন্য ভালোবাসার দেবী আফ্রোদিতিকে বেছে নায়া হয় মডেল হিসেবে, আফ্রোদিতি তাকে দেয় সৌন্দর্য্য-লাবণ্য-আকাঙ্ক্ষা। হার্মিস তাকে দেয় চাতুর্য ও দৃঢ়তা, এ্যাপোলো নিজে তাগে সঙ্গীত শেখায় এভাবে প্রত্যেক দেবতাই তাদের নিজেদের সেরাটা দিয়ে সাজিয়ে তোলে প্যান্ডোরাকে। সবশেষে দেবরাজ জিউসের স্ত্রী হেরা প্যান্ডোরাকে উপহার দেয় হেরার অনন্য বৈশিষ্ট্য কৌতূহল। প্যান্ডোরাকে দেবতাদের তরফ থেকে উপহার হিসেবে পাঠানো হয় এপিমেথেউসের কাছে, তাকে বলা হয় তার ভাই এর কৃতকর্মের জন্য তারওপর কোন রাগ নেই সেটা প্রমাণ করার জন্য জিউস এই উপহার পাঠিয়েছে। এপিমেথেউসের ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ভাই প্রমিথিউস তাকে নিষেধ করেছিলো দেবতাদের কোন উপহার গ্রহণ করতে। কিন্তু প্যান্ডোরাকে দেখামাত্র তার প্রেমে পড়ে যান এপিমেথেউস। এপিমেথেউস-প্যান্ডোরার বিয়েতে প্যান্ডোরাকে দেবরাজ জিউস উপহার দেন এক অপূর্ব বাক্স কিন্তু নিষেধ করে দেন এটি খুলতে। যতদিন এটি বন্ধ থাকবে ততদিন ই সুখে-শান্তিতে এপিমেথেউস ঘর করতে পারবে প্যান্ডোরা এটাও বলেন তিনি।দেবরাজ জিউসের নিষেধাজ্ঞা পরাস্ত হয় দেবরাণী হেরার দেয়া উপহার কৌতূহল এর কাছে। বিয়ের উপহার একবার দেখতে প্যান্ডোরা বাক্সটি খোলামাত্র বাক্সবন্দী রোগ-জরা-হিংসা-দ্বেষ-লোভ-মিথ্যা ইত্যাদি সব স্বর্গীয় নিচুতা ছড়িয়ে পরে মানুষের পৃথিবীতে।

এই হচ্ছে প্যান্ডোরার ইতিহাস। এই ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে বর্তমান সময়ে বিশ্বের বিপুল সংখ্যক প্রভাবশালীর গোপন নানা তথ্য খুলেছে ভিন্ন এক প্যান্ডোরা বক্স। যেখানে রয়েছে কমপক্ষে ৩০০ সরকারি কর্মকর্তার গোপন আর্থিক লেনদেনের তথ্য। এর মধ্যে আছেন কমপক্ষে ৯০টি দেশের মন্ত্রীরা, বিচারকরা, মেয়ররা এমনকি সামরিক শীর্ষ কর্মকর্তারা। আছেন কিংবদন্তি হয়ে ওঠা ক্রিকেটার থেকে সংগীতশিল্পীও। আছেন কমপক্ষে ১০০ বিলিয়নিয়ার। কম করে হলেও  ১২টি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান এ দোষে দোষী বলে দাবি করেছে সম্প্রতি ফাঁস হওয়া একটি রিপোর্ট। ‘এই গোপন তদন্তে যুক্ত ছিলেন বিশ্বের ৬০০ জন তদন্তমূলক সাংবাদিক। বিশ্বের মোট ১৪টি আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থার থেকে এক কোটি ১৯ লক্ষ নথি প্রকাশ্যে আনেন এই তদন্তমূলক সাংবাদিকেরা।

বাংলাদেশের প্রভাবশালী কারও কারও নামও আছে এ বক্সে। অনেকের ঘুম হারাম হয়ে গেলেও এখনও বিস্তারিত তথ্য সামনে আসেনি। তবে এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনালের (এএনআই) বলা হয়, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে নিবন্ধিত বিনোদ চৌধুরীর কোম্পানি সিনোভেশনে জড়িতদের একজন হলেন ‘বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক’ আব্দুল আউয়াল মিন্টু, যার বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে ঢাকায় অর্থ পাচার ও ঋণ জালিয়াতির তদন্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন। বাংলাদেশে তেমন শোরগোল না হলেও ভারতে বেশ জমিয়ে উঠেছে প্যান্ডোরার গল্প। ভারতীয় ক্রিকেটের সুপারস্টার শচীন টেন্ডুলকার, তার স্ত্রী অঞ্জলি টেন্ডুলকর, শ্বশুর আনন্দ মেহতার নাম প্রকাশ পেয়েছে প্যান্ডোরা পেপারসে। বলা হয়েছে, তারা বৃটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে (বিভিআই) একটি অফসোর কোম্পানির মালিক। এর নাম সাস ইন্টান্যাশনাল লিমিটেড। এতে তারা কেউ কোম্পানির বিও আবার কেউ পরিচালক। পানামাভিত্তিক আইনী প্রতিষ্ঠান অ্যালকোগ্যালের অনুসন্ধানে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এখানে উল্লেখ্য আইজে ম্যানেজমেন্ট (সুসি)’র সঙ্গে তদন্তে এ তথ্য উদ্ধার করেছে অ্যালকোগ্যাল। ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে)-এর প্রকাশিত প্যান্ডোরা পেপারসে এসব কথা বলা হয়েছে। তা নিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, সাস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নাম প্রথম উঠে আসে ২০০৭ সালের প্যান্ডোরা রেকর্ডসে।

এক ডজনের বেশি বর্তমান ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান গোপনে বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, সব দেশের রাজনীতিকরাই আছেন তাঁদের মধ্যে। সাংবাদিকদের সংগঠন থেকে বলা হয়েছে, বিশ্ব জুড়ে অতি ধনী এবং ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রপ্রধানরা সকলের চোখ এড়িয়ে হাজার হাজার কোটি ডলার সঞ্চয় করেছেন। তাঁদের সাহায্য করার জন্য নানা সংগঠন সক্রিয়। অনেক দেশই নাগরিকদের বিদেশে অর্থ জমা রাখতে অনুমতি দেয়। সেই সুযোগে ধনীরা এমন দেশে অর্থ গচ্ছিত রাখেন যেখানে করের হার কম।  বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এমন অনেক সংস্থা আছে, যারা ধনীদের বিদেশে অর্থ গচ্ছিত রাখতে সাহায্য করে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশগুলিতেও এই ধরনের চক্র সক্রিয়। তারা বিভিন্ন নামী ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে কাজ করে। যে রাষ্ট্রপ্রধানরা বিদেশে বিপুল অঙ্কের অর্থ জমিয়েছেন, তাঁদের তালিকার শীর্ষে আছে জর্ডনের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লার নাম। তিনি বিদেশি অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও আইনজীবীদের মাধ্যমে গোপনে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে বিপুল সম্পত্তি কিনেছেন। তার মধ্যে আছে ১৪ টি বিলাসবহুল প্রাসাদ। এছাড়া আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় সমুদ্রের তীরে একটি প্রাসাদেরও মালিক হয়েছেন তিনি। রাজার অ্যাটর্নিরা বলেছেন, জর্ডনের আইন অনুযায়ী তাঁকে কর দিতে হয় না। ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনি ও তাঁর স্ত্রী গোপনে লন্ডনের মেরিলবোন অঞ্চলে এক প্রাসাদের মালিক হয়েছেন। গার্ডিয়ানের বক্তব্য, টনি ব্লেয়ার বেআইনি কাজ করেছেন বলা যাবে না। কিন্তু তিনি আইনের ফাঁককে ব্যবহার করেছেন। চেকোস্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেজ বাবিস দ্বিতীয়বার নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। ২০০৯ সালে তিনি ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরায় একটি প্রাসাদের মালিক হন। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা তাঁকে গোপনে প্রাসাদটি কিনতে সাহায্য করে। পাহাড়ের ওপরে ৯.৪ একর জমির ওপরে রয়েছে সেই প্রাসাদ। যুক্তরাজ্যের একটি আদালতে ভারতীয় ধনকুবের অনিল আম্বানিকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়। তাঁর সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছে প্যান্ডোরা পেপারস। বলা হচ্ছে তাঁর ১৮টি অফশোর কোম্পানির মালিকানা রয়েছে।

এ ছাড়া দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রনেতাদের তালিকায় রয়েছেন আজারবাইজান, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট, তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ঘনিষ্ঠমহলের বেশ কয়েক জন নেতা এমনকি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও রয়েছেন প্যান্ডোরার তালিকায়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নাম সরাসরি না করা হলেও মোনাকোর একটি সম্পত্তি সূত্রে তিনিও রয়েছেন প্যান্ডোরার দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রনেতাদের তালিকায়।

প্যান্ডোরার নথিপত্র’ নামে ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, কর ফাঁকি দিতে রাষ্ট্রপ্রধানরা বিদেশি অ্যাকাউন্টে ঘুরপথে অর্থ চালান করছেন। একই ভাবে বিদেশে বেনামে বহুমূল্য বাড়ি, সম্পদও কিনেছেন কর বাঁচিয়ে। তদন্তমূলক সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন আইসিআইজে রবিবার এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। কর দুর্নীতির যে খতিয়ান প্রকাশ্যে এসেছে, তাতে জড়িয়েছে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতা, প্রাক্তন রাষ্ট্রনেতা এবং প্রথম সারির রাজনীতিবিদদের নাম। এঁদের মধ্যে রয়েছে জর্ডনের রাজা, চেক প্রজতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রীর নামও। এ ছাড়া বর্তমান এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রনেতা এবং রাজনীতিবিদ মিলিয়ে মোট ৩৫ জনের নাম রয়েছে তালিকায়।

তবে তদন্তমূলক সাংবাদিকদের সংগঠনটি জানিয়েছে, এই নথি হয়তো এই নেতাদের সরাসরি দোষী সাব্যস্ত করতে পারবে না। তবে এই প্রমাণ তাঁদের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে লজ্জাজনক হতে পারে। কেন না এই সব রাষ্ট্রনেতা কোনও না কোনও সময়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। আর এখন এঁরা নিজেরাই দুর্নীতির দায়ে পড়েছেন।#

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.